“তাদের কথা আমাকে এ+ পেতেই হবে। এ+ কি গাছে ধরে যে আমি পেড়ে আনবো। আরো অনেক কথা যা মনের ভিতর জমা করে রেখেছি। কিন্তু বললে শেষ হবে না। থাক” সূত্র: অনলাইন বাংলা। কথাগুলো এক এস.এস.সি পরীক্ষার্থীর। মর্মস্পর্শী আত্মহত্যার পূর্বে মা-বাবাকে উদ্দেশ্য করে চিঠিতে তার নিদারুণ উপলব্ধির কথাগুলো লিখে গিয়েছে। নাম আরাফাত শাওন। গত ৩০ মে প্রকাশিত এস.এস.সি পরীক্ষায় সে ৪.৮৩ পেয়েছিল।
কথাগুলো কি শুধু শাওনের? নাকি দেশের সাধারণ আট-দশজন অসহায় শিক্ষার্থীর? যারা পিতা-মাতার অসহনীয় চাপের মুখে এই করুণ মৃত্যুর পথ বেঁছে নিতে বাধ্য হয়েছে তাদের? যদি তাদের হয়ে থাকে তাহলে কেন পূনরাবৃত্তি ঘটছে? এই মৃত্যুর পথে কেন দ্বারস্থ হচ্ছে তারা এবং এর প্রতিকার কি হতে পারে সেটা আজকে বলবার চেষ্টা করবো।
আত্নহত্যার উপর পরিসংখ্যান
আত্মহত্যা নিয়ে যেহেতু আমার সরল-গরল তাই এ বিষয়ে একটি পরিসংখ্যান চোখে আওড়াতেই পারি যা নিতান্তই ভয়ানক আর গায়ে কাঁটা দেয়ার মত। বিদায়ী বছর ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস সামনে রেখে ৪ সেপ্টেম্বর জেনেভা থেকে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যা করছেন। বছরে আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর সংখ্যা আট লাখ। আত্মহত্যায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। বাংলাদেশের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে, বাংলাদেশে গত চার বছরে দিনে গড়ে ২৮ জন আত্মহত্যা করেছেন। আত্মঘাতীদের বড় অংশের বয়স ২১-৩০ বছরের মধ্যে। এতটুকু পড়ে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না যে বাংলাদেশে আত্মহত্যার অবস্থা কতটা নিদারুণ ও বেহাল। কিন্তু কেন এই মরণযাত্রার সরণাপন্ন হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা?
শাওনের মতো আমিও একসময় এস.এস.সি পরীক্ষার্থী ছিলাম। পড়াশুনার তেমন কোন চাপ ছিল না, সারাদিন টো টো করে ঘুরতাম আর খেলতাম। স্কুল থেকে ছুটি হওয়ার পরই খেলার মাঠ দাপিয়ে বেড়াতাম। কিন্তু কখনই পিতা-মাতার অসহনীয় চাপের সূলে চড়তে হয় নি আমায়। কারণ প্রায়সই আমার রেজাল্টের পাশে ইতিবাচক সাড়া এসেছে। তারপরেও পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করে উত্তীর্ণ হয়েছি। কিন্তু এই গল্পটা সমাজের হাতে গোনা দুই একজনের। যা সমাজের খণ্ডিত চিত্র। কিন্তু সার্বিক চিত্র পরিদর্শন করলে ঠিক অভিন্ন গল্পই মিলবে। শিক্ষার্থীদের উপর নিপীড়ন, প্রচন্ড চাপ, ভালো ফলাফলের তাড়ণার গল্প সমাজের পরতে পরতে বিদ্যমান। ভাল ফলাফলের জন্য শিক্ষার্থীদের উপর রীতিমত নিপীড়ন শুরু হয় ঠিক শিক্ষার্থীর ছোট্ট বয়স থেকে। যে বয়সটাতে সেই ছোট্ট শিশুটি খেলার ছলে ছলে পড়াশুনায় মনোনিবেশ করবে সেই কচি বয়স থেকে। মফস্বল কিংবা শহর, সব সবজায়গাতেই একই দৃশ্য পরিলক্ষিত। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায়(?) এখন প্রতিযোগিতার নামে শিশুদের মানসিক নির্যাতন, নিপীড়ন, চাপ দেয়া হচ্ছে। ভালো স্কুলে ভর্তি হতে হবে, ক্লাসে ফার্সট হতেই হবে, বৃত্তি পেতেই হবে, পরীক্ষায় এ+ পেতেই হবে এই ধরনের হাজার চাপের সম্মুখিন হতে হয় সেই কচি শিশুদের। অনেকটা ‘গলায় দড়ি লাগিয়ে ফলাফল আদায় করার করুণ অপচেষ্টা’।
অভিভাবকদের দায়িত্ব
শিক্ষার্থীদের চাপ নয় বরং ভালবেসে বুঝিয়ে শুনিয়ে পড়াশোনায় ব্রত রাখাটা হবে অভিভাবকদের গুরু দায়িত্ব। বইয়ের ভাড়ে নুয়ে রেখে তাদের ফলাফল আদায় করে তাদের মরণযাত্রায় ঠেলে দিবেন না, বরং তারা কি চায় সেটার গুরুত্ব ও সম্মান দিয়ে তাদের লেখাপড়ার পথকে সুগম করতে সাহায্য করুন। মনে রাখবেন, তারা আপনারই ছেলে-সন্তান। আপনার ভুলে তার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে অবলীলায়। তারা পশু না যে তাদের নিদারুণ খাটাতে হবে। শিশুরা হলো ঠিক কাদার মতো। তাকে গড়ে তোলার দায়িত্ব আপনারই হাতেই ন্যস্ত। দয়া করে জেনে শুনে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিবেন না।