somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার লাঙ্কাউই ভ্রমণের গল্প (পর্ব-৩)

২৬ শে আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ২:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



লাঙ্কাউইয়ের ক্যাবলকারের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। প্রায় দুই কিলোমিটারের দীর্ঘ এই ক্যাবলকার শুধু অ্যাডভেঞ্জারই নয়, আপনাকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের হাতছানি দিবে। লাঙ্কাউই ক্যাবলকারের উদ্দেশ্যে যাওযার আগে আমরা বিশ্রাম আর দুপুরে খাবারের জন্য পানটাই চেনাঙ (Pantai Chenang) এ অবস্থিত ভারতীয় রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। আমাদের দলটা প্রায় পশ্চাশজনের। সঙ্গে বাচ্চাদের একটা গ্রুপও আছে। তাই ভাত-মাছ-ডাল খাবারটায় সবার জন্য গ্রহণযোগ্য। আজকের খাবারের মেন্যু- ভাত, মুরগীর স্যালুন, ডাল, ফিসফ্রাই, পাকুরা, পাপড় ভাজা। রেস্টুরেন্টে বসেই সমুদ্রসৈকত দেখা যায়। এই সৈকতটা সম্পূর্ণই বিদেশী পর্যটকদের জন্য। তাই বিদেশী পর্যটকদের আনাগোনায় এই সৈকতে ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছে। দ্রুত খাবার শেষ করে আমরা কতিপয় যুবকশ্রেণী সবার অলক্ষ্যে সৈকতে এসে হাজির হলাম। মধ্যদুপুরে একগাদা কাপড় পড়নে এই সৈকতে আমাদের বড্ড বেমানান লাগছে। প্রকৃতির কাছে এসে প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়ায় তো উত্তম। আগত পর্যটকরা শরীরে সানক্রীম মেখে স্বল্পবসনায় রোদ্রস্নান করছে। কেউ রোদে গা এলিয়ে বইয়ের রাজ্যে হারিয়ে গেছে। সৈকতের কড়া রোদ, তপ্ত বালুর উত্তাপ থাকা সত্ত্বেও প্রকৃতি এখানে কোমল। আদ্রতার কারণেই হয়তো শরীরে চিটচিটে ঘাম হয়না। তাই রোদমাখামাখি করে শুয়ে থাকা যায় অনেকক্ষণ।



[লাঙ্কাউই সমুদ্রসৈকতে রোদ্রস্নানরত রমনীরা]
কিন্তু আমাদের সেই সুযোগ হলো না। বলা চলে একরকম দাবড়িয়েই ট্যুর গাইড আমাদের লাঙ্কাউই ক্যাবল কারে চড়াতে নিয়ে এলো।
ক্যাবল কারে চড়ার আগে আমাদেরকে একটা বদ্ধ ঘরে ঢুকিয়ে চোখে চশমা দিয়ে দিলো। সামনের ৩৬০ ডিগ্রী প‌্যানারামা স্ক্রীনে ততক্ষণে রোলার কোস্টার চড়াই উৎরাই পাড়ি দিচ্ছে। আমরা যে যার চেয়ারেই বসে আছি কিন্তু থ্রিডি মুভিটা এমনভাবে তৈরি যে মনে হয় আমরা রোলারকোস্টারে বসে আছি। আর কীসব ভয়ংকর বাক পারি দিচ্ছি! ১৮০ ডিগ্রী, ৩৬০ ডিগ্রী; কতরকমভাবেই না রোলার কোস্টার ডিগবাজি খাচ্ছে। উত্তেজনায় মাথার চুল খাড়া হয়ে যায়, বুকের ভিতর ডিবডিব করে। ভাগ্যিস, এই ভয়ংকর বাকগুলো থ্রিডি এ্যানিমেশন। তাতেই কলিজা শুকিয়ে কাঠ! আর সত্যিকারের এমন দুর্ধষ রোলারকোস্টার হলে হার্টফেল মাস্ট!
রোলার কোস্টারের মাথা ঘুরানো বাকের কারণেই হয়তো ক্যাবলকারটা খুব বেশি ভয়ংকর মনে হলো না। তবে যথেষ্ট চমকপ্রদ। ক্যাবলকারের তিনটি স্টেশন। বেসস্টেশন থেকে যাত্রা শুরু। একেকটা ক্যাবলকারে ছয়জন বসা যায়। সংক্রিয়ভাবে একটার পর আরেকটা ক্যাবলকার স্টেশনে এসে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য থামছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই ক্যাবলকারে উঠে যেতে হবে। কারণ নির্দিষ্ট সময় পরেই ক্যাবলকারের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। গুনে গুনে ছয়জনই ক্যাবলকারে চড়লাম। আমাদের নিয়ে ক্যাবলকারটা শুন্যে ভেসে ভেসে পাহাড়ের মাথায় উঠতে থাকলো। নিচে তাকালে ভয়ে গলাটা শুকিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। একটা তারের উপর আমরা ঝুলছি। পায়ের নিচে গভীর জঙ্গল। কোন কারণে তারটা ছিড়ে পড়লেই একদম সাত আসমানের উপর চলে যেতে হবে। বেস স্টেশন থেকে মিডিলস্টেশনের দূরত্ব ১৭০০ মিটার আর সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ৬৫০ মিটার উচ্চতায়। আর টপ স্টেশনটা সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ৭০৮ মিটার উচ্চতায়। আকাশ ছোয়া সীমানায়।





