এটা আর নতুন করে কিছু বলার নেই যে গত কয়েকদিন ধরে এভারেস্ট জয় নিয়ে তুমুল একটা বিতর্ক চলছে। বিতর্কটা হলো মুসা ইব্রাহিম নিয়ে, তিনি এভারেস্ট জয় করেছেন কি করেন নাই তা নিয়ে। বিতর্কটা প্রথম থেকেই চলছে, যেদিন প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে মুসা ইব্রাহিম এভারেস্ট জয় করেন। দিন তারিখ ঠিক করে বললে সেটা ২০১০ সালের ২৩ মে।
এই বিতর্কের সমাধান হয়েছিল তখনই। বিতর্কের সৃষ্টিকারীরা তথা ইনাম আল হক, সজল খালেদ, এম এ মুহিত গং নিজেরাই বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছিলেন। ইনাম নিজে মুসাকে হাসিমুখে অভিবাদন জানিয়েছিলেন আর সজল ই-মেইলের মাধ্যমে সবার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। এবং ধরে নেয়া হয়েছিল বিতর্কের যবনিকাপাত ঘটেছে। কিন্তু না, আদতে তা ঘটেনি। বিতর্ক সৃষ্টিকারীরা উপরে উপরে ভালো মানুষটি সাজবার চেষ্টা করলেও ভেতরে ভেতরে তারা গভীর এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। সম্প্রতি তারা আবারো একজোট হয়ে সেই বিতর্ক উস্কে দেয়ার চেষ্টা করছে, সঙ্গে নতুন এক এভারেস্ট জয়ী যোগ হয়েছেন। এবং তারা সফল হলেন। একটি পক্ষপাতদুষ্ট মিডিয়া তাদের সহযোগী হলো এবং আরেকটি মিডিয়া বিতর্ক ছড়িয়ে দিতে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসল। ফলে যা হবার তাই হলো। আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজের একটি অংশ এই বিতর্ক লুফে নিল।
এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, এভারেস্ট নিয়ে যে বিতর্ক চলছে তাতে আমাদের সমাজের নিম্নবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। যত আগ্রহ মধ্যবিত্তের। এবং তারা এমন ভাবে মুসা ইব্রাহিমকে আক্রমণ শুরু করেছে যেন পারলে এখনই মুসাকে এভারেস্ট থেকে টেনে হিচড়ে নামিয়ে এনে ভূপাতিত করতে পারলে তাদের শান্তি হয়, সুখানুভূতি হয়। কোন যুক্তি প্রমানের ধার তারা ধারতে চান না। ইনাম-মুহিত গংয়ের ছড়িয়ে দেয়া প্রপাগান্ডা আকড়ে ধরে নাচার চেষ্টা করছে তারা। প্রপাগান্ডা যাচাই করার আগ্রহ নেই তাদের। কেবল শুয়ে-বসে-দাড়িয়ে বলতে শোনা যায় তাদের- 'মুসা এভারেস্টে ওঠে নাই, মুসা এভারেস্টে উঠতে পারে না, এইটা আমার বিশ্বাস।'
এই যে প্রপাগান্ডার পেছনে দৌড়ে সুখ পাওয়া মধ্যবিত্ত, কেন তারা মুসার সাফল্য কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করে সুখানুভব করছেন তার কারণ অবশ্যই আছে। এটি যে এক ধরণের মানসিক বৈকল্য বা বিকৃত মানসিকতার পরিচয় তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে পরে আসছি। তার আগে ইনাম গংয়ের কাছে একটু ফিরে যেতে চাই।
ইনাম-মুহিত গং কেন এই প্রপাগান্ডা ছড়াচ্ছে তার কারণ বোঝার ক্ষমতা বোধকরি পাগলেরও রয়েছে। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে এভারেস্ট জয় করাটা একটা ইতিহাস। এই ইতিহাসে স্থান না পেয়ে তারা যে এমনটি করছে। মনে পড়ে ২০১০ সালের প্রথম দিকে, মুহিত যেদিন সংবাদ সম্মেলন করেছিল তার দুই কি এক দিন পর মুসার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। ব্যক্তিগত পরিচয় থাকার সুবাদে আমি তার এভারেস্ট জয়ের অদম্য ইচ্ছার কথা জানতাম। সেদিন আমিও তাকে বলেছিলাম- 'প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয় করাটাই কিন্তু ইতিহাস হয়ে থাকবে, পরেরগুলো নয়।'
এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছি এই ইতিহাস হতে না পারা ইনাম গং কেন এত উঠে-পড়ে লেগেছেন। যতদুর জানি, মুসা ইনাম গং থেকে বের হয়ে এসে আলাদা ক্লাব করেছে। সেই থেকে দুই ক্লাবের রেষারেষি শুরু। ইনাম চেয়েছিলেন তার অনুসারিদের কেউ প্রথম হোক, তাহলে অনুসারী সবসময় তার গুণগান গাইবে, তিনি তাদের ওপর চাইলেই ছড়ি ঘুরাতে পারবেন। আর মুহিত দুর্ভ্যাগের জন্য প্রথম অভিযান থেকে ফিরে আসার কষ্টটা ভুলতে পারছেন না। প্রথম হওয়ার প্রবল বাসনা ছিল তার, হতে পারেন নাই, তাই এখন প্রথম হওয়াটা ছিনিয়ে নেয়ার নোংরা পথ ধরেছেন। কর্দমাক্ত সেই পথে তিনি ক্রমশ নিচের দিকে তলিয়ে যাচ্ছেন, ভাবছেন আরাম লাগছে কিন্তু ডুবে গেলে কিন্তু সব শেষ, মুহিতের তা মনে রাখা উচিত ছিল।
