কুরআনুল কারীম নাযিলের পর থেকে রমজানের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য সম্পর্কে যত আলোচনা পর্যালোচনা, গবেষণা, রচনা কিংবা প্রকাশনা কর্ম সম্পাদিত হয়েছে তা একত্রিত করলে আমার মনে হয় কয়েক মিলিয়ন পৃষ্ঠার কলরবে পরিণত হবে। তারপরও এ নিবন্ধে এ বিষয়ে দু'চারটি কথা ও কিছু বিক্ষিপ্ত ভাবনা ব্যক্ত করার আশা করছি ইনশায়াল্লাহ।
চলুন আমরা একটু পবিত্র কুরআনের সে ঘোষণার দিকে ফিরে যাই যার মাধ্যমে আমরা রোযার বিধান লাভ করেছি। এরশাদ হচ্ছে ‘‘ওহে যারা ঈমানের ঘোষণা দিচ্ছ (শোন) তোমাদের প্রতি রোযা ফরয করা হল, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, উদ্দেশ্য এই যে, তোমরা যেন তাকওয়ার শিক্ষা লাভ করতে পার। হাতে গণা কিছুদিন মাত্র। তবে তোমাদের মধ্যে যারা রুগ্ন কিংবা সফবের অবস্থায় থাকবে তাদের জন্য পরবর্তী সময়ে এ সংখ্যা পূর্ণ করে দেয়ার অবকাশ থাকল। আর যাদের রোযা রাখার দৈহিক সামর্থ নিঃশেষিত হয়ে এসেছে, তাদের জন্য প্রতি রোযার বিনিময়ে একজন মিসকীনের খাবার দানের ব্যবস্থা রাখা হলো। তবে কেউ অতিরিক্ত কিছু কল্যাণকর্ম সম্পাদন করলে তা হবে তার পক্ষে উপকারী আর তোমরা রোযা রাখতে পারলেই তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর যদি তোমরা জানতে পার। রমজান মাস হলো এমন একটি সময় যার মধ্যে অবতীর্ণ হয়েছে কুরআনুল কারীম। মানবগোষ্ঠিকে হেদায়েতের সন্ধান দানের উদ্দেশ্যে, আর যা নাকি হেদায়েতে'র সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী সম্বলিত এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য বিধায়ক’’। অতএব, তোমাদের যে কেউ রমযান মাসটি প্রাপ্ত হবে সে যেন তাতে অবশ্যই রোযা রাখে। (সুরা আল-বাকারা : ১৮৩-১৮৫)
আমি মনে করি রমযানের তাৎপর্য ও উদ্দেশ্যকে যথাযথ উপলব্ধি করার জন্য প্রধানতম উৎস হচ্ছে কুরআনের এ ঘোষণা। রোযার বিধান সংক্রান্ত ঘোষণায় আরেকটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে একই ঘোষণায় কোন বিশেষ অবস্থায় কার জন্য সাময়িক কিংবা চূড়ান্তভাবে ছাড় দেয়া হল সে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে, যা সাধারণত অন্যান্য বিধানের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। দেখা যাচ্ছে যে, ইহা এমন একটি বিধান যা মূলত পূর্ববর্তী প্রত্যেক নবীর উম্মতের উপরও ফরজ ছিল। হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে হযরত ঈসা (আঃ) এর যামানা পর্যন্ত সকল যুগের মানুষকে বুঝানো হয়েছে। নির্ধারিত একক কোন নবীর উম্মতের উপর নয়। যেমন : হযরত আদম (আঃ) এর উপর প্রতি চাঁদের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা ফরজ ছিল। হযরত নূহ (আঃ) দুই ঈদের দিন ছাড়া সর্বদা রোযা রাখতেন। দাউদ (আঃ) একদিন রোযা রাখতেন আর একদিন বাদ দিতেন। এভাবে পুরা বছরে রোযা রাখতেন দুই ঈদের দিন ব্যতীত। হযরত মুসা (আঃ) এর উম্মত আশুরার রোযা ফরজ হিসেবে রাখতেন। হযরত ঈসা (আঃ) একদিন রোযা রাখতেন, পরবর্তী দু'দিন বিরত থাকতেন। আবার একদিন রোযা রাখতেন এভাবে