somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রফিক মিয়ার সাথে পূর্ণিমা রাতের নিশ্চয়ই কোন সম্পর্ক আছে

০২ রা নভেম্বর, ২০১৩ সকাল ৭:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

.
...


নতুন বাসায় উঠেছি।সাথে রফিক মিয়া।তাকে চাকর বলা যায় না।বলতে গেলে সে আমার আপন মানুষ।আমার নির্বাসিত জীবনে এখন সে-ই একমাত্র সঙ্গী। আগের বাসা ছাড়ার কিছুদিন পূর্বে রফিক মিয়ার সন্ধান পাই।বাসার সামনের চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম।সন্ধ্যাবেলা।এই চায়ের দোকানী অসাধারণ চা বানায়।এমন অসাধারণ চা বানানোর জন্য তাকে একটা পুরস্কার দেওয়া যেতে পারে।
দোকানের দু'পাশে দুটো বসার বেঞ্চ।আমি যে বেঞ্চে বসে আছি তার বিপরীত বেঞ্চে রফিক মিয়া বসে চা খাচ্ছে।চায়ের কাপে প্রতিবার চুমুক দেয়ার পর চারপাশে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।এভাবে তাকানোর কারণ ঠিক বুঝা গেল না।এলাকায় নতুন? হতে পারে।

-আপ্নের কাছে ১০ টাকা হবে?
আমি অবাক চোখে তাকালাম।রফিক মিয়া টাকার কথা জিজ্ঞেস করছে।অপরিচিত কাউকে এভাবে আচমকা টাকার কথা জিজ্ঞেস করলে অবাক হওয়াটাই স্বাভাবিক।

-হবে।কেন?
-আমার চায়ের বিলটা দিয়ে দেন।আমি টাকা আনি নাই।
কোনরকম আপত্তি না করে বিল দিলাম।সে-ই পরিচয়।রফিক মিয়ার সাথে কথা বলে তার সম্পর্কে অথবা তার পরিবারের কোন খবর উদ্ধার করা গেলনা।শুধু এটুকু বুঝা গেল যে সে ভবঘুরে।আমি সুযোগ পেয়ে আমার সাথে থাকার প্রস্তাব দিয়ে বসি। একজন সঙ্গী পেলে মন্দ হয়না।আমার প্রস্তাব শুনে সে ঘড়ি ধরে দু'মিনিট অবাক হয়।পরে রাজিও হয়ে যায়।



রফিক মিয়া অল্পভাষী। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেনা।জগতে কিছু লোক আছে যারা কোনকিছুতেই অবাক হতে পারেনা।এদেরকে অবাক হওয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়নি। যদি বলা হয় তিন চোখওয়ালা এক শিশু গতকাল ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেছে, এরা কোন প্রতিক্রিয়া দেখাবে না। যেন এটাই স্বাভাবিক।তবে রফিক মিয়ার এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো সে পূর্ণিমার রাতে বেশি কথা বলে। আমি লক্ষ করেছি।প্রতি পূর্ণিমায় ঘরে যে দুটো বেতের চেয়ার আছে রফিক মিয়া সেগুলো বারান্দায় নিয়ে যাবে, কড়া লিকার দিয়ে দু কাপ চা বানাবে আর সারারাত গল্প করবে। প্রায় সময়ই সে রুপকথার গল্প শুনাবে, যেন আমি এখনও দু'বছরের শিশু। ঘুমাচ্ছিনা বলে রুপকথা শুনিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।পরদিন সকালে সে আবার তার আগের জগতে ফিরে যায়। অদ্ভুত গাম্ভীর্যপূর্ণ জগত।

রফিক মিয়ার পূর্ণিমার রাতের অদ্ভুত আচরণের কথা আমি বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট “মিসির আলি”র এক প্রিয় ছাত্রকে বলি। সে এটার ব্যাখ্যা দাঁড়া করাল যা এরকম :রফিক মিয়ার অতীত জীবনে হয়ত পূর্ণিমার রাত নিয়ে কোন দুঃসহ স্মৃতি আছে যার কারণে পূর্ণিমা রাতের প্রতি তার এক ধরনের ভীতির সৃষ্টি হয়েছে।এজন্য সে পূর্ণিমার রাতে ঘুমুতে পারেনা।তাই আমার সাথে গল্প করে রাত কাটাবার চেষ্টা করে।রাত শেষ, ভীতিও খতম।

আমার এই নির্বাসিত, স্থির রসহীন জীবন এক রাতে ভীতিপূর্ণ হয়ে উঠে।আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখি।ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। দুঃস্বপ্ন দেখা নতুন কিছু না।সবাই দেখে।আমিও দেখি।রেশ বেশিক্ষণ থাকেনা।কিন্তু এবার ব্যতিক্রম।আমি শত চেষ্টা করেও দুঃস্বপ্নের কথা মাথা থেকে সরাতে পারিনা।ভীষণ যন্ত্রনা।আমার ভয়ের পরিমাণ বেড়ে তিনগুণ হয় যখন সকালে উঠে আবিস্কার করলাম যে গতরাতে পূর্ণিমা ছিল এবং আমি আর রফিক মিয়া গল্প করে প্রায় আড়াইটার দিকে ঘুমুতে যাই।আমার শরীর কাটা দিয়ে উঠে।

এর পর আরো কিছুদিন কেটে যায়। স্বাভাবিক জীবনযাপন করি।পরবর্তী পূর্ণিমায় তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি এবং আগের স্বপ্ন আবার দেখে জেগে উঠি।প্রচণ্ড ভয়ে আমার শরীর কাঁপছে। সিদ্ধান্ত নিলাম সেরাতে আর ঘুমাব না।একজন ডাক্তারের কাছে এর ব্যাখ্যা চেয়ে পত্র লিখতে বসলাম।মোমবাতি জালিয়ে কাগজ আর কলম খুঁজে বের করলাম। আমি যেহেতু জানালা খুলে ঘুমাই তাই জানালা খুলা। রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট দেখা যাচ্ছে।

-স্যার চিঠি লিখা শেষ?
আমি চমকে উঠি।গমগমে গলায় কে আমাকে ডাকল? আমি ভেবে পাই না। আমার শরীর কাপতে থাকে।গা গুলিয়ে উঠে।পেছন ফিরে তাকালাম, কেউ নেই।এত রাতে কে আসবে? মোমবাতি টা দপ্ করে নিভে গেল।জানালা দিয়ে তাকালাম।ল্যাম্পপোস্ট ও নিভে গেছে।চারিদিকে অন্ধকার।গাঢ় অন্ধকার।আমি টের পেলাম আমার শার্ট ঘামে ভিজে গেছে।

-স্যার ভয় পাইছেন?
-কে?কে তুমি?
-আমি রফিক , স্যার। রফিম মিয়া।
-তুমি? তুমি এখানে কি করছ? ঘুমাওনি?
-জ্বী না স্যার। ঘুমাই নাই।আমি ঘুমাই না। আমাদের ঘুমের দরকার নাই। ঘুম দরকার আপ্নাদের।মানুষের।
-কী বলতে চাও তুমি?
-কিছুনা স্যার। আমি শুধু একটা খেলা খেলতে এসেছি।নির্দোষ আনন্দের খেলা।
-কিসের খেলার কথা বলছ? টর্চ থাকলে জালাও।ম্যাচের কাঠি খুঁজে পাচ্ছিনা।
-আলো জ্বালাইয়েন না স্যার।আপ্নে ভয় পাইবেন।

আমি বারবার নিজের কাছে প্রমাণ করতে চাইলাম যে এটা মানুষ রফিক মিয়া।আর কিছুনা।কিন্তু এতসব ঘটে যাওয়ার পর আর বুঝতে বাকি রইল না যে রফিক মিয়া আসলে মানবজাতির বাইরের কিছু।অশরীরী। আমি কাপা গলায় প্রশ্ন করলাম:

-আমার সেই দু:স্বপ্নের পেছনে কি তোমার হাত আছে? স্বপ্নের মাঝে যে লোকটা এক পায়ে হাটে সে কি তুমি?
-জ্বী স্যার। আমিই আপ্নারে স্বপ্ন দেখাইছি।
-কেন?
-এমনিই স্যার। খেলা খেললাম।
-আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।
-কী দরকার স্যার? জগতে সবকিছু বুঝা লাগে না। যারা বেশি বুঝে তাগো ভাত নাই।
-তুমি কে? কী চাও এখানে?
-আমি আপ্নারে একধরনের কষ্ট দিতে চাই স্যার। যেই কষ্ট দিয়া আপ্নের বাবা আমার বাবারে মারছিল।

আমি কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই শরীরে ঠান্ডা কোনকিছুর স্পর্শ অনুভব করলাম।হাড় কাঁপানো ঠান্ডা।হাড্ডি ফেটে যাচ্ছে মনে হলো।চিৎকার করতে চাচ্ছি, পারছি না।আমার মনে হলো আমি আকাশ ও জমিনের মধ্যবর্ত্যি কোথাও ঝুলে আছি।চারিদিকে গাঢ় নীলাভ আলো।তৃষ্ণায় আমার বুকের ছাতি ফেটে যাওয়ার উপক্রম।জিহবা বেরিয়ে এসেছে বোধহয়।ভাবলাম স্বপ্ন দেখছি, এসব স্বপ্নে ঘটছে।কিন্তু ব্যথার তীব্রতায় সবকিছু সত্য মনে হলো।একবার ভাবলাম আমার মৃত্যু হয়েছে।অতিরিক্ত পাপের কারণে ঈশ্বর নরকে পাঠিয়েছেন।কিন্তু নরকে ত আগুন থাকার কথা, সেখানে নীলাভ আলো থাকবে কেন?আমি একইসাথে বরফ আর আগুনের অনুভূতি পেলাম।আমার শরীরের চামড়া যেন খুলে আসছে কাঁদছি কীনা তাও বুঝতে পারছিনা। শুধু এক অসহনীয় ব্যথা অনুভূত হলো।আমার চিন্তাশক্তি লোপ পেতে থাকে একসময়। চারিদিক শূন্য হয়ে যাচ্ছে। কোথাও কিছু নেই।

আমি শেষবারের মত নিজেকে প্রশ্ন করলাম, আমি কী বেঁচে আছি?
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই নভেম্বর, ২০১৩ সকাল ১০:২৮
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কৃষ্ণচূড়া আড্ডার কথা

লিখেছেন নীলসাধু, ১৯ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:০২



গতকাল পূর্ব নির্ধারিত কৃষ্ণচূড়ায় আড্ডায় মিলিত হয়েছিলাম আমরা।
বছরের একটি দিন আমরা গ্রীষ্মের এই ফুলটির প্রতি ভালোবাসা জানিয়ে প্রকৃতির সাথে থাকি। শিশুদের নিয়ে গাছগাছালি দেখা, ফুল লতা পাতা চেনাসহ-... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×