
২০২৪-২০২৫ একাডেমিক ইয়ারের শেষদিনগুলোতে যখন কোনো স্টুডেন্ট আসে না তবে টিচারদের রিপোর্ট কার্ড ও অন্যান্য কাজ থাকার কারণে শুধু তারাই স্কুলে আসে। সে সময়টাতে কাজের পাশাপাশি আমাদের কিছুটা আড্ডা দেবারও সময় জোটে। আমরা খাবার অর্ডার দেই, কাজের ফাঁকে ফাঁকে কেউ নাচ বা গানও গেয়ে ফেলি। কেউ কেউ কবিতাও আবৃতি করে ও একজন তো আছেই যে অবিরাম কৌতুক শুনিয়ে যায় আমাদের।
এরই মাঝে আমি একদিন আমি তাদেরকে শুনাচ্ছিলাম আমার কৈশরে পড়া লা নুই বেঙ্গলী ও ন হন্যতে উপন্যাসের কথা। আমার বাবা নিজে তেমন গল্প উপন্যাস পড়তেন না তবে আমাদেরকে দিয়েছিলেন বলতে গেলে এক সুবিশাল লাইব্রেরী জোড়া বই এর পাহাড়। তো লা নুই বেঙ্গলী পড়ে তারপরপরই ন হন্যতে হাতে নিয়ে চমকেছিলাম। বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এই দুই বই এর লেখক লেখিকা কি চেনে দু'জনকে? বাবা বলেছিলেন হ্যাঁ। সেই অবাক হওয়া, সেই চমকে চাওয়া। তবে লেখেলিখি নিয়ে এই রকম এক ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটিয়েছিলাম আমি নিজের জীবনেও। তবে শুধু ইচ্ছেটারই প্রতিফলন ঘটিয়েছিলাম। কিভাবে সেটা হয়ত এখানে কেউ কেউ জানে যারা আমার বসন্তদিন পড়েছে তারা। তবে এই দুই বই এর লেখক ও লেখিকার লেখালিখির পিছনে ছিলো এক সত্যিকারের প্রেম। তাই থেকে হয়ত কিছুটা সত্য মিথ্যের মিশেলে সৃষ্ট সেই অমর প্রেম উপন্যাস দুটি। যাইহোক তো সেদিনের আমার গল্প শুনে বা সেই সাহিত্য আলোচনা শুনে তখন কেউ কেউ আমাদের টিচারেরা মুগ্ধ হয়েছিলো ও আগ্রহী হয়েছিলো এই ছুটিতে বই দুটি পড়তে। জানিনা তারা কে কে পড়েছিলো তবে আজকে ফেসবুকে মৈত্রেয়ী দেবীর ছবি দেখে সেই কথাটা মনে পড়ে গেলো ....
মির্চা এলিয়াদ। রোমানিয়ান দার্শনিক, ইতিহাসবিদ ও ঔপন্যাসিক কলকাতায় ১৯২৮–১৯৩১ বছর ছিলেন। সে সময় তিনি ভারতীয় দার্শনিক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের কাছে পড়াশোনা করতে কলকাতায় এসেছিলেন ও তার বাড়িতেই আশ্রয় নেয় এই বিদেশী ছাত্র। সেখানে দাশগুপ্তের কন্যা মৈত্রেয়ী দেবী-র সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সেই সম্পর্ক ও আবেগের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে তিনি ১৯৩৩ সালে রোমানিয়ান ভাষায় লেখেন Maitreyi। বাপরে!! সোজা ঐ যুগে এক ইন্ডিয়ান কিশোরী বা তরুনীর নামেই লিখে দিলো বইটা!! কি ফাজিল!
উপন্যাসে তিনি কাব্যিক ভাষায় তাদের প্রেম, সাংস্কৃতিক বিভাজন, মানসিক দ্বন্দ্ব এবং শেষমেশ বিচ্ছেদের কাহিনি তুলে ধরেন। তবে এতে মৈত্রেয়ীর চরিত্র ও ব্যক্তিগত জীবনের কিছু বিবরণ এমনভাবে এসেছে, যা নিয়ে মৈত্রেয়ী দেবী পরে আপত্তি তুলেছিলেন। তুলতেই হবে। ঐ দেশের একটা তরুন বা কিশোরের কাছে যা ডালভাত একজন ইন্ডিয়ান মেয়ের কাছে গোপনীয় আবেগ অনুভূতির সবার সন্মুখে প্রকাশ মোটেও ভদ্রতা নহে। তাই যতই এই প্রেমের উপন্যাস মন দিয়ে পড়ি না কেনো আমি এই লেখকের উপর বেশ রাগান্বিত। মৈত্রেয়ী দেবীর সন্মানের কথা ভাবেনি বলে। তাই এই লেখক আমার চোখে ১ নং লেখক হতে পারে তবে ১ নং প্রেমিক নহে।

যাইহোক ন হন্যতে বইটা বহু বছর পরে (১৯৭৪ সালে) মৈত্রেয়ী দেবী লেখেন বাংলা উপন্যাসে। যার আবার ইংরেজি অনুবাদ It Does Not Die। একটা কথা বলি এই বইটা পড়ার পর আমি পুরোহিতদের মুখে সিনেমা নাটকে মন দিয়ে শুনতাম, ন হন্যতে হন্য মানে শরীরে এমন এমন কথাগুলি এর মানে শরীর ধ্বংস হলেও আত্মা বা সত্তা ধ্বংস হয় না। কথা সত্য! এই কারণে যতই মির্চা সত্য কথা লিখুক না কেনো আর মৈত্রেয়ী সত্য মিথ্যায় যতই লাজ লজ্জা আবেগ ঢাকা দিক না কেনো সেই আসল প্রেমিকা। ভালোবাসা তো হৃদয়ের গভীরেই রয়ে যায় চিরতরে.....

যাইহোক মির্চা এলিয়াদের লেখা La Nuit Bengali এর জবাবেই মৈত্রেয়ী দেবী সে বই লিখেছিলো বটে তবে আমার মনে হয় নির্লজ্জের মত সব কিছু প্রকাশ করে দেওয়া মির্চার বই এর ঐ প্রকাশিত সত্যগুলির লজ্জা ঢাকতেই মৈত্রেয়ী দেবী বাধ্য হয়েছিলেন এই বই লিখতে।
অথবা সত্যিই হয়ত তার মনে হয়েছিলো এই অমর প্রেম ন হন্যতের মত বেঁচে থাকুক সকল প্রেমিক হৃদয়ে।

যাইহোক দুটো বইই একই অভিজ্ঞতার দুটি দিক, দুটি ধারা যা কিছুটা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়েছে। এখন পাঠক নিজেদের মত করে বুঝে নেবে কোনটা কি। মির্চা ঢেলে দিয়েছে বিদেশি প্রেমিকের আবেগ, বিস্ময় আর কাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গি।( শয়তান বেটা এখানে আমি মনে মনে বলি) আর ন হন্যতে এক ভারতীয় নারীর অভিজ্ঞতা, সামাজিক বাস্তবতা আর আত্মসম্মানের কণ্ঠস্বর।( এইখানে আমি আহারে বলি।)
যাইহোক আমার চোখে মানে চক্ষু মুদে আমি দেখতে পাই শানবাধানো বিশাল বারান্দার জাফরীকাটা রেলিং এর ধার ঘেষে একটি ১৪/১৫ বছরের বালিকা চুপি চুপি হেঁটে যাচ্ছে কোনের অতিথি ঘরের দিকে। কখনও সে হেঁটে যায় খুব ভোরে সকলের অলখে মা যখন পূজায় বসে বা বাড়ির ঝি চাকরেরা ব্যস্ত ভোরের কাজে, ছোটবোন ঘুমিয়ে থাকে। ঠিক তখনটায় সে গিয়ে ঘুম ভাঙ্গায় মির্চা ইলিয়াদ নামের সেই তরুনটির।
আাবার ঠিক ঝিম ধরানো কোনো দুপুরে সবাই যখন ভাত ঘুমে বিভোর সেই বালিকা চুপি চুপি পৌছে যায় কোনের ঘরের দূয়ারে। ছেলেটা তখন হয়ত কিছু পড়ছে বা লিখছে কিংবা অপেক্ষাতেই আছে সেই বালিকার! পিছে গিয়ে চোখ চেপে ধরে দুষ্টুমীতে। আর ছেলেটা তো জানেই কে এমনটা করতে পারে!
সেই বালিকা বৃষ্টি নুপুর পায়ে নেচে যায় ঝুম বরষায়। কখনও ফাল্গুনের প্রথম প্রহরে হারমোনিয়ামে গায় রাঙ্গা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে,রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত-আকাশে, নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল ..... আর মুগ্ধ হয়ে শোনে সেই তরুণ প্রেমী। তার প্রানে জাগে ভালোবাসা বা প্রেমের হিল্লোল....
সব কিছুই একদিন ফুৎকারে শেষ হয়ে যায়। ভেঙ্গে যায় তাসের ঘরের মত তাদের প্রেমের ঘরখানা। ছোটবোন তাদের গোপন প্রেম ও অভিসারের বার্তা পৌছে দেয় মায়ের কানে...... কালবিলম্ব না করে সংস্কারপ্রেমী মা বাড়ি থেকে বের করে দেন সেই ভীনদেশী যুবককে। মৈত্রেয়ী তখন উপরের ঘরের জানালায়..... মূর্ছা যায় সে .....
সেই বেদনা বাঁজে এরপর বোনটির বুকে ...... শোনা যায় একদিন এই বেদনা নিয়ে আত্মহ্ত্যা করে সে বোনের প্রেমের অশ্রুজলের সমাধীতে.....

বালিকা মৈত্রেয়ী ১৯১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বরে জন্ম নিয়েছিলেন তিনি। সেপ্টেম্বর তার জন্ম মাস!
লা নুই বেঙ্গলী ও ন হন্যতে এই দুই বই নিয়ে আমার ভাবনাগুলি ও রবিঠাকুরের অমর সৃষ্টি দেবযানী ও কচ নিয়ে আমার মনের আরও কিছু লিখবো এই প্রত্যাশায় .....
এই লেখা চলিবেক ...
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:২৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