মুহিত যে প্রথম এভারেস্ট জয়ী বাংলাদেশী হবার প্রবল চেষ্টা করেছিলেন তা বোঝা যায় একটি বৈঠকের সার-সংক্ষেপ আলোচনায়। মুহিত অভিযানে যাবার আগে মুসাসহ যৌথ অভিযান করার একটি আলোচনা হয়েছিল, ইনাম নিজেও রাজী হয়েছিলেন কিন্তু মুহিত রাজী হননি। কারণ একাই জয়ের মুকুট পড়তে চেয়েছিলেন, কিন্তু ভাগ্য তার সহায় হয়নি।
ফলে ইনাম-সজল-মুহিত গং প্রথম থেকেই যে চেষ্টাটা করেছে, তা হলো মুসাকে বিতর্ক করার চেষ্টা করেছে, দেশে বিদেশে তদবির করেছে, কাউকে কাউকে টাকা সেধেছে মুসার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে কখনো সফল হয়েছে কখনো হয়নি।
এবার ছেড়ে আসা সেই প্রসঙ্গে আসি। কেন মধ্যবিত্তের একটি অংশের মুসার প্রতি তীব্র এত ক্ষোভ? কেন বস্তুনিষ্ট তথ্য না জেনে যাচ্ছেতাইভাবে মুসাকে আক্রমণ করছে? এর সহজ উত্তর কয়েক ব্যক্তির কথপোকথনেই নিহিত। একজন বলছিলেন, ''...লা মুসা কিন্তু অনেক টাকা-পয়সা কামাইয়্যা ফেলছে।' আরেকজন বলছেন, 'মুসা কিন্তু অস্ট্রেলিয়া থিক্যা আর ফিরবো না। ...লা য়্যুরোপও গেসিল। ....লার কপাল একটা।' '...ও যায় নাই, আমি বিশ্বাস করি না।' এই কথোপকথন এর কারণ হলো মধ্যবিত্তের দীর্ঘ দিনের আকাঙ্খা পুরণ না হওয়ার তীব্র বেদনা বোধ। মুসা পেরেছে এবং সে ইতিহাস হয়ে গেছে আমি কেন পারি নাই। আমি যেহেতু পারি নাই তাহলে মুসা কোনভাবে এভারেস্ট জয় করতে পারে না। এই হলো প্রপাগান্ডায় গা' ভাসানো মধ্যবিত্তের একটি অংশের অর্ন্তনিহিত কারণ। তারা যে সচেতনভাবে মুসার বিরোধিতা করছে তা কিন্তু নয়, তারা আসলে এভারেস্ট জয়টাকে প্রতিপক্ষ ভাবছে। এটা যদি এমন হতো যে মুসার স্থানে ইনাম, সজল কিংবা মুহিত থাকতেন তবুও বিতর্ক উঠলে এই শ্রেণী তাদেরো বিরোধিতা করতেন।
সবশেষে একটা কথাই বলতে চাই, আমি পারি নাই বা আমি বঞ্চিত বলে অন্য কেউ পারবেন না বা বঞ্চিত হবেন এমন ভাবনা থেকে আমাদের বেড়িয়ে আসতে হবে। এত সহজেই প্রপাগান্ডায় গা' ভাসানো চলবে না। এটা সংকীর্ণ মনের পরিচয়। এ থেকে আমাদের বেড়িয়ে আসতে হবে। আর পর্বতারোহীদের মনা পাহাড় সমান হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি।
এভারেস্ট বিতর্ক এবং মধ্যবিত্তের মনোবৈকল্য
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৫টি মন্তব্য ৪টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।
আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন
ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের দায়িত্ব।
এগুলো আমার একান্ত মতামত। এই ব্লগ কাউকে ছোট করার জন্য লেখি নাই। শুধু আমার মনে জমে থাকা দুঃখ প্রকাশ করলাম। এতে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দায়ী না। এখনে... ...বাকিটুকু পড়ুন
তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?
আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন
এখনো নদীপারে ঝড় বয়ে যায় || নতুন গান
এ গানের লিরিক আমাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে। ২৪ বা ২৫ এপ্রিল ২০২৪-এ সুর ও গানের প্রথম কয়েক লাইন তৈরি হয়ে যায়। এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ি অন্য একটা গান নিয়ে। সে... ...বাকিটুকু পড়ুন
ফেতনার সময় জামায়াত বদ্ধ ইসলামী আন্দোলন ফরজ নয়
সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৩। তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর! আর বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।যখন তোমরা শত্রু ছিলে তখন তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন