আমি এই ব্লগে পদার্পনের প্রথম বছর থেকেই সিরিজ লিখেছি। এই সিরিজগুলো লিখতে গিয়েই আমার বেশি ইন্টারএকশন হয়েছে এই ব্লগের মানুষগুলোর সাথে। এই সব গল্পগুলো যাই লিখেছি অনেকেই আগ্রহ ভরে পড়েছে এবং মজাও করেছে, দুঃখে ভেসেছে এবং হেসেছেও। বেশিভাগ সময় যেই সিরিজই লিখেছি আমি সেই সিরিজ নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছে তা আমার জীবনের গল্প কিনা। আমি না বললেও অনেকেই বিশ্বাস করেনি ভেবেছে আমি লুকাচ্ছি আর হ্যাঁ বললে তো হয়েই গেলো সেটাই আমার গল্প। যাইহোক আর তাই হোক আমার গল্পের পিছনের গল্পগুলো আজ বলতে যাচ্ছি মূলত আমার একলব্য ভাইয়ুর জন্য আর সাথে অন্যদের জন্যও বটে। তবে একলব্য ভাইয়ার অনেক অনেক জানার ইচ্ছা আমার গল্পগুলোর সাথে আমার জীবনের কি কি সম্পর্ক আছে।
এটাও সত্যি যে আমি কখনও কোনোকিছুই আকাশ থেকে বানিয়ে লিখতে পারি না। আজ অবধি যা কিছু সিরিজ লিখেছি তার প্রায় ৯৯% ঘটনাগুলি জীবন থেকে নেওয়াই ছিলো। মানে আমার জীবন বা অন্যের জীবন থেকে অর্থাৎ এদিক, ওদিক, সেদিক থেকে এবং নিজের ও অন্যের জীবনে শোনা জানা বা দেখা নানান কাহিনী আমি গল্পের প্রয়োজনে টেনে এনেছি এবং গল্পে জুড়ে দিয়েছি। তবে এই কথা সত্যি সে সব জোড়া তালি দেওয়া ঘটনা বা নিজ চোখে দৃশ্যমান ঘটনাগুলি লিখতে গিয়ে সত্য মিথ্যা যাই মিলিয়েছি সে সব লিখতে গিয়ে আমি চোখের জলে ভেসেছি বা কখনও কখনও হাসতে হাসতে নিজেই মরেছি।
সোজা কথা এক এক সিরিজ লেখার সময় আমি এক এক রাজ্যে ছিলাম। ছিলাম এক এক জগতে। যতদিন আমার সিরিজ চলে ততদিন আমি দুইটা জীবনে বাস করি। এক ঐ সিরিজের মধ্যের জীবন আরেক এই বাস্তব জগতের কঠিন নিয়মতান্ত্রিক জীবন। সিরিজ শেষ হয়ে যাবার পরেও আমি সেই জীবন থেকে বের হই না।ধরেই নেই সেটাও আমার জীবনেরই অংশ যা অতীতে ঘটেছিলো। হা হা সাধে কি মাঝে মাঝে বাড়ির লোকে কহে আমায় জ্বীনে ভূতে ধরেছে? ওহ যা বলছিলাম আমার সকল সিরিজের কিছু না কিছু ভিত্তি বা সত্য নির্ভর পটভূমি ছিলো যা আমাকে সে সব সিরিজ লিখিয়েছে। তবে হ্যাঁ ঐ যে যা লিখেছি তার ৯৯% ই সত্যি হয়ত কিন্তু ঐ যে বাকী ১% যার উপর ভিত্তি করে গল্পগুলো গড়ে তুলেছিলো সেটাই মিথ্যাকল্পনা বা গল্পের পটভূমি ছিলো। আর সেই মিথ্যাটা শুনলে আর কেউ না হোক একলব্য ভাইয়ু ইহজীবনে আমার সাথে কথা বলা বন করে দিতে পারে। ভাইয়ুটা ধরেই নিয়েছে যতগুলো সিরিজ লিখেছি সবই আমার জীবনের গল্প। তবে ভাইয়ু জেনে রাখো এই যে আমার বেশ কয়েকটা লেখা পড়লে সবগুলির সব সত্য যদি আমার জীবনে ঘটেই থাকবে মনে করে থাকো তাহলে তুমি একটা কথা ভাবো তো- আমার তো একটাই জীবন! এই একটা জীবন ঘটনাবহুল হতে পারে তাই বলে এত মানুষ এত অদল বদল কেমনে হলো? হা হা হা...
