যানজট মেগাসিটি ঢাকার মানুষের কাছে মরণঘাতী এইডসের মতোই এক ভয়াবহ আতংকের নাম। এইডসের ছোবলে যেমন মৃত্যু নিশ্চিত তেমনি দুর্বিষহ হয়ে ওঠা যানজটও দিন দিন মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে নগরবাসীর যাপিত জীবনকে। যানজটে আটকে থাকায় নষ্ট হচ্ছে শ্রমঘণ্টা। বাড়তি জ্বালানি পোড়াতে হচ্ছে। দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। কি অলিগলি, কি রাজপথÑ যানজটের কবল থেকে মুক্তি নেই কোথাও। এক কথায় রাজধানীর বাসিন্দাদের জীবনে মরণফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে যানজট। যতই দিন যাচ্ছে যানজট যেন ততই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। আগে সাপ্তাহিত ছুটির দিন পথচলায় কিছুটা স্বস্তি মিললেও এখন আর সে অবস্থা নেই। যানজট লেগেই আছে। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, মন্ত্রণালয়, পুলিশ প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের নানা আশ্বাস আর উদ্যোগ নিস্ফল প্রমাণিত করে দিয়ে দিন দিন ঢাকা মহানগরীতে যানজট বেড়েই চলেছে।
যানজট নিরসনে নেয়া প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নেও জট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রযন্ত্রের নানা উদ্যোগ সাধারণ মানুষের কাছে ফানুসে পরিণত হয়েছে। বরং রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, ফুটপাত বেদখল, নতুন-পুরনো যানবাহনের আধিক্য, রিকশার উৎপাত, পার্কিং ব্যবস্থা না রেখেই প্রধান প্রধান সড়কের দু’ধারে গড়ে ওঠা বহুতল বাণিজ্যিক ভবন, ম্যানুয়াল সিস্টেমের ট্রাফিকিং ব্যবস্থা, যত্রতত্র বাস স্টপেজ যানজটের মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। পরিস্থিতি নগরবাসীর কাছে দিন দিন অসহনীয় হয়ে উঠলেও এ থেকে উত্তরণের কোন কার্যকর উদ্যোগ নেই। সময়মতো কর্মস্থালে পৌঁছানো, স্কুল-কলেজে যাওয়া, প্রয়োজনীয় কেনাকাটা কিংবা অন্য কোন অনুষঙ্গে কেউই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছেন না। যানজট থামিয়ে দিচ্ছে, পিছিয়ে দিচ্ছে। সবার একটাই চিন্তা, কবে মুক্তি মিলবে যানজটের অভিশাপ থেকে। নাকি আদৌ মিলবে না। নাকি এ যানজটকে মুখ বুজে সহ্য করতে হবে অনন্তকাল। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকার ব্যস্ততম মতিঝিলের অফিসপাড়ার ৯৫ শতাংশ ভবনেই গাড়ি রাখার ব্যবস্থা নেই। কার পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই পুরান ঢাকার প্রায় ৪০ শতাংশ আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে। আরেক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নগরীর বুক চিরে বয়ে যাওয়া প্রায় ২০টি রেলক্রসিং রাস্তা দিয়ে যাতায়াতকারীদের প্রতিদিন গড়ে ছয় ঘণ্টা সময় নষ্ট করছে। যত্রতত্র কার-বাস স্টপেজের কারণে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে বসে থাকতে হচ্ছে গড়ে আরও আধা ঘণ্টা। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ ভিভিআইপিদের চলাফেরার কারণে রাস্তায় প্রতিদিন গড়ে এক ঘণ্টা নষ্ট করতে হয়। এর সঙ্গে আছে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, ট্রাফিক পুলিশের বেপরোয়া ও প্রকাশ্য চাঁদাবাজি, নামেমাত্র মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, নিত্যনৈমিত্তিক সড়ক দুর্ঘটনা আর ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনগুলোর রাস্তার উপরই অচল হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকার দুঃসহ যন্ত্রণা। অভিযোগ রয়েছে, রাজধানীর যানজট সমস্যা সমাধানে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের নেয়া বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে আরেক জট সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে জনসাধারণের দুর্ভোগ বাড়ছে বৈ কমছে না। এক্সপ্রেসওয়েকে যানজট নিরসনে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের নতুন প্রকল্প এলিভেটেড সমন্বয়হীন পরিকল্পনা হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ২০০১ সালে অনুমোদিত মনোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে যেখানে ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে তিন বছরেই পুরো নগরীর যানজট নিরসন সম্ভব, সেখানে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ৬০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে ২০ বছরে অর্ধেক যানজট নিরসনের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তাই নতুন এই প্রকল্পকে অনেকে টাকা লোপাটের উদ্যোগ বলে আখ্যায়িত করছেন। এ কারণে যানজট নিয়ে ঢাকার নাগরিক ভোগান্তি আরও বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় নতুন প্রকল্প পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। অথচ এর আগে ২০০১ সালে মাত্র সাত হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পুরো ঢাকার যানজট নিরসনের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছিল সরকার। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটির অনুমোদনও দিয়েছিলেন। এরপর জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওই প্রকল্পের অগ্রগতি থেমে যায়। আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এলেও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ২০০১ সালের প্রকল্পটি আমলে না নিয়ে নতুন প্রকল্প হাতে নেয়। ২০০১ সালে ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসনে মনোরেল প্রকল্প অনুমোদন হয়েছিল। ওই প্রকল্পে যানজট সমস্যার সমাধান থাকলেও লুটপাটের তেমন সুযোগ ছিল না। তাই ওই প্রকল্প বাস্তবায়িত না করে নতুন প্রকল্প নেয়া হয়েছে বলে অনেকের অভিযোগ। ওই সময় ৫১ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি মনোরেলের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন অনেক বেশি বাজেটে সমন্বয়হীন প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে এমআরটি-৬ নামে নেয়া মেট্রো রেলের পরিকল্পনা মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের অ্যালাইনমেন্টের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে গেছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের অনেক প্রকল্প এখন সাংঘর্ষিক অবস্থায় রয়েছে। ফলে টাকা খরচ করেও যানজট কমার কোন সুখবর নগরবাসীকে উপহার দেয়া সম্ভব হবে না। অভিযোগ রয়েছে, এরকম অসংখ্য অপরিকল্পিত উদ্যোগ যানজট সমস্যার সমাধান না করে উল্টো এ সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ছুটির দিনেও তীব্র যানজট : এদিকে শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়। দায়িত্বহীন ও বিশৃংখলভাবে গাড়ি চালনার জন্য পুরো ১০০ কিলোমিটার রাস্তাতেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাজার হাজার যানবাহন আটকে থাকে। এ কারণে হাজার হাজার যাত্রীকে মারাÍক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বে অবহেলা এবং গাড়িচালকদের খামখেয়ালিপনা ও ফ্রি-স্টাইলের কারণে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের নাটিয়াপাড়া, কালিয়াকৈর, চন্দ্রা মোড়, শ্রীপুর ও বলিভদ্র বাসস্ট্যান্ড, ইপিজেড, বাইপাইল মোড়, আশুলিয়া ব্রিজ, নরসিংহপুর বাসস্ট্যান্ড এবং উত্তরা আজমপুরসহ প্রতিটি মোড়েই ছিল দুঃসহ যানজট। গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনগুলোতে যেসব ট্রাফিক ও পুলিশ দায়িত্বে থাকে তারা যানজট নিরসন বা বিশৃংখল গাড়িকে সুশৃংখল করার পরিবর্তে তাদের প্রধান লক্ষ্য থাকে মালবোঝাই ট্রাক ও মাইক্রোবাস আটক করে তল্লাশির নামে টাকা আদায় করার দিকে। ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট নিরসনে মূলত পুলিশের ভূমিকা থাকে খুবই নগণ্য। তাছাড়া যাত্রীবাহী লোকাল বাসগুলো যত্রতত্র রাস্তার মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে ফ্রি-স্টাইলে যাত্রী উঠানামা করলেও দেখার কেউ নেই। এসব রুটে চলাচলকারী লোকাল বাস, টেম্পো ও অন্যান্য যাত্রী পরিবহনের যানবাহনগুলো পুরনো, লক্কড়-ঝক্কড় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে হেলপার গাড়ি চালালেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও কেউ নেই। পুলিশ সর্বত্র উদাসীন।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুলাই, ২০১১ সকাল ৯:৩০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