ক্যাবলকারে চড়ে লাঙ্কাউইএর একদম উচু পাহাড়টার উপর দাড়িয়ে নিজেকে এভারেস্ট জয়ী অভিযাত্রী মনে হয়! ইস, আরেকটু উপরে উঠলেই আকাশটা ছুতে পারতাম!


[আকাশের কাছাকাছি দাড়িয়ে ছবি না তুললে চলেই না।]
পাহাড়ের চুড়া থেকে নিচে লাঙ্কাউই দ্বীপকে ছবির মতোই সুন্দর দেখায়। আকাশের নীলের সাথে সমুদ্রের নীল মিশেছে। নীলের উপর ভাসমান সাদা ইয়ট, ছোট-বড় সবুজ দ্বীপ; অসাধারণ সুন্দর একটি ল্যান্ডস্কেপ।




[পাহাড়ের চুড়া থেকে অপরুপ লাঙ্কাউই দ্বীপের রুপ যেভাবে ক্যামেরায় বন্দি হয়]
শুধু আপসোস একটাই রয়ে গেল যে, স্কাইব্রীজে উঠতে পারলাম না। লাঙ্কাউই ক্যাবলকারের পাশেই স্কাইব্রীজ, যা এখন নির্মাণাধীন। একপাহাড়ের চুড়ার সাথে আর পাহাড়ের চুড়ার সেতুবন্ধন করছে এই স্কাইব্রীজ। দেখলেই লোভ লাগে, স্কাইব্রীজের উপরে দাড়ালে কেমন লাগবে কে জানে?


[নির্মানাধীণ স্কাইব্রীজ]
লাঙ্কাউই ক্যাবলকারটা আসলে একটা থিম পার্ক। চাইলে আর অর্থকড়ি খরচ করলে এখানে নির্মোল আনন্দ উপভোগের দারুন সব ব্যবস্থা আছে। মাত্র ১৫ রিঙ্গিটে সিক্সডি থিয়েটারে মুভি দেখলাম। ১৫ মিনিটের মুভি কিন্তু রেশ রয়ে যায় তারও বেশি সময়। চোখে থ্রিডি চশমা পড়ে, সিটবেল্টটা ভালো করে বেধে নিয়ে প্রথমবারের মতো উপভোগের প্রস্তুতি নিলাম। মুভির শুরুতেই আমাকে যুদ্ধের ময়দানে নামিয়ে দেওয়া হলো। চারিদিকে গোলাগোলির মাঝে ট্রেনে করে ভাঙা রেললাইনে চলতে থাকি। রেললাইন বাক নিলে আমার চেয়ারটাও বাক খায়। সিনেমাতে উচুনিচু রাস্তায় যখন রেলগাড়ীটা চলে তখন বাস্তবে আমাকেও ঝাকি হজম করতে হয়। যখন অগ্নিগহ্বরে পড়ে যেতে থাকি তখন জান প্রায় যায় যায়। আমি ভুলেই বসি যে, যুদ্ধের ময়দানে নয় আমি আসলে সিনেমার পর্দার সামনে বসে আছি। মুভির এক পর্যায়ে সিনেমায় পানি ছিটিয়ে দিলে সেই পানি বাস্তবে আমাকে ভিজিয়ে দেয়। শুধু গন্ধটা বাদে সিক্সডি সিনেমাতে সবগুলো ইন্দ্রিয় অনুভুতি অনুভুত হয়। ক্ষনিকের জন্য নিজেই সিনেমার সত্যিকারের চরিত্র বনে যাই।






পানির উপর বেশকিছু মজার রাইড আছে এখানে। আছে হরেক রকম খেলনা আর উপহারসামগ্রীর দোকান। প্রচুর ফাউন্টেন, কৃত্রিম ব্রীজ আছে। পর্যটকদের ফেসবুকে ছবি আপলোড করার জন্য প্রয়োজনীয় সবরকম উপাদানই এখানে আছে। শুধু বুদ্ধি করে ফাউন্টেনগুলোর সামনে দাড়িয়ে পোজ দিতে পারলেই হয়।


