আমার মনে হয় অদূর ভবিষ্যতে মুসলিম জাতিগোষ্ঠী যারা রয়েছে সমগ্র বিশ্বজুড়ে তারা ব্যাপকভাবে খুব কঠিন রকমের বৈষম্য, ঘৃণা-বিদ্বেষ এবং আক্রমণের শিকার হবে। কিছু কিছু তো এরমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে, বাট পিকচার আভি বাকি হ্যায়। যেভাবে মনে মানসিকতায় সহিংস হয়ে উঠতে শুরু করেছে এরা এবং অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি যেরকম বিদ্বেষ অন্তরে লালন করে তারা তাতে করে এর ভিন্ন কিছু হওয়া প্রায় অসম্ভব পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। একই সাথে মুসলিমদের নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের নোংরা রাজনীতি করার পরিমাণ আরও বাড়বে। ধর্মান্ধদের ব্যবহার করে কিকরে স্বার্থ উদ্ধার করতে হয় সেটা তাদের ভালোই জানা আছে। এটা ছাড়াও মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে যেসব আলাদা আলাদা গোষ্ঠী আছে যেমন শিয়া, সুন্নি, ওয়াহাবি, আহমদিয়া, কাদিয়ানী এসব গোষ্ঠীর মধ্যে পরস্পরের প্রতি মূলত আকিদা ও বিশ্বাসের রকমফের নিয়ে যেরকম বিদ্বেষ রয়ে গেছে সেগুলো কেবল সংঘাতের পরিমাণ বাড়াবেই। কমাবে না। এদের সংখ্যা যখন আরও বহুগুণে বাড়বে তখন সংঘাতের পরিমাণ আরও বাড়বে। সংঘাত বাড়বে অন্যান্য ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সাথেও। কারণ একে তো অন্যদের বিশ্বাস এবং কালচারকে শ্রদ্ধা করার মানসিকতা মুসলমানদের একটা বড় অংশের মধ্যেই নেই, তাছাড়া মুসলমানদের মধ্যে সহিষ্ণুতা এবং সহনশীলতার অভাব ক্রমেই বেড়ে চলেছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই বাদবাকি বিশ্বের মানুষ এগুলোকে সহজভাবে নিবেনা।
ভবিষ্যতে ইসলাম হয়ে দাঁড়াবে বিশ্বের ১ নম্বর ধর্ম। অর্থাৎ মুসলিমদের সংখ্যা হবে দুনিয়ার মধ্যে সব থেকে বেশী। এই মুসলিমদের মধ্যে বেশীরভাগ আবার চিন্তাধারার দিক থেকে পশ্চাৎপদ। আধুনিক শিক্ষা-দীক্ষা,চিন্তা-চেতনা, জ্ঞান আহরণ আর প্রযুক্তিখাতে গবেষণা করার মতো মানসিকতা এদের নেই বললেই চলে। সমস্ত দিকেই ইসলাম এদের মনের চোখকে অন্ধ করে রেখেছে। এহেন ধারার মানসিকতা অদূর ভবিষ্যতে খুব পরিবর্তন হবে এমন আশা করা যায়না। বিশেষত আমাদের দেশের মুসলমানদের নিয়ে তো একেবারেই নয়। বাকি বিশ্বের বেশীরভাগ মুসলিম দেশের ব্যাপারেও প্রায় একই কথা প্রযোজ্য। আমাদের দেশের মুসলমানদের মানসিকতা যেভাবে বদলে যাচ্ছে তাতে এদেশ ভবিষ্যতে যদি আরেকটা আফগানিস্তান হয় তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এমনিতে ধর্মান্ধতার চোটে তো প্রায় পাকিস্তান হয়েই গেছে। যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমরা জয়ী হয়েছিলাম আমরা, আজ ধর্মান্ধতার কবলে পড়ে দেশ পুনরায় সেই পাকিস্তান হওয়ার পথেই হাঁটছে। কথায় কথায় তো সরকার দেশকে মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর বানানোর কথা বলে। দেশে ধর্মান্ধতা যে হারে বেড়ে চলেছে তাতে সেই মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর হতে গিয়ে এদেশ যদি শেষমেশ আরেকটা আফগানিস্তান হয়ে পড়ে তাতে বিচিত্র কিছু থাকবে না।
কারণ, এই বঙ্গদেশে বহু অনাকাঙ্ক্ষিত বিচিত্র ব্যাপারই ঘটে।
আরেকটা কথা না বললেই নয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগা নিয়ে এদেশের বীর তৌহীদি জনতা যেরকম ক্ষ্যাপামি দেখায় তার সামান্যতমও দেখায় না দেশের ঘুষ-দুর্নীতি-চুরি-বাটপাড়ি দমনের জন্য। অথচ এগুলোই দেশের প্রধান সমস্যা। দেশের কত মানুষ এখনো ঠিকমতো দুবেলা খেতে পায়না। এই তৌহীদি জনতা তো এট লিস্ট চাঁদা তুলে হলেও ভুখা-নাঙ্গা মানুষগুলোর মুখে খাবার তুলে দিতে পারে। তা ইসলামে যখন এতোই বিশ্বাস, ঈমানদণ্ড এতোই যখন খাড়া, ঐ গরীব মানুষগুলো যখন কাজ পায়না, না খেয়ে থাকে, তখন ঐগুলা কই থাকে? তখন ঐ ঈমানি দায়িত্ব কই থাকে? ওরা কি ইনসান না? ওরা কি আল্লাহ্র সৃষ্টি না?
নজর দেয়া যাক অন্যান্য প্রধান মুসলিম দেশের দিকে। ইয়েমেনে আজ গত কয়েক বছর ধরে হুতি বিদ্রোহীদের দমনের নামে সৌদি আরবের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে প্রাণ গেছে হাজার হাজার মানুষের। যুদ্ধের কারণে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছে সমগ্র ইয়েমেন। শীঘ্রই আরও বহু মানুষ মারা যাবে না খেতে পেয়ে। কয়টা মুসলিম দেশ ইয়মেনিদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছে?
সিরিয়ায় বেশ অনেক বছর ধরেই চলছে যুদ্ধ। কয়টা মুসলিম দেশ সিরিয়ার মানুষদের সাহায্য করেছে? তাদের যুদ্ধ বন্ধ করার চেষ্টা করেছে? তাদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছে?
আসা যাক ফিলিস্তিনের দিকে। আমরা সবাই মোটমাট জানি ফিলিস্তিন নিয়ে। নতুন করে ব্যাখ্যা করার কিছু নেই। কয়টা মুসলিম দেশ ইজরায়েলের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে ঐ হতভাগ্য ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়িয়েছে? তাদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছে?
এরা কি মুসলিম না? এরা কি ইনসান না? এরা কি আল্লাহ্র সৃষ্টি না?
না, মুমিন মুসলমানের নজর সেদিকে ততোটা নাই। তাদের নজর কে ইসলাম অবমাননা করল তার উপরে। তাকে চাপাতি দিয়ে না কোপানো পর্যন্ত, জবাই করে বা জ্যান্ত পুড়িয়ে না মারা পর্যন্ত তাদের শান্তি নেই।
তাদের নজর - নারী কেন পর্দা ছাড়া চলাচল করবে? পর্দা করেনা বলেই তো নারী ধর্ষণের শিকার হয় – এই হল এদের চিন্তাধারা।
তারা চায় একদিন সারা বিশ্বে ইসলামের ঝাণ্ডা ওড়াতে। সারা বিশ্ব ইসলামের শাসনে নিয়ে আসতে, যেদিন কোরান হবে সংবিধান।
এগুলো যে শুধু আমাদের দেশের মুসলিমদের মনোজগৎ শুধু তাই নয়। বেশীরভাগ মুসলিম মেজরিটির দেশেই এই চিত্র। বিশেষত বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের।
ফ্রান্সের যে শিক্ষককে জবাই করে মেরেছিল সে ছিল চেচনিয়ার মুসলিম। গত পরশু সেই ফ্রান্সেরই নিস শহরে চার্চে হত্যার সাথে যে জড়িত বলে পুলিশ ধরেছে সে হচ্ছে তিউনিশিয়ার মুসলিম।
এর কিছুদিন আগে পাকিস্তানে বিশাল মিছিল হল যাদের দাবি সেখানকার আহমদিয়া, কাদিয়ানীদের যাতে সরকারীভাবে অমুসলিম ঘোষণা করা হয়।
এই যদি হয় দেশে এবং দেশের বাইররের ইসলামপ্রিয় তৌহীদি জনতার আসল চেহারা তখন এরা যেদিন সারা বিশ্বে সংখ্যাগুরু হবে সেদিন কি দাঁড়াবে পৃথিবীর অবস্থা?
আরেকটা দিক না বললেই নয়। মুসলিমদের ধর্মান্ধতার সাথে পাল্লা দিয়ে ধর্মান্ধতা বেড়েছে অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদেরও। বিশেষত ভারতীয় হিন্দুদের। সবাই তো মোটমাট জানেনই ভারতের কি অবস্থা। নতুন করে বলার কিছু নেই। এমনিতেই হিন্দু ধর্ম হচ্ছে এমন একটা ধর্ম বৈষম্য এবং ভেদাভেদ যেখানে রীতিমতো বৈধ, স্বীকৃত। এর উপর ভর করে এরা সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর জুলুম- নিপীড়ন তো চালাচ্ছেই, স্বাভাবিকভাবে বাদ যাচ্ছে না নিম্নবর্ণের অন্যান্য হিন্দুরাও, বিশেষত দলিত সম্প্রদায়ের হিন্দুরা। সিম্পল গরু খাওয়ার জন্য মুসলমান পিটিয়ে মারা, “জয় শ্রীরাম” না বলার জন্য মুসলমান পিটিয়ে মারা, মন্দিরে পুজো দিতে চাওয়ায় নিম্নবর্ণের হিন্দুকে পিটিয়ে মারার কথা আজ আর জানতে বাকি নেই কারোই। এরকম আরও জঘন্য সমস্ত উদাহরণ আছে এইসব হিন্দুত্ববাদী উগ্র ধর্মান্ধদের, যেগুলো বলতে শুরু করলে শেষ হবেনা।
আসেন বৌদ্ধদের কথায়। মিয়ানমারের কথা আপনারা সবাই জানেন। উগ্র ধর্মান্ধ বৌদ্ধরা রোহিঙ্গা মুসলিমদের সাথে কি করেছে, কিভাবে সেদেশ থেকে মেরে তাড়িয়েছে আমাদের দেশে সেকথা আজ সর্বজনবিদিত। এটাও নতুন করে বলার কিছু নাই। মুসলিমদের মতো তারাও দাবি করে যে বৌদ্ধধর্ম শান্তির ধর্ম। আর তার নমুনা এই।
আসেন খৃষ্টানদের কথায়। এদের অনুসারীরা এখন আর অতোটা সহিংস না হলেও খ্রিষ্ট মৌলবাদ বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। বহু ঝড়-ঝঞ্জা আর রক্তপাতের পর আজকের ইউরোপ থেকে খ্রিষ্ট মৌলবাদ অনেকটাই উবে গেছে। কিন্তু উবে যায়নি আমেরিকাতে। আমেরিকাতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যে এতো বেড়েছে তার অন্যতম কারণ ধর্মান্ধ খ্রিষ্টানদের আচরণ। এমন অনেক খৃষ্টান আছে আমেরিকায় যারা বাইবেলের কথা অক্ষরে অক্ষরে মানে। লকডাউনের সময় সব কিছু উপেক্ষা করে এরা চার্চে গেছে, জনসমাবেশ করেছে। কারণ এদের বিশ্বাস – “গড উইল সেইভ আস।“
হ্যাঁ, হিন্দুত্ববাদ জঘন্য এক ব্যাধির নাম। কিন্তু তার উপদ্রব মূলত ভারতবর্ষেই। ভারতবর্ষ ছাপিয়ে সেটা ইউরোপ-আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে উপদ্রব করে বেড়াচ্ছে না।
উগ্র বৌদ্ধত্ব মূলত মিয়ানমার এর দিকেই দেখা যায়। এছাড়াও চীন ও থাইল্যান্ডে কিছুটা এই সমস্যা রয়েছে। গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েনি।
ধর্মান্ধতা, তা যে ধর্মেরই হোক না কেন, সেটা সিন্দাবাদের ভূতের মতোই মানবজাতির ঘাড়ে চেপে বসে আছে। আমার লেখায় মুসলিমদের কথা বিশেষভাবে বললাম এই কারণে যে মুসলিমদের নিয়ে সমস্যা দুনিয়ার বেশীরভাগ জায়গাতেই ছড়িয়ে গেছে। এই সমস্যা মূলত মুসলিমদের ধর্মান্ধতার কারণেই সৃষ্ট। অন্য কোনও কারণে নয়। এটা হিন্দু বা বৌদ্ধদের ক্ষেত্রে সেরকম হয়নি। খ্রিস্ট মৌলবাদ মূলত আমেরিকা আর আফ্রিকাতে বেশী সক্রিয়। এর বাইরে নয়। ইউরোপে বেশীরভাগ খ্রিষ্টানই আজকাল আর ধর্মকর্ম তেমন একটা মানেনা। সেখানে একটা বড় অংশই কোনও ধর্মে আজ আর বিশ্বাসী নয়।
ধর্ম চিরকালই অশান্তির নজীর রেখে গেছে। ধর্ম ভালো ভালো কথা বলে ঠিকই কিন্তু সমাজে অশান্তি, বিভাজন এবং বিদ্বেষ তৈরিতে সে অদ্বিতীয়।
আমাদের পৃথিবীটা এমনিতেই নানা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আর সামাজিক কারণে দ্বন্দ-সংঘাতে ভরপুর। এর মধ্যে ধর্মান্ধতা আমাদের ঘাড়ে ঐ সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে বসে থাকলে এই দ্বন্দ-সংঘাত, রক্তপাত আর প্রাণহানি বহুগুণে বাড়বে। বাড়বেই, কমবে না। ধর্মান্ধতা কোনও জাতিকে কখনো উন্নতি করতে সাহায্য করেনি। বরং উলটোটাই করেছে। একে জেঁকে বসতে দিলে এটা আবার মানুষকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে মধ্যযুগে।
আমরা একবিংশ শতাব্দীতে এসে আবার মধ্যযুগে ফেরত যেতে চাইনা।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০২০ দুপুর ২:৪২