রোযা চালিয়ে যেতেন। আসলে বিশ্বের প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী জাতিই কোন না কোনভাবে রোযাকে তাদের ধর্মের একটি অপরিহার্য অংগরূপে গণ্য করে থাকে। যেমন খৃস্ট ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে পাদ্রীদেরকে বিভিন্ন উপলক্ষে উপবাসব্রত পালন করতে হয়। কেহ কেহ বলেন- ইহুদীদের উপর মহররম মাসের প্রথম দশদিন রোযা ফরয ছিল। কেননা ঐ দিনগুলোতে হযরত মুসা (আঃ) তুর পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থান করে, তৌরাতের বিধানাবলী লাভ করেছিলেন। আরো বর্ণিত আছে ইহুদীদের মাঝে বছরে পাঁচটি উপবাস দিন আছে। একটি উপবাসের দিন হল গৃহে প্রথম সন্তান জন্মগ্রহণের দিন। আরেকটি উপবাস দিন হলো বিবাহের পর দিন নব-দম্পতির উপবাস পালন। নতুন জীবনের জন্য নব-দম্পতিকে প্রস্তুত করতে এ উপবাস পালন করা হয়। এ ছাড়া ব্যাবিলনীয়দের হাতে প্রথম মন্দির ধ্বংস হওয়ার দিন এবং রোমানদের হাতে দ্বিতীয় মন্দির ধ্বংস হওয়ার দিন ও তারা রোযা বা উপবাস পালন করে থাকে। তবে কেবলমাত্র ইয়ুম কিপুরের উপবাসই আল্লাহর নির্দেশে পালন করা হত। বস্তুত ইয়ুম কিপুর হল ইয়াহুদীদের সপ্তম মাসের দশম দিন যা মুসলমানদের মহররম মাসের দশম দিন। আসলে খৃস্টানদের উপরও রমযানের রোযা ফরয ছিল। কিন্তু গ্রীষ্মের দিনে রোযা রাখা দুষ্কর মনে করে তারা গ্রীষ্মের পরিবর্তে বসন্তকালে নিজেদের খেয়াল-খুশীমত রোযা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং ৩০ এর পরিবর্তে ৪০টি রোযা নির্ধারণ করেছিল। অন্য একটি বর্ণনাতে পাওয়া যায়, খৃস্টানরা বছরে ৫০ দিন রোযা বা উপবাসব্রত পালন করতো (ফালসাফা এ রোযা)।
ইহুদীদের রোযার একটি বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, ওরা যত দেরিতে রোযা ভাংত ততই উত্তম ছিল এবং এ রোযা ভাংগার পর চোখে ঘুম এসে পড়লে পরে কোন পানাহার গ্রহন বৈধ ছিল না। তদুপরি রোযা পালনের দিনগুলোতে রাত্রি বেলায়ও স্ত্রী সহবাস ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। হিন্দুরা বছরের একটি বিশেষ সময়ে দু'দিনব্যাপী উপবাসব্রত পালন করে থাকে এবং বৌদ্ধদের মধ্যে ভিক্ষু সম্প্রদায়কে প্রতিদিন দ্বিপ্রহর থেকে নিয়ে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়মিত উপবাস করতে হয়। অবশ্য হিন্দু ও বৌদ্ধরা তাদের উপবাস ব্রত পালন প্রথাকে নানাভাবে শিথিল করে দিয়েছে। এ কথা বুঝা গেল বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মে শর্ত বিকৃতির পরেও যে কিছু নবী-রাসূলদের মৌলিক শিক্ষার স্মৃতি চিহ্ন মুছে ফেলতে পারেনি, রোযা হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম।
রোযার উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য
এ প্রবন্ধে আমি রোযার উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি। রোযার আসল উদ্দেশ্য আল্লাহ বলে দিয়েছেন তথা তাকওয়ার শিক্ষা গ্রহণ করা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাকওয়া কি? বস্তুত তাকওয়া হচ্ছে এমন একটি গুণ যা না থাকলে কোন ব্যক্তি হেদায়েতের পথে অগ্রসর হতে পারে না। যেমন এরশাদ হচ্ছে ‘‘ইহা হচ্ছে এমন কিতাব যাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই ইহা তাকওয়ার গুণ বিশিষ্ট লোকদের জন্য হেদায়েত। (আল-বাকারা ১-২)।
ইহা এমন একটি গুণ যা না হলে কোন লোক হেদায়েতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে না। এ প্রসঙ্গে এরশাদ হচ্ছে যদি তোমরা ধৈর্যের পরিচয় দাও এবং তাকওয়া অবলম্বন করতে থাক তাহলে ইহা হবে এক দৃঢ় সংকল্পের ব্যাপার। (আল-ইমরান ১৮৬)
রোযার মাধ্যমে অন্ততঃ
পক্ষে তাকওয়ার দুটি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করা যায়।
এক :
তাকওয়া হচ্ছে এমন একটি অনুভূতি যা দ্বারা মানুষ উপলব্ধি করতে শিখে যে, সে নিজেকে সদা আল্লাহর সম্মুখে উপস্থিত দেখতে পায়।
ফলে এমন সব কাজ থেকে বিরত থাকে যা আল্লাহর অবাধ্যতার পর্যায়ে পড়ে। বস্তুত রোযার মাধ্যমে এ অনুভুতির যে শিক্ষা মানুষ লাভ করতে পারে তার কোন তুলনা নেই। যেমন- কেউ রোযার নিয়ত করার পর যদি তৃষ্ণায় তার বুকের ছাতি ফেটে যায় কিংবা ক্ষিদের তাড়নায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়ে আর কোন নির্জন স্থানে সে সুস্বাদু খাবার কিংবা ঠান্ডা উপাদেয় পানীয় ও হাতের নাগালে প্রাপ্ত হয় তবুও সে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না। যে জিনিসটি তাকে এ কাজ থেকে বিরত রাখে তাকেই বলা হয় তাকওয়া।
দুই :
তাকওয়া হচ্ছে এমন একটি বস্তু যা বান্দার অন্তরে এ বিশ্বাস জন্মায় যে ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে হালাল ও হারামের যে ফিরিস্তি আমাদের পরিচিত তাই হালাল বা হারাম নয় বরং আল্লাহ যখন যে বস্তুকে যেভাবে হালাল বা হারাম বলেছেন তাই হচ্ছে হালাল হারামের প্রকৃত মাপকাঠি। রোযা অবস্থায় রোযাদারের জন্য এমন সব বস্তু হারাম হয়ে যায় যা মূলত তার জন্য বৈধ ছিল। যেমন সাধারণ পানাহার ও বৈধ স্ত্রীর সাথে মিলন ইত্যাদি। ইসলাম সাধনার মাধ্যমে একজন বৃত্তশালী ক্ষুধার যন্ত্রণা অনুধাবন করতে পারে। ফলে তার মাঝে গরীবের প্রতি সহানুভূতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হয়।
রোযার উদ্দেশ্যে বর্ণনা করে ইমাম গাজযালী (রাঃ) বলেন, ‘‘আখলাকে ইলাহী তথা ঐশ্বরিক গুণে মানুষকে গুনান্বিত করাই সিয়ামের উদ্দেশ্য। সিয়াম মানুষকে অনুকরণে যতদূর সম্ভব প্রবৃত্তির গোলামী, তথা মন চাহিজিন্দেগী থেকে মুক্ত হওয়ার শিক্ষা দেয়। আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম বলেন, রোযার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে তার পাশবিক ইচ্ছা ও জৈবিক অভ্যাস থেকে মুক্ত করা এবং জৈবিক চাহিদাসমূহের মধ্যে সুস্থতা প্রতিষ্ঠিত করা, সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ আত্মশুদ্ধি ও পবিত্রতা অর্জন করে। পশুত্ব নিস্তেজ হয়ে মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয়। রোযা মানুষের শারীরিক ও আত্মীক শক্তির উন্নতি সাধন করে। কলবের ইসলাহ ও চরিত্র সংশোধনের ক্ষেত্রে সিয়াম কার্যকর ভূমিকা পালন করে। (যাদুল মাআদ ১ম খন্ড- ১৫২ পৃষ্ঠা) প্রকৃতপক্ষে এ মাসের রোযা ফরয করা হয়েছে বলে, এ মাসের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে, বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। বরং এ মাসে পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হওয়া শুরু হয়েছে বলেই কুরআনের সম্মানে এ মাসে রোযা ফরয করা হয়েছে। পবিত্র কুরআন ও রোযার এই গভীর সম্পর্কের কারণে মহানবী (রাঃ) রমযান মাসে কুরআন তিলাওয়াতে বিশেষভাবে যত্নশীল হতেন। হযরত ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সমস্ত মানবকূলের মধ্যে সর্বাধিক উদার, মহৎ ও দানশীল ছিলেন কিন্তু রমযান মাসে যখন জিব্রাঈল তার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসতেন তখন তাঁর উদারতা, মহত্ব ও দানশীলতার মাত্রা অত্যধিক পরিমাণে বেড়ে যেত। উল্লেখ্য যে, হযরত জিবরাঈল (আঃ) রমযানের প্রত্যেক রাতেই মহানবী (সাঃ)-এর সহিত সাক্ষাৎ করতেন এবং কুরআন মাজীদের দাওর (পুনরালোচনা) করতেন। (বুখারী ও মুসলিম)।
রোযার তাৎপর্য সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই ঘোষণা দিয়েছেন যে, যেহেতু রমযান মাসকে সমগ্র মানব জাতির জন্য হেদায়েতের বিধান প্রদানের মাস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাই মুসলিম মিল্লাত যারা হেদায়েতের সর্বশেষ কিতাব কুরআনের ধারক ও বাহক তাদের উচিত তারা যেন প্রতিবছর এ রমযান মাসকে মাসব্যাপী সিয়াম সাধনা ও ইবাদতের নানাবিধ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদযাপন করে।
মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত একটি হাদিস থেকে জানা যায়, হযরত নুহ (আঃ) থেকে ঈসা (আঃ) পর্যন্ত প্রায় সকল নবী রাসূলই এ মাসে আল্লাহর কিতাব কিংবা ছহিফা লাভ করেছিলেন। তবে হযরত মুসা (আঃ) মহররম মাসের প্রথম দশদিন তাওরাত প্রাপ্ত হয়েছিলেন বলে উল্লেখ আছে।
কুরআনুল কারীম যদিও ২৩ বছরের সুদীর্ঘ সময়ে অবতীর্ণ হয়েছিল কিন্তু তা অবতরণের সূচনা হয় কদরের রাত্রিতেই। তাছাড়া ছহীহ হাদিসে বর্ণিত আছে যে, প্রতি বছর রমযান মাসে হযরত জিব্রাঈল (আঃ) নবীজীকে পুরো কুরআন পাঠ করে শোনাতেন।
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি স্তম্ভ রোযা তা রমযান মাসে ফরয করা হয়েছে। রমযান মাস অন্যান্য মাসের মধ্যে অত্যন্ত মর্যাদাবান। সুতরাং মুসলমানদের উচিত কুরআন নাযিলের এ মাসে বেশি করে কুরআন তেলাওয়াত করা ও কুরআন সম্পর্কে গবেষণা করা। কেননা কুরআন তার তেলাওয়াতকারীর জন্য কেয়ামতের ময়দানে সুপারিশ করবে। প্রিয় নবী (সাঃ) এ মাসে বেশি করে দান সাদকা করতেন। তার উম্মত হিসাবে আমাদেরও উচিত এ মাসে উদার হস্তে গরীব মিসকিনদের জন্য দানের হাত প্রসারিত করা, অভাবী মানুষের জন্য সাহরী ও ইফতারের ব্যবস্থা করা। রমযানের এই মাসটি মুসলমানদের নিকট অত্যন্ত কল্যাণ ও ইবাদত বন্দেগীর মাস। আল্লাহ
প্রেমের নিদর্শন ;
রোযার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ লাভ করে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘রোযা একমাত্র আমার জন্যই, আমি উহার প্রতিদান নিজ হাতে দিব।
রিয়ামুক্ত ইবাদত :
অন্যান্য ইবাদতের মত রোযার মধ্যে লোক দেখানোর কোন সুযোগ নেই। কারণ আমাদের রোযার সাক্ষী একমাত্র আল্লাহ।
প্রতীক বিকাশ সাধনে রোযা :
রোযাদার ব্যক্তি সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণে রাখে। রোযা অন্যায় ও অমঙ্গল কাজ থেকে বিরত রাখে। একটি আদর্শ সমাজ গঠনে সহায়তা করে।
ধৈর্য্য ধারণের শক্তি যোগায় :
মহানবী (সাঃ) বলেন, রমযান ধৈর্য্যের মাস। আর ধৈর্য্যের প্রতিদান জান্নাত।
রোযা ঢাল স্বরূপ :
কাম, ক্রোধ, লোভ, লালসা ইত্যাদি রিপুর তাড়নায় মানুষ বিপথগামী হয়ে ধ্বংসের মুখোমুখি হয়। রোযা মানুষের এ সকল কু-প্রবৃত্তি দমনের ঢালস্বরূপ।
রোযা মুক্তি উপায় :
কিয়ামতের কঠিন মুহূর্তে রোযা বান্দার মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে।
চরিত্র গঠনে সহায়ক :
সিয়াম সাধনায় মানব মনে খোদাভীতি জাগ্রত করে। সংযম ও আত্মশুদ্ধিতে উদ্বুদ্ধ করে এবং মানুষকে কঠিন সাধনায় অভ্যস্ত করে চারিত্রিক দৃঢ়তায় উপনীত করে।
রমযানের রোযার তাৎপর্য ও ফযীলত সম্পর্কে মহানবী (সাঃ)-এর কতগুলো হাদীস এ অংশে উল্লেখ করলাম :
(১) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন, যখন রমযান মাস আসে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং দোযখের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয়। আর শয়তানকে শৃক্মখলিত করা হয়। অপর এক বর্ণনায় আছে, রহমতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় (বুখারী ও মুসলিম) উল্লেখিত হাদীসে আসমানের দরজা খোলা বলতে রহমত বর্ষণ করা জান্নাতের দরজা খোলা বলতে নেক কাজ করার তৌফিক প্রদান করা এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করা বলতে রোযাদারদের আত্মাসমূহকে শয়তানের যাবতীয় প্ররোচনা মুক্ত রাখার ব্যাপারে ইঙ্গিত করা হয়েছে। জান্নাতের দরজা খোলা বলতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, মুমিন গণসুখ শান্তিতে এ মাস কাটাবে এবং আল্লাহ পাক রোযাদারদের মন ও ধন-দৌলত প্রশস্ত করে দিবেন, যাতে তারা দান সাদকার মাধ্যমে জান্নাতের পথ সুগম করতে পারে। জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, রোযাদারের নফসকে অশ্লীল ও বেহুদা কর্ম হতে এবং নফসে আম্মারার ধোঁকা থেকে রক্ষা করে যাতে জান্নাতে যাওয়ার পথ সুগম করতে পারে। (হাশিয়ায়ে মিশকাত ১ ঃ ১৭৩পৃ
(২) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন, জান্নাতের দরজাসমূহের মধ্যে একটি দরজা হলো ‘‘বাবুরাইয়ান’’) এই দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন রোযদার ব্যতিত অন্য কেহ প্রবেশ করতে পারবে না। অতঃপর আহবান করা হবে কোথায় এ ব্যক্তি যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রোযা রাখতো। এ আহবান শুনে রোযাদার ব্যক্তি জান্নাতের এ দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে এবং প্রবেশের পর ঐ দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। আর কেউ তাতে প্রবেশ করতে পারবে না। (বুখারী ১ ঃ ২৫৪), (৩) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন, আদম সন্তানের নেক আমলের সাওয়াবকে দশগুণ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়ে থাকে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, রোযা ব্যতীত, কেননা রোযা আমারই জন্য এবং আমিই উহার প্রতিদান প্রদান করব। সে আমাকে সন্তুষ্ট করার জন্যই আপন প্রবৃত্তি ও খানাপিনা বর্জন করে। রোযাদারের জন্য দু'টি আনন্দ রয়েছে একটি তার ইফতারের সময় এবং অপরটি বেহেশতে প্রভুর সাক্ষাৎ লাভের সময়। নিশ্চয়ই রোযাদারের মুখের ঘ্রাণ আল্লাহ তায়ালার নিকট মেশকের সুগন্ধ হতেও অধিক সুগন্ধময়। রোযা হলো দোযখের আগুন হতে রক্ষার ঢালস্বরূপ। সুতরাং যখন তোমাদের কারো রোযার দিন আসে সে যেন অশ্লীল কথা না বলে এবং অনর্থক শোর গোল না করে। যদি কেহ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে ঝগড়া করতে চায়, সে যেন বলে দেয়, আমি রোযাদার (মিশকাত-১৭৩ পৃষ্ঠা)।
রোযা ঢালস্বরূপ :
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী ক্বারী (র.) বলেন, রোযা রোযাদার ব্যক্তির জন্য অপরাধ থেকে রক্ষাকারী এবং পরকালে দোযখের আগুন থেকে রক্ষাকারী দুর্গস্বরূপ (মিরকাত ৪র্থ খন্ড)। (৪) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি (রোযা রেখে) মিথ্যা কথা ও অশ্লীল কার্যাবলী ছাড়েনি, তার খানাপিনা ছাড়াতে আল্লাহ তায়ালার কোন প্রয়োজন নেই। (বুখারী), মিশকাত-১৭৬ পৃষ্ঠা) (৫) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, কিয়ামতের পর আরশের নীচে দস্তরখান বিছানো হবে এবং একদল লোক এসে ঐ দস্তরখানে বসে খানা খাবে। মানুষ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে এবং বলবে, হায়। আমরা এখনো হাশরের ময়দানে হিসাব নিকাশে ব্যস্ত আর তারা খানা খাচ্ছে আনন্দ করছে এরা কারা? উত্তর বলা হবে এরা এ সমস্ত লোক যারা দুনিয়ার জীবনে আল্লাহর হুকুম পালন করতঃ রোযা রেখেছিল আর তোমরা রোযা রাখনি। ৬. হযরত সালমান ফারেসী রা. বলেন, প্রিয় নবী সা. শাবান মাসের শেষ দিন আমাদেরকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, হে আল্লাহর বান্দাগণ, তোমাদের প্রতি এক বিরাট, মুবারক মাস এসে ছায়া বিস্তার করেছে। এ মাসে এমন একটি রাত আছে যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ মাসে আল্লাহতায়ালা রোযা ফরয করেছেন এবং রাতে জাগরণ (তারাবীহের নামায) সুন্নাত ঘোষণা করেছেন। যে ব্যক্তি এ মাসে কোন নেক আমল (নফল এবাদাত) দ্বারা আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভ করল যে মর্যাদার ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে অন্যমাসে কোন ফরয আদায় করল। আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরয আদায় করল সে যেন অন্য মাসে ৭০টি ফরয আদায় করল। এ মাস সংযমের মাস এবং সংযমের পুরস্কার হলো জান্নাত। এ মাস পারস্পরিক সমবেদনা ও সহানুভূতি জ্ঞাপনের মাস। এ মাসে মুমিন বান্দার রিযিক বৃদ্ধি করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি একজন রোযাদারকে ইফতার করাবে তার (ছগীরা) গুণাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে এবং দোজখের আগুন থেকে সে নাজাত পাবে। আর যেন এ রোযাদার ব্যক্তির রোযার সমপরিমাণ ছাওয়াব প্রাপ্ত হবে। কিন্তু রোযাদার ব্যক্তির ছাওয়াবের কোন কমতি হবে না। ইহা শুনে আমরা আরয করলাম ইয়া রাসূলুল্লাহ সা. রোযাদারকে ইফতার করানোর সামর্থতো আমাদের সকলের নেই। তিনি বললেন আল্লাহ তায়ালা এ ছওয়াব এ ব্যক্তিকে দান করবেন, যে ব্যক্তি রোযাদারকে সামান্য পরিমাণ দুধ অথবা একটি খেজুর কিংবা শুধু এক পেয়ালা পানি দ্বারা ইফতার করাবে। আর যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে তৃপ্তি সহকারে খাওয়াবে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিবসে তাকে, আমার হাউজে কাউসার থেকে এমন সরবত পান করাবেন যে, সে বেহেশতে প্রবেশ পর্যন্ত আর পিপাসার্ত হবে না। এ মাসের প্রথম ভাগ আল্লাহর রহমতের মধ্যভাগ মাগফিরাতের এবং শেষভাগ জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এ মাসে যারা দাসদাসীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করবে অর্থাৎ তাদের কাজের বোঝা হালকা করে দিবে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দিবেন এবং জাহান্নাম থেকে নাজাত করে দিবেন। (বায়াহাকী শরীফ) ৭. রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, যদি কেউ শরঈ ওজর তথা অসুস্থ না থাকার পরেও রমজানের কোন একটি রোযা না রাখে তবে জীবনভর রোযা রাখলেও তার বদলা আদায় হবে না। (মিসকাত শরীফ) ৮. রাসূলুল্লাহ সা. বলেন যে ব্যক্তি ঈমান ও আত্মসমালোচনার সাথে রমজান মাসে রোযা রাখবে তার পূর্বেকার গুনাহখাতা মাফ করে দেয়া হবে (বুখারী শরীফ) ৯. প্রিয় নবী সা. বলেন কেয়ামতের দিন রোযা এবং কুরআন আল্লাহর নিকট বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে হে আমার প্রতিপালক এ ব্যক্তিকে দিনের বেলায় পানাহার স্ত্রী সহবাস ইত্যাদি কাজ থেকে আমি রোযা নিবৃত রেখেছি সুতরাং আপনি আমার পক্ষ থেকে তার জন্য সুপারিশ গ্রহণ করুন। কুরআন বলবে এ আমার প্রতিপালক এ ব্যক্তিকে রাত্রিবেলায় জাগরণ রেখে আমি কুরআন তিলাওয়াতে মগ্ন রেখেছি। কাজেই আমার পক্ষ থেকে তার জন্য সুপারিশ কবুল করুন অর্থাৎ তাকে ক্ষমা করে দিন (মিসকাত শরীফ) হযরত আয়শা রা. বলেন, রমজান মাস এলে নবীজীর মোবারক চেহারার রং বিবর্ণ হয়ে যেত। বেশি বেশি করে নামায আদায় করতেন, অপূর্ব বিনয় ও নম্রতার সঙ্গে দোয়া করতেন।
মুসলমানরা যদি রমজানের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য সম্পর্কে যথাযথ অবগত হয়ে আল্লাহ এবং তার রাসূল সা.-এর নির্দেশিত পন্থায় সিয়াম সাধনায় ব্রতী হয় তবে অবশ্যই তাদের সমাজে রোযার সুফল দেখা দিবে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। আমিন।
সূত্র:
আরবি প্রভাষক, কড়িহাটি ফাযিল মাদরাসা
চাটখিল, নোয়াখালী
মোবাইল : ০১৭২৭৮১১৬৯২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