দিনের শেষভাগে ছিল প্যারাগ্লাইডিং। কোমরে প্যারাস্যুট বেধে আকাশে উড়া। বড় আগ্রহ নিয়েই প্যারাগ্লাইডিং করতে এসেছিলাম। কিন্তু প্যারাগ্লাইডিংয়ের খরচ শুনে দমে গেলাম। এর আগে থাইল্যান্ডের পাতায়াতে প্যারাগ্লাইডিং করেছি, সেই তুলনায় এখানে খরচটা অনেকবেশি। তাই প্যারাগ্লাইডিং না করে শান্ত হয়ে সূর্যাস্ত দেখতে বসে পড়লাম।



লাল সূর্যটা সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার আগেই মেঘ তাকে গ্রাস করলো। আকাশ জুড়ে লালচে আভা। সেই লালচে আভায় সমুদ্রের মাঝখান থেকে এক যুবক ও এক যুবতী ওঠে এলো। এতক্ষণ খেয়াল করিনি। এখন লক্ষ্য করলাম, একদল ভিনদেশী মানুষ মহিষের মতো গলাপানি জলে ডুবে সন্ধ্যাস্নান করছে। সেই দল থেকে ওঠে আসা পোশাকের সর্ব্বোচ্চ সংক্ষিপ্ত সংকরণ পরিহিত যুবতী যখন আমাদের নাকের ডগার উপর দিয়ে হেটে যায়, তখন বুকের ভিতর কোথায় যেন দমকা হাওয়া বয়!


[সূর্যডুবে যাবার পর সৈকতের পারের এক হোটেলর আলোকসজ্জা। দেখে মনে হচ্ছে আগুন লেগেছে}
দিনের আলো নিভতে নিভতে প্রায় রাত আট। রাতের খাবারের সময় হয়ে যায়। তাই দুই দলা খেয়েই সবাই শপিংয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। লাঙ্কাউইতে ডিউটি ফ্রি বেশ কিছু শপ আছে। এখানে তুলনামূলকভাবে কম দামে পছন্দের জিনিস কিনতে পারবেন। আর যাদের কেনাকাটার ঝামেলা নেই তারা মজে যেতে পারেন পার্টির আমেজে। লাইভ কনসার্ট, গিটারের টুংটাং, সোলো সবরকম মিউজিকের আয়োজনই এখানে আছে আর হরেকরকম রেস্টুরেন্টতো আছেই। সারাদিন ঘুরে খুব বেশি ক্লান্ত হয়ে গেলে ডুকে পড়তে পারেন কোন এক ম্যাসাজ পার্লারে। দেখবেন মুহুর্তের মধ্যে কিভাবে ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।
আমার লাঙ্কাউই ভ্রমণের গল্প (পর্ব-১)
আমার লাঙ্কাউই ভ্রমণের গল্প (পর্ব-২)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ২:৫৩
১০টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হেঁটে আসে বৈশাখ

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০০


বৈশাখ, বৈশাখের ঝড় ধূলিবালি
উঠন জুড়ে ঝলমল করছে;
মৌ মৌ ঘ্রান নাকের চারপাশ
তবু বৈশাখ কেনো জানি অহাহাকার-
কালমেঘ দেখে চমকে উঠি!
আজ বুঝি বৈশাখ আমাকে ছুঁয়ে যাবে-
অথচ বৈশাখের নিলাখেলা বুঝা বড় দায়
আজও বৈশাখ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছায়ানটের ‘বটমূল’ নামকরণ নিয়ে মৌলবাদীদের ব্যঙ্গোক্তি

লিখেছেন মিশু মিলন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



পহেলা বৈশাখ পালনের বিরোধীতাকারী কূপমণ্ডুক মৌলবাদীগোষ্ঠী তাদের ফেইসবুক পেইজগুলোতে এই ফটোকার্ডটি পোস্ট করে ব্যঙ্গোক্তি, হাসাহাসি করছে। কেন করছে? এতদিনে তারা উদঘাটন করতে পেরেছে রমনার যে বৃক্ষতলায় ছায়ানটের বর্ষবরণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বয়কটের সাথে ধর্মের সম্পর্কে নাই, আছে সম্পর্ক ব্যবসার।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৫০


ভারতীয় প্রোডাক্ট বয়কটটা আসলে মুখ্য না, তারা চায় সব প্রোডাক্ট বয়কট করে শুধু তাদের নতুন প্রোডাক্ট দিয়ে বাজার দখলে নিতে। তাই তারা দেশীয় প্রতিষ্ঠিত ড্রিংককেও বয়কট করছে। কোকাকোলা, সেভেন আপ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৭



কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।

এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×