এক.
ওরা কি ভোরের দিকে তাকায় না? অন্ধকার তাড়িয়ে দিয়ে আলোর মেলা বসায় যে সূর্য তার দিকে তাকিয়ে ওরা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেনা । ওরা জানেনা কি চায়, কি পেলে ওদের ইহলীলা সার্থক হবে । ওরা ছুটেছে কত মেকির পিছনে । চাই চাই আরো চাই! ওরা মায়া খুঁজেনা । ভোরের আলোয় প্রথম চোখ খুলে নির্মল বাতাস ভিতরে টেনে নিয়ে জানালার ওপাশের পৃথিবী দেখতে জানেনা । ওরা মায়া অনুভব করেনা ঘরের চার দেয়ালের প্রতি । আকাশ আড়াল করে রেখেছে যে ছাদ, তার দিকে তাকিয়ে ভাবেনা এর নিচে কত সুখ পেয়েছে সে । কত ভালোবাসার জন্ম হয়েছে এর আড়ালে । দেয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে ভাবেনা কতো তারিখ পাতায় জ্বলজ্বল করছে সুখের ভারে । অতিত ঘৃণা ওদের ভিতর । লক্ষ্য শুধু তার থেকে এগিয়ে যাওয়া । ঘরের দেয়ালে ছুটে বেড়ায় যে কতটা টিকটিকি, তাদের দেখে মায়া হয়না । স্বার্থচিন্তায় মগ্নাবস্থায় কোন টিকটিকি ভুলে টিকটিক করলে সে-কী প্রশান্তির হাসি! ভোরের খবরের কাগজে বিনোদনের পাতায় অসুস্থ উত্তেজনার খুঁজে দুচোখ আজন্ম ব্যস্ত! তবু ওরা ক'টা পাতা উল্টিয়ে যায় নি গল্পে । ওরা আসল রসের সন্ধান চিনতে বরাবরই ভুল করে । মায়া লেপ্টে থাকে ওদের চারপাশে । সন্ধানী দুটো চোখের অভাবে ওরা তা দেখতে পায় না । যদি পারত, ওদের চোখের জনম সার্থক হতো । দু চোখ চিরতরের জন্য বুজে যাওয়ার আগে ভাবত, মায়া ছিল সবখানে, ভালোবাসা ছড়িয়ে ছিল উঠোনে, জুতোর ফিতেয়, প্রেয়সীর চুলের ঘ্রাণে , ধোয়া উঠা চায়ের কাপে , ইশাণ কোনের জানালায়! বড্ড দেরী হয়ে গেছে !
দুই.
সেদিন সন্ধ্যায় দুটো ধুম্রশলাকা সঙ্গী করে গিয়েছিলাম শহরের পশ্চিম কোনে । ল্যাম্পপোস্টের আলোয় স্নান করে হেটে বেড়াচ্ছিলাম রাস্তার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে । বোধেরা সেদিন জাগ্রত ছিল । জনাকীর্ণ রাস্তায় সেদিন দেখেছিলাম জীবনের মানে । অস্থায়ী চায়ের দোকানে সময়ের তাড়া সত্যেও এক কাপ চায়ের টানে চুমুকে ব্যস্ত নাগরীক দেখেছিলাম সেদিন আর ভাবছিলাম, আহ! চারিপাশে কত সুখ! কেউ খুঁজে পায়, কেউ পায়না । অনেকেই খুঁজতে জানেনা । রিক্সায় হাত ধরাধরি করে সুখে ভাসা প্রেমিক যূগল দেখেছিলাম । সন্ধ্যার তরল আলোয় ওরা যেন ছিল দুটি গোলাপের ন্যায় । হ্যা! আরো দেখেছিলাম চিন্তিত মুখে সিগারেট টানতে থাকা মধ্যবিত্ত । মাথায় শত চিন্তার ভার ধোয়ার সাথে বের করে দেবার সে-কী ব্যর্থ প্রয়াস । আরো অনেককিছুই দেখেছিলাম । মস্তিস্ক মনে রাখেনি । সত্যাসত্য জীবন দেখে সুখ নিংড়ে নেয়ার ঘটনা তার কাছে অগুরুত্বপূর্ণ । তবে একটা যুবকের কথা মনে আছে। হ্যা! সেইদিন সন্ধ্যায় । আনমনে হাটতে হাটতে তখন চলে গিয়েছিলাম শহরের শেষ প্রান্তের ব্রীজে । তখন দালানগুলোর আড়ালে গা ঢাকতে শুরু করেছে সারাদিন আলো বিলিয়ে দিয়ে শ্রান্ত-ক্লান্ত সূর্য । আর ঠিক তখন! হ্যা! অদূরে কারো গোঙানি শুনে আমার ঘোর কাটে । বাম দিকে ঘারের উপর দিয়ে চোখ দুটো তাক করে দেখি আস্ত এক মানব ব্রীজের নিচের দিকে তাকিয়ে জল দেখছে । বড় কষ্ট হয়েছিল তখন । মনে শুধু প্রশ্ন উদয় হতে থাকে, কেন! কেন! কেন এই গোলাকার মায়াবৃত্ত থেকে সে অবসর চায় । এই বৃত্তের মায়া যে বড় শক্ত! সে কেন তা ছিন্ন করে চলে যাবে অন্ধকার গহ্বরে । প্রার্থনা করছিলাম সে যেন ডুবে যেতে উদ্যত রক্তিম লাল সূর্যের দিকে একবার তাকায়। শুধু একবার । আগামীকাল জগতময় আলো বিলিয়ে দিতে যে প্রতিজ্ঞা করছে ।