যাইহোক সবার প্রথমে বলি আমার খোকাভাই এর কথা। যার সাথে আমার আমি নির্ভর গল্প "সে কোন বনের হরিণ ছিলো আমার মনে"র আমি নিরুপমার উথাল পাথাল প্রেম ছিলো। আহা আমার খোকাভাই! সেই খোকাভায়ের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো কোথায় জানো? একটা কবিতার বই এ।
এই যে সেই বইটা। আর এর একটি কবিতার মাঝেই বাস করেন আমার খোকাভাই। সেই কবিতার জনক বিখ্যাত কবি নির্মলেন্দু গুন আর কবিতাটার নাম অমীমাংসিত রমনী।
কবিতা- অমীমাংসিত রমণী
নির্মলেন্দু গুন
সদরঘাটে পৌছুতেই শুরু হয়ে গেলো বৃষ্টি,
ছোট ছোট ফোঁটা হলে নিয়ে নিতাম মাথায়,
কিন্তু বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ছিলো বেশ বড় সড়,
তাই অগত্যা দৌড়ে এসেই আশ্রয় নিলাম,
ফুটপাতের এক পুরোনো বইএর দোকনের তলায়।
সচরাচর এসব দোকানে আজকাল ঢুকিনা,
কিন্তু আগে এক সময় অভ্যেস ছিলো;
বৃষ্টি থামবার কোনো লক্ষন নেই দেখেই
চোখ ফেরালাম সাজানো বইএর বুডে
রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র এবং মাসুদ রানার পাশেই
হঠাৎ দেখি
আমার নিজের লেখা একখানা কাব্যগ্রন্থ
কবিতা অমীমাংসিত রমণী।
বাহ বেশ মজার ব্যাপার তো!
একবার ভাবলাম দেখি একটু হাতে নিয়ে
আবার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো
থাক দোকানীর মনে প্রত্যাশাভঙ্গের দুঃখ দেবোনা
কিন্তু কৌতুহল বড় সংক্রামক
অজান্তে কখন হাত চলে গেলো বইএর দিকে
পাতা উল্টাতেই
রমণীর হস্তাক্ষরে আমার চোখ গেলো আটকে
গোটা গোটা কাঁচা কালো কয়েকটি শব্দ
হঠাৎ আমার বিকেলটাকেই দিলো বদলে
"খোকাভাই আরো সুন্দর আরো ভালো হও"
মমতা
বৃষ্টি ভেজা মনের ভেতরে নামটা গেথে গেলো,
মার্বেলের ভেতরের রঙিন ফুলের মত
আমার মন ভরে উঠলো মমতায়,
মনে হলো আমার কবিতার চেয়ে অনেক বেশী সুন্দর
মমতার এই প্রার্থনা
মমতার এই চাওয়া।
এরপরও কি খোকা ভালো না হয়ে পারে?
পরমূহুর্তে মনে হলো এই বই দোকানে এলো কি করে?
মমতার দেওয়া এই উপ হার
আহা! হতভাগা খোকা বুঝি মূল্য বুঝলোনা।
নাকি এই বই দুজনের বিচ্ছদের স্মৃতি?
একি ছিলো ভালোবেসে দেওয়া মমতার শেষ উপ হার?
আমার কষ্ট হলো ভাবতে
তবুও ভাবলাম
বোশেখের বৃষ্টি থেমে গেলো দ্রুত ।
বইটিকে যথাস্থানে রেখে আমি পা বাড়ালাম,
বাংলাবাজারের উদ্দেশ্যে
কিন্তু , কিন্তু মমতা চললো আমার সাথে সাথেই,
যেনো আমি তার খুঁজে পাওয়া খোকাভাই।
মনে হলো এই বৃষটিস্নাত বিকেল বেলায় আজ তার প্রার্থনা পৌছেছে যথাস্থান।
এই কবিতাটিই ছিলো আমার হৃদয়ে খোকাভায়ের উৎপত্তিস্থল। আমি খোকাভাই আর মমতাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। ধরেই নিলাম খোকাভাই ছিলো মমতার কাজিন। কোনো এক একান্নবর্তী বাড়িতে ছিলো তাদের গোপন ভালোবাসা। আমিও তাদেরকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলাম সেসব দিনে। সেই কবিতা সিরিজ শেষ করার পর আমি কিছু কথা জানিয়েও ছিলাম আমার পাঠকদেরকে। জানিয়েছিলাম আসলেই কে ছিলো এই খোকাভাই। যেই পাঠকেরা আজ আর নেই। সেই লেখাগুলোর মান যেমনই ছিলো, আমার কাছে সে ছিলো এক পরম ভালোলাগা ও ভালোবাসার লেখালিখি। যে কোনো ধরনের লেখায় লেখক বা লেখিকার আত্মতৃপ্তি বলে একটা কথা আছে বলে আমি মনে করি। সে যতই আমার মত অগা বগা লেখক বা লেখিকা হোক না কেনো? নিজের ভালো লাগার মূল্য সবার আগে। আমি সেই পরম আত্মতৃপ্তিটুকুই অনুভব করেছি খোকাভাই ও নিরুপমাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে। লেখার মান কি ছিলো সে বিচার করতে চাইনা আমি, শুধু আমি জানি কতখানি বক্ষে ধারন করেছি আমি এ দুটি চরিত্রকে।
এর অনেকদিন পর একলব্য ভাইয়া ও মিররমনির জন্যই আমি সেই চরিত্র দুটিকে নিয়েই লিখতে শুরু করেছিলাম আমার সিরিজ "সে কোন বনের হরিণ ছিলো আমার মনে"। নিরুপমা আর খোকাভাই এর কথা লিখতে গিয়ে আমি নিজের অজান্তে নিজেই রুপান্তরিত হয়ে গেছি নিরুপমায়। নিরুপমার সাথে সাথে আমি চলে গেছি সেই জীর্ণ, পুরোনো, একটু সেকেলে বনেদী বাড়িটাতেই। সেখানেই কাটিয়ে এসেছি আমার শৈশব ও কিশোরীকাল।কখন যে হয়ে গেছি আমি নিজেরই অজান্তে বেনীদুলানো স্কুল পালানো মেয়েটি ! আর খোকাভাই, বাড়ির মৃত বড়চাচার একমাত্র সন্তান। সঠিক কেয়ারিং এর অভাবে শেষ হয়ে যাওয়া অবহেলিত ছেলেটিকে পরম মমতায় বুকে টেনে নিয়েছি। ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে চেয়েছি। দূর করে দিতে চেয়েছি তার সকল কষ্ট ও বেদনা তবুও আর দশটা বাঙ্গালী কিশোরীর মত পারিনি সমাজ ও পরিবারে রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করতে । অসহায় কিন্তু লক্ষী মেয়েটির মত বাবা মায়ের পছন্দের প্রতিষ্ঠিত পাত্রকেই বরন করে নিয়েছি জীবন সঙ্গী হিসাবে। ঠিক যেমনটা হয় আমাদের এ স্বার্থপর সমাজে।
হয়ত এই লেখাটা পড়ার পর একলব্য ভাইয়ু মিলাতেই পারবেনা আমি কি সত্যি বলছি কি মিথ্যা বলছি। কারণ সেই লেখার প্রত্যেকটি ঘটনা ছিলো আমার বা আমার জানা কারো না জীবন থেকেই। ডায়ালগগুলোর অধিকাংশই বাস্তব জগতে দেখা আমার নিজের বা অন্যান্য নানা মানুষের মুখ থেকেই। শুধু আমি আমার জীবনে কখনও কোনো একান্নবর্তী বাড়িতে ছিলাম না। খোকাভাই নামে বা তার মত কোনো কাজিন প্রেমিকও আমার ছিলো না। তাহলে কি করে লিখলাম আমি এত শত একান্নবর্তী বাড়ির ঘটনা? হ্যাঁ আমি নিজে না থাকলেও আমার নানা বাড়ি,দাদু বাড়ি এবং আমার ছেলেবেলার অনেক বাড়িই একান্নবর্তী ছিলো। ঈদে পালা পার্বনে যখনই যেতাম আমি চিরকালের কল্পনাবিলাসী সকল কাজের কাজী চোখ দিয়ে মন দিয়ে গিলে ফেলতাম সেখানকার দৃশ্য সেখানকার কথপোকথন, মাখনওয়ালা, মাছওয়ালা বা ভিক্ষা চাইতে আসা কোনো ভিক্ষুকের আচার আচরনকেই। সামান্য মাটির উঠোনে বা পাকা শানের মেঝের উপর হেঁটে যাওয়া লাল টুকটুক রেলগাড়ির মত কেন্নো পোকাও টোকা দিলে নিজেকে কেমন গুটিয়ে ফেলে পয়সা হয়ে যায় সেই স্মৃতিও ধরা আছে আমার মনের মাঝারে। এই সকল স্মৃতি, সকল কথকথায় গড়েছি আমি এই সিরিজটিকে। শুধু খোকাভাইটাই নির্মলেন্দু গুনের কবিতার মানুষ আর মমতাটা আমি সেই কবিতার পাঠক। খোকাভায়ের মাকে আমি গড়েছি আমার নানুবাড়ির বড়মামীর আদলে। অন্যান্য মামীদেরকে সরাসরি টেনে এনেছি এই লেখায়। এভাবেই আমার ও আমাদের সকলের ছেলেবেলা কিশোরবেলার নানা ঘটন অঘটন দিয়েই লিখেছি আমি আমার সিরিজ গল্প "সে কোন বনের হরিণ ছিলো আমার মনে"।
খোকাভাই ও মমতার সেই কবিতাটির আবৃত্তি
তবে হ্যাঁ খোকাভাই বলে কেউ থাকুক না থাকুক নিরুপমা বলেও কেউ থাকুক না থাকুক। গল্পের সেই নৌকা ভ্রমন বা সেই বনেদী রাজবাড়িতে লুকিয়ে বেড়াতে যাওয়া বা কাউকে কবিতার বই উপহার দেওয়া, বিদেশিনী বউ এর আগমন, বীরেন ডাক্তার, মেথর পট্টিতে বাঁশে ঝুলানো আস্ত শুকর পোড়াবার দৃশ্য কিংবা সেই প্রথম চুম্বন এই ঘটনাবলীগুলি কিন্তু একেবারেই মিথ্যে ছিলো না। শুধু তারা খোকাভাই বা নিরুপমা ছিলো না। ছিলো অন্য কেউ অন্য কোথাও অন্য কোনো জন। যারা মিলে মিশে একাকার হয়ে গেলো খোকাভাই আর নিরুপমার গল্পের মাঝে।
উৎসর্গ- একলব্য ও মিররডল ভাইয়াও আপুনিকে....
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৩ রাত ৮:২৭