কিছুতেই না, কোনোকিছুর বিনিময়েই কাউকেই দেবেনা খায়রুন ওর বুকের মানিক, সাত রাজার ধন,তার এই ছোট্ট যাদুমানিককে। কোনোভাবেই কেউ কেড়ে নিতে পারবেনা ওর থেকে ওর এই একরত্তি ভালোবাসাকে।
কিন্তু সব প্রচেস্টা ব্যার্থ হলো, ওর যথাসর্বস্ব শক্তিটুকুও পরাজিত হলো ঐ দানবটার কাছে । তার পরানের মানিক, জীবনের টুকরাটাকে টেনে হেঁচড়ে ঠিকি নিয়ে গেলো ঐ পিঁচাশ দানবটা।
ঠিক এমন সময় ঘুম ভেঙে যায় খায়রুনের। হুহু করে কেঁদে ওঠে সে। প্রতিবার একি স্বপ্ন দেখে সে। ঐ দানবটা, ঐ দানবটাই কেড়ে নিয়ে গেলো ওর বুকের মানিক কে। খায়রুন জানে স্বপ্নে দেখা দানবটি আর কেউ নয় স্বয়ং ওর নিজের জন্মদাত্রী মা।
মনে পড়ে সেদিনটির কথা, ভাত খেয়ে উঠেই গা গুলিয়ে উঠেছিলো ওর আর সাথে সাথে দৌড়ে গিয়েছিলো কূয়োতলায়, একরাশ ভাত ডাল সবজী আর টেংরা মাছের ঝোল দিয়ে খেয়ে ওঠা খাবারটা হজম না হতেই হড় হড় করে বেরিয়ে গিয়েছিলো। চোখে মুখে আঁধার দেখছিলো সে। নাড়ীভুড়ি উল্টে আসছিলো যেন।তারমাঝেই, মুখে চোখে পানি ছিটিয়ে উঠে দাড়াতেই সামনে দেখেছিলো মায়ের সেই জলজ্যান্ত অগ্নিমূর্তি। খায়রুনের ষোল বছরের জীবনে মায়ের এমন আগুন ঝরা দৃষ্টির সাথে সে পরিচিত হয়নি কখনও।
টেনে হিঁচড়ে ঘরের ভেতরে নিয়ে গিয়েছিলো মা সেদিন। যত্র তত্র চড় থাপ্পড় কিলঘুষিতে মনে হচ্ছিলো তখনই মরে যাবে সে। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছিলো তবুও। তখনই যদি মরে যেত খায়রুন, দুঃখ থাকতোনা ওর। এখন এই অমানুষিক, অকথ্য কষ্টটা কি করে সইবে সে?? এই পৃথিবীতে কেউ নেই,কেউ নেই ওর , যাকে জানাতে পারে সে তার দুখের কথা। বুক ভেঙে যায় খায়রুনের। কুমারী মায়ের সন্তান হারানোর দুখের সাথী কেউ হয়না এ জগতে।
- আবার কান্দন শুরু করছস মাঝ রাইতে? তোরে আল্লাহ মরণ দেয়না ক্যান?? এত মানুষ মরে তুই কেন মরিসনা?? সর্বনাশী, হাড় জ্বালানী মাইয়া.........
হিস হিসিয়ে ওঠে করিমন বিবি। ওর কান্নার শব্দে কখন ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠেছে সে বুঝতে পারেনি খায়রুন। এই আধো আলো ছায়াতেও খায়রুন দেখতে পায় গোক্ষুর সাপের মত ভয়ংকর সেই অগ্নিদৃষ্টি। মাকে এই নিশুথী রাতে কূপীর আলোয় তার মনে হয় প্রেতীনী ডাইনী কোনো এক অজানা পাষানপূরীর।
২
সারাবাড়ীতে রমরমা আয়োজন। ভোর রাত থেকেই মাইকের শব্দে সারা পাড়া মুখরিত। রং বেরঙের রঙ্গিন কাগজ কেটে কেটে শিকলী বানিয়ে ঝুলানো হয়েছে। ঢেকীতে ধান ভানার শব্দে সারাবাড়ী গম গম করছে, গীত গেয়ে চলেছে পাড়া পড়শী গায়ের বৌ ঝিয়েরা।কছিমুদ্দিনের একমাত্র নাতীর আকীকা আগামীকাল।তারি আনন্দ সোরগোল ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাড়ীতে।
এত আয়োজনে গরবিনী রাজ হংসীর মত মাথা উচু করে যার ঘুরে বেড়ানোর কথা। সব চাইতে খুশী হবার কথা যার, তার মনেই কোনো আনন্দ নেই। সে জানে কত বড় প্রবন্চনা করেছে সে, কতখানি ঠকিয়ে চলেছে সে সবাইকে। নিজেকে রক্ষা করতে, নিজের মান সন্মান ভুত-ভবিস্যৎ বাঁচাতে কত বড় প্রতারনার আশ্রয় নিয়েছে সে।
এইযে তার কোলের কাছে শুয়ে পরম নির্ভাবনায় ঘুমুচ্ছে যে শিশুটি সে জানেনা তার আপন মায়ের ঠিকানা। সে জানেনা কত বড় মিথ্যে পরিচয়ে সে বেড়ে উঠবে আজীবন। কোনোদিন যদি সব কিছু জানাজানি হয়ে যায়? কোনোদিন যদি এই শিশুটি বড় হয়ে প্রশ্ন করে? তার সাথে এমন প্রতারনা কেনো করা হয়েছে ? কি ঊত্তর দেবে সাবেরা?শিউরে ওঠে সে। আকড়ে ধরে তার একমাত্র অবলম্বন, তারি হঠকারীতার শিকার এই নিস্পাপ শিশুটিকে।
তিনতিনবার মৃত সন্তান প্রসবের অপরাধে শ্বাসুড়ী জমিলা খাতুন তাকে হুমকী দিয়েছিলো
- এবারেও যদি মরা বাচ্চা হয়, তাইলে কইলাম আমি পোলারে আবার বিয়া দিমু। কথাখান কান খুইলা মনে বাইন্ধা রাখো বৌ।
অভাগিনী সাবেরার নীরব কান্না, লক্ষ কোটী দোয়া কলেমা বিধাতা তবুও শোনেননি। আবারও সন্তান জন্মাবার ঘন্টা দুয়েক পরেই নিথর শিশু দেহে হাত রেখে ডুকরে উঠেছিলো সে। বিধাতার খেলা বোঝা বড় দায়। তখন নিশুথী রাত।আশেপাশে কেউই ছিলোনা। দু একজন ডিউটি নার্সরাও হয়তোবা ঘুমুচ্ছিলো।কোলে সদ্যপ্রসুত বাচ্চা নিয়ে তার সামনে এসে দাড়িয়েছিলো পাশের বেডের আরেক রমনী।যার সাথে কিছু আগেই কথপোকথনে জানিয়েছিলো তার ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কথা, জানিয়েছিলো শ্বাশুড়ির হুমকীর কথা। সেই রমনী তার পাশে এসে দাড়িয়েছিলো সেই রাতে, বলেছিলো,
-বুবু তুমি আমার এই বাচ্চাডা নাও তোমার মরা বাচ্চাডারে আমারে দাও।
এত কষ্টেও কান্না ভুলে বাক রোধ হয়েছিলো তার। অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলো,
-তোমার বাচ্চা আমারে দিতে চাও? আর তুমি এই মরা বাচ্চা দিয়া কি করবা?
- আমাদের গরীবের ঘরের সন্তান মরা আর জেতা কি ? আমি জানবো আমার পোলা ভালো ঘরে ভালোভাবে মানুষ হইতেছে। এই অনেক বইন।
কতখানি কষ্ট, চোখের পানি সামলে রেখে খায়রুন সেদিন এইকথা বলেছিলো, নিজ সন্তানকে অন্য এক রমনীর বুকে তুলে দিয়েছিলো সে এক মাত্র খায়রুনই জানে। খায়রুন খুব ভালো করেই জানে, সেদিন না হোক হাসপাতাল থেকে ফেরার পরে তার মা ই ঐ সন্তানকে কোথাও না কোথাও সরিয়ে ফেলতো, নয়তো মুখে লবন দিয়ে মেরে ফেলতো।
সাবেরা ঘূর্নাক্ষরেও জানতে পারেনি সেদিন খায়রুন নামের এই কিশোরী মা টির সন্তানের কোনো পিতৃপরিচয় নেই।
যাইহোক শ্বাশুড়ীবুড়ি তার বংশের প্রদীপ পেয়ে খুব খুশী । নাম রেখেছে আবার রাজা। শুধু মনে মনে অবাক হয় সে যখন শবাশুড়ী বলেন,
-আমার সোনার চান, সাত রাজার ধন এক মানিক, নাতী চেহারা পাইছে এক্কেরে বাপ দাদাদের মতন। দাদার মত টিকালো নাক বাবার মত জোড়া ভুরু। আহারে আমার সোনা মানিক!!
আহ্লাদে গলে পড়েন পিতামহী।
আড়ালে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে সাবেরা। মনে মনে ভাবে, হায়রে এই বংশের সাথে যার সাত জনমে কোনো সম্পর্ক নেই তারসাথে বাপ দাদার চেহারার কোথায় মিল দেখে তার শ্বাশুড়ী কে জানে? মাঝে মাঝে শ্বাসুড়ির কথা শুনে শুনেই নাকি, মনের অজান্তেই তারও মনে হয় রাজার চেহারার অনেকটাই, কপালের কাছটা হাসিটা যেন তার স্বামীর মতই , শ্বসুরের মতই।
৩
ভোরের আলো ফুটবার আগেই চুপি চুপি দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে খায়রুন। অনেক কষ্টে হাসপাতাল থেকে অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে যোগাড় করেছে সে সাবেরার গ্রামের ঠিকানা। এই ঠিকানা যোগাড় করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে তাকে। কেনো যে সেদিন ঠিকানাটা নিয়ে রাখেনি তার জন্য অনেক ভেবেছে, অনেক কেঁদেছে খায়রুন কদিন।যাইহোক শেষমেষ পেয়েছে সে সঠিক ঠিকানা।যে করেই হোক যেমন করেই হোক যাবে সে। শুধু একটাবার দেখতে চায় ঐ চাঁদমুখ তার পরানের নিধিকে।
কাউকে কিছু বলবেনা, কাউকে বিপদে ফেলবারও কোনো ইচ্ছে নেই ওর। শুধু একটাবার মুখের দিকে তাকাতে চায় সে নিজ সন্তানের। একটু যদি সুযোগ পায় কোলে নিয়ে এই বুকে জড়িয়ে শীতল করতে চায় এই আগুন লাগা কলিজাটা।
৪
ওকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে ওঠে সাবেরা। এই সোরগোলের বাড়িতে কেউ তেমন একটা খেয়াল করেনা। তাড়াতাড়ি ওর হাত ধরে আড়ালে নিয়ে গিয়ে ধমকায়।
- কেনো আসছো তুমি ? তুমি না কইছিলা কখনও কোনো দাবী নিয়া দাড়াইবা না?
-বুবুগো পারিনা। অনেক কষ্ট গো বুবু। আমি তোমারে বিপদে ফেলতে আসিনাই। কাউরেই কিছু কমুনা। চুপচাপ একটাবার পোলার মুখখান দেখতে চাই গো বুবু। একটু দয়া করো বুবু। সেদিন থেকে একটা রাইত আমি ঘুমাইতে পারিনাই। একটা দিন চোখের জল না ফেইলা দানাপানি মুখে তুলিনাইগো বুবু।
- সাবেরার নারী হৃদয় কোমল হয়ে আসে। বলে,
-ঠিক আছে , কামের বাড়ী। এই সাঁঝ পেরিয়ে কাল ভোর হইলে আমাগো রাজার আকীকা। তুমি আমার বাপের দেশ থেইকা আসছো এই কথা সবাইরে জানাইবা।
-তয় ... একটু থমকায় সাবেরা। তারপর বলে,
-কাল সাঝের আগেই তুমি এইখান থেকে চইলা যাইবা, এই কথা দাও আমারে।
- অবশ্যই চইলা যাবোগো বুবু। শুধু একটাবার পোলারে কোলে নিতে চাই আমি আর কিছু চাইনাগো বুবু।
৫
কিছুপরেই রান্নাঘরের দাওয়ায় খেতে দিয়ে ওকে ছেলে কোলে নিয়ে এসে দাড়ায় সাবেরা। খায়রুন খাওয়া ফেলে উঠে এসে বুভুক্ষরের মত কোলে নেয় রাজাকে। গালে মুখে চুমা দিতে থাকে, সারা গায়ে হাত বুলায়। রাজাও ওকে দেখে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। নিশ্বাড় হয়ে যায় সাবেরা যেন। তবে কি ছেলে চিনতে পেলো মাকে? তার নাড়ীছেড়া ধন।
হঠাৎ বাইরে দাওয়ায় হাক ডাকে সে কল্পনা ভঙ্গ হয় তার । তাড়াতাড়ি খায়রুনের কোল থেকে ছেলে নিয়ে ঘরে চলে যায় সে। স্বামী বাড়ী ফিরেছে। এখুনি দেখতে চাইবে ছেলেকে।
রান্নাঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে তাকায় খায়রুন। চকিতে নিথর হয়ে যায় সে। মনে পড়ে মায়ের অসুখের কারনে মেস বাড়ীতে এক মাস কাজ করতে যাবার সে সব মধুর অথচ আজ তিক্ত বিষাক্তময় স্মৃতিগুলো, তাকে মিথ্যে বিয়ের প্রলোভন দেখানো, মিথ্যে ভালোবাসার ফাঁদে ফেলা, গ্রাম থেকে ভাইয়ের মেসে বেড়াতে আসা সেই রফিক সাহেব। দাড়িয়ে আছে উঠোনের উপরে, হাত বাড়িয়ে কোলে নিলো খোকাকে।সেই, সেই তো........
যার কারণে সে আজ কলঙ্কীনি, যার কারণে তার বুকের মানিক কে হারিয়ে আজ সে ভিখারী। টপ টপ করে চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে ওর।
কাউকে কিছু না জানিয়েই, চুপিসারে, সবার অগোচরে রাতের আঁধারে অজানার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় খায়রুন।
ফিরে এসে খায়রুনকে না দেখতে পেয়ে সাবেরা বড় অবাক হয়।
আজো অবাক হয় মাঝে মাঝেই, যখনই রাজার দাদী বলে, নাতী হয়েছে ঠিক যেন বাপ দাদার আদল।তেমনি কাঁটা কাঁটা চেহারা, টিকালো নাক, আমার বংশের গৌরব.......
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০০৯ রাত ১২:২৬