তুমিতো আমারই, আর কারও নয়
গানটা প্রায়ই শুনি। আজও শুনছি। আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে বলতে গেলে রোজই শুনতাম। সিডিতে বা প্লেয়ারে বা মনে মনে গুন গুন করতাম সারাটাক্ষন।এই গানের রেশ জড়িয়ে থাকতো আমার হৃদয়ে অষ্ট প্রহর সারাবেলা। যাকে উদ্দেশ্য করে বা যাকে নিয়ে এই গানের রেশ আমার হৃদয়ে সুরভী ছড়াতো তার হৃদয়েও হয়ত ছুঁয়ে যেত এই গানের কথাগুলো একইভাবে। তবে সে ছিলো স্বল্পভাষী এবং ভীষন রকমের অন্তর্মুখী স্বভাবের একজন মানুষ। আর সে বাংলা গান তখন খুব একটা পছন্দও করতো না তার পছন্দের ছিলো যত রকম ইংলিশ বা হিন্দী উর্দু গানগুলিই। বাংলা গান তার মনে তখন একটু বিরক্তিরই সৃষ্টি করতো হয়ত তা তার আচরনে আমি ভালোই আঁচ করতে পারতাম। কিন্তু সে আমাকে কখনও কিছুতে কষ্ট দিতে চাইতো না তাই কিছু বলতোনা, চুপ করে শুনতো আমার এই গান । অপছন্দ স্বত্বেও যে এই চুপ করে থাকাটা সেও আমি খুব ভালো করেই জানতাম। আমি ছাড়া আর তার মনের খবর আঁচ করতে বা পুরোটাই জানতে পারবেই বা কে আর?
হ্যাঁ আমার ধারনা দূরে থেকেও হৃদয়ের অনেক কাছাকাছি বা একদম মনের গভীরে যদি কেউ কারো প্রবেশ করে ফেলতে পারে সে ছিলাম আমরা দুজনা। দু'জন দুটি প্রান্তের কৈশোর পেরিয়ে তারুন্য ছোঁয়া মানব মানবী। আমরা ছিলাম নেট জগতের আদিম যুগের প্রথম প্রজন্ম। টেলিফোনের তার জুড়ে কার্ডের নাম্বার ভরে তখন ইন্টারনেটে লগইন করতে হত। আজকের ছেলেমেয়েরা যে হাতে হাতে ফোন নিয়ে ঘুরছে। কথায় কথায় অডিও বার্তা ভিডিও বার্তা পাঠাচ্ছে তা কিন্তু মোটেও সম্ভব ছিলো না আমাদের সেসব দিনে। কত কীর্তি কান্ড করে কার্ড নিয়ে আসতে হত। সবখানে পাওয়াও যেত না সেসব কার্ড। তারপর মায়ের চোখ রাঙ্গানী সহ্য করে কার্ড কিনতে পারা বা মনিটরে বেশিক্ষন বসে থাকা নিয়ে গঞ্জনা সহ্য করা সেসব তো ছিলোই। তবুও আমরা এই পৃথিবীর সকল লাঞ্ছনা গঞ্জনা সহ্যকারী একাত্ম প্রাণ দুটি মানব মানবী সহ্য করে নিতাম সবকিছুই দুজনে দুজনের জন্য।
সে যাইহোক বলছি সেই আশ্চর্য্য এক ভালোবাসার গল্প। যে ভালোবাসা শুরু হয়েছিলো সুদূর অতীতে তবে তার শেষ কোথায় আজও জানিনা আমরা। প্রায় দুই যুগ আগে ইন্টারনেট দুনিয়ার সেই অজানা গ্রহে প্রবেশকারী এমনই দুজন বালক বালিকার দেখা হলো একদিন। সেই পরাবাস্তব জগতের অন্তর্জালে একে অন্যের সেই মোহময় নীল জানালায় উঁকি দিয়ে তাদের সে কি অবাক বিস্ময়! একে অন্যের দিকে চেয়ে প্রথম দেখাতেই মুগ্ধ হলো। মেয়েটার মনে হলো এই বুঝি সেই স্বপ্নের রাজকুমার যে ঠিক তার মনের মত সকল উপকরণে গড়া। ছেলেটার কি মনে হয়েছিলো জানিনা তবে মেয়েটার মনের খবর তো আমি জানি।মেয়েটা বললো-
-আচ্ছা তোমার নাম কি? ছেলেটা বললো-
- এ্যাডি।
- এ্যাডি এটা আবার কেমন নাম?
- এ্যাডি মানে আদিত্য। তার থেকে ছোট করে এ্যাডি
-বাহ! খুব সুন্দর নাম। আচ্ছা আদিত্য মানে কি?
- আমি কি জানি? যে রেখেছে তাকে জিগাসা করে দেখো।
- আরে আমি তাকে কোথায় পাবো? কে রেখেছে তোমার নাম?
- বাদ দাও আমার নামের কথা। তোমার নাম কি?
-শেহনীলা
- হুম। রাগ লাগলো মেয়েটার। এত সুন্দর একটা নাম শুনে কেউ শুধু হুম বলে? মেয়েটা বললো তুমি কি করো?
- স্টাডি এন্ড বিজনেস।
- বাপরে! স্টাডি করা বয়সেই বিজনেস!
- হুম বিজনেস। কেনো? করা যাবে না নাকি?
- না যাবে। কিন্তু আমি দেখিনি।
- তুমি কি করো? কিসে পড়ো?
- ধ্যাৎ পড়ালেখা তো আমার ভালোই লাগেনা।
- কি বলো! তাইলে কি ভালো লাগে?
- নাচতে।
- নাচতে! (এমন আশ্চর্য্য কথা মনে হয় জীবনেও শোনেনি ছেলেটা। আর মেয়েটা তো তার আৎকে ওঠা দেখে হাসতে হাসতেই শেষ।)
- হ্যাঁ নাচতে, আঁকতে, গান গাইতে শুধু লেখাপড়াটাই আমার ভালো লাগেনা জানো?
- আরে কি বলছো এসব? লেখাপড়া তো করতেই হবে .. নইলে......এভাবেই শুরু...... তারপর রোজ রোজ প্রতিদিন।
তখন মেয়েটার দীর্ঘ ছুটি চলছিলো। সকলা ৯টা বাঁজতেই মা অফিসের উদ্দেশ্যে বের হলেই দৌড়ে গিয়ে মনিটর অন। মেসেঞ্জারের নীল জানালায়-
- এ্যডিই ই ই ই ই
- হুম। বলো। আছি তো
প্রায় সাথে সাথেই ও প্রান্ত থেকে জেগে উঠতো এ্যডি নামের ছেলেটি। মেয়েটা খুবই অবাক হত! এই ছেলে কি ঘুমায় না! সে নাাকি বিজনেস করে? পড়ালেখাও! তাহলে অষ্টপ্রহর ডাকলেই সাড়া দেয় কি করে! এমনই নানা প্রশ্ন তখন মেয়েটার মনে।
- আচ্ছা তুমি ঘুমাও না?
- ঘুমাই তো।
- যখনই ডাক দেই তখনই কিভাবে জানতে পারো? তুমি কি ২৪ ঘন্টাই অনলাইনে থাকো নাকি? তুমি কখন কাজ করো? কখন পড়ালেখা? ছেলেটা চুপ। মেয়েটা অস্থির হয়ে ওঠে কথা বলো না কেনো? বলো না?
- কি বলবো?
- কি করে সব সময় আমি ডাকলেই সাড়া দাও?
- তোমার জন্য
- আমার জন্য?
- হুম তোমার জন্য অপেক্ষা করি আমি
চুপ করে যায় মেয়েটা। লজ্জায় লাল হয়ে যায় এ প্রান্তে। ছেলেটা মনে হয় দেখতে পায় না। নাকি পায়? জানিনা আমি। শুধু জানি রিনরিনে এক সুখের স্রোত বয়ে যায় বুকের গভীরে। সেই অনুভূতির প্রকাশ কি করে করে বা কোন ভাষায় লেখে এটাও জানা নেই আমার। আসলে মনের অনুভূতি কি করে ভাষায় লেখে আজও জানাই হলো না আমার।
- আচ্ছা তুমি কি খেয়েছো?
- কফি
- শুধু কফি? অবাক হয় মেয়েটা
- হুম শুধু কফি
- কেনো আর কিছু খাওনা?
- না শুধু কফি খাই? আর চিকেন। মাছ বা সব্জী কিছুই খাইনা আমি
- সে কি? মেয়েটারও শুধুই চিকেন ভালো লাগে মাছ বা সