দুর্নীতি শব্দটার সাথে আমাদের পরিচয়, সখ্যতা বেশ পুরনো। সখ্যতা বলেছি এ জন্য, আমরা তো দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব বহন করে চলছি এবং এর ধারাবাহিকতা রক্ষার যুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছি। আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে , শিরায় উপশিরায় দুর্নীতির কালোরক্ত প্রবাহিত। এদেশের কোথায় দুর্নীতি নেই? লজ্জার কথাই বটে, যাদেরকে দুর্নীতি দমনের দায়িত্ব দেয়া হয়, তারাও এর প্রভাবমুক্ত নন !
দুদক।
আমাদের স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন। কিন্তু এর চেয়ারম্যানের কণ্ঠে যখন শুনি, 'দুদক এখন দন্তহীন বাঘ' তখন আর কিছুই বুঝতে বাকী থাকেনা। ক্ষমতাসীনদের পদলেহন ছাড়া তার আর কাজ কী? তাছাড়া সরকারী এমপি, মন্ত্রী মহোদয়, কর্মকর্তা কর্মচারীরা দুর্নীতি করলেও দুদকের তো সেখানে হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। বরং তাদের সাফাই গাওয়া তার প্রথম ও প্রধানতম দায়িত্ব। এই যেমন, গত তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই সরকারের যেসব এমপি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হয়েছে, তা এখন সু-নীতিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। মামলা প্রত্যাহারের জন্য তালিকার পর তালিকা আসছে। এমনকি নিম্ন আদালতে সাজাপ্রাপ্তরাও এ তালিকার অন্তর্ভূক্ত। তবুও দুদক স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই !
তবে বিগত তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুদক 'স্বাধীনতার স্বাদ' পুরোপুরি আস্বাদন করতে সক্ষম হয়েছে। বেশ দাপটের সাথেই দায়িত্বপালন করেছেন দুদকের তৎকালীন চেয়ারম্যান লে. জেনারেল (অব) হাসান মশহুদ চৌধুরী। দেশ ও জাতির সংকটময় মূহুর্তে এমন একজন পূণ্যবান ব্যক্তিকে এ কমিশনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, যার ব্যক্তিগত জীবন দুর্নীতির নানা ইতিহাসে সমৃদ্ধ। তিনি বাড়ী বানিয়েছেন, যা জরিমানা দিয়ে বৈধ করার প্রয়োজন হয়েছিল পরবর্তী সময়ে। সেই বৈধতা প্রদানও কতটুকু বৈধ, তাও প্রশ্ন তোলার দাবি রাখে। তার ট্রাস্ট ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের বিষয়টি কে না জানে ?
দুঃখের বিষয় হলো, তিনি রাজনীতিবিদ দমনের এজেন্ডা নিয়ে গোয়েন্দা কার্যক্রম ও আইনজীবিদের পেছনে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা উড়িয়েছেন ঝরাপাতার মত। প্রধান বিচারপতির বেতনের চেয়েও বেশী বেতন পেয়ে ধন্য হয়েছেন দুদক'র আইনজীবিরা। আহ্, কত সুখ ! আমরা জানতে পেরেছি, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি অডিটর জেনারেলের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে হাসান মশহুদসহ শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন কর্মকর্তার কাছ থেকে বিধিবহির্ভূতভাবে ব্যয় করা ১৬ কোটি আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য।
এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে জাতি কাদের ওপর আস্থা রাখবে ? মূলত ব্যক্তি জীবনে নৈতিকতার বিকাশ সাধন ছাড়া কখনোই অপরাধ ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়া সম্ভব নয়। যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, গুরুত্বপূর্ণ সরকারী পদে অধিষ্ঠিত হন, নিঃসন্দেহে তারা শিক্ষিত ও বড় বড় ডিগ্রীর গৌরব বহন করেন। কিন্তু তারাই তো আবার দুর্নীতির অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছেন। তাহলে কি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা প্রকৃত মানুষ তৈরীতে অক্ষম ? হ্যাঁ, এ প্রশ্নটা তোলার উপযুক্ত সময় এখনই। তাছাড়া নতুন যে শিক্ষানীতির কথা এখন আলোচনার শীর্ষে, নৈতিকতা ও ধর্মবোধ যেখানে গৌণ, তাতো আরও বিপজ্জনক ভূমিকা পালন করবে, সন্দেহ নেই। এসব শিক্ষাব্যবস্থায় বড় বড় প্রফেসর, ডাক্তার , ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী তৈরী হতে পারে কিন্তু মানুষ তৈরী হতে পারেনা। বৈষয়িক শিক্ষার পাশাপাশি সমানহারে ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চাই জাতিকে এ অভিশাপ থেকে রেহাই পেতে পারে, যা পরীক্ষিত।
ইসলামের ইতিহাস থেকে ছোট্ট দুটি উদাহরণ দিতে চাই, যা দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের মডেল হতে পারে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষার উজ্জল দৃষ্টান্ত হিসেবে আমাদের বিবেকের পর্দায় ছায়া ফেলতে পারে। যেমন-
ক. চতুর্থ খলীফা আলী (রা) এর আপন ভাই একবার দাওয়াত করলেন তাকে। খাওয়ার সময় আকীলের স্ত্রী আড়াল থেকে বললেন তাদের অভাবের কথা। অনুরোধ করলেন তাদের সরকারী বেতন বাড়ানোর। আলী (রা) বললেন, অভাবের মাঝেও তোমরা আমাকে খাওয়ালে কী করে? জবাব এলো, প্রতিদিন একমুঠো আটা সঞ্চয় করে রাখি, তা দিয়েই...। আলী (রা) বললেন, তা হলে তো এ পরিমাণ আটা তোমাদের না হলেও চলে। এরপর থেকে আকীলের দৈনিক ভাতা থেকে একমুঠো আটা কমিয়ে দিলেন তিনি।
খ. ওমর বিন আবদুল আজীজ। রাতের বেলা আলো জ্বেলে সরকারী কাজে ব্যস্ত। এ সময়ই তার চাচাতো ভাই এলেন ব্যক্তিগত একটি বিষয়ে পরামর্শ করার জন্য। ওমর বিন আবদুল আজীজ আলো নিভিয়ে দিলেন আর বললেন, আমাদের পারিবারিক বিষয়ে কথা বলার জন্য সরকারী টাকায় কেনা তেল দিয়ে বাতি জ্বালিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
এমন হাজারো উদাহরণ পেশ করা যাবে। সেইসব সোনার মানুষেরা কোথায় পেলেন নৈতিকতার এ মহান শিক্ষা ? আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি ? সুন্দর , সমৃদ্ধ একটি বাংলাদেশ গড়ার জন্য এমনসব মানুষেরই প্রয়োজন আজ। আসুন আমরা ফিরে যাই সত্যের কাছে, শাশ্বত সুন্দরের কাছে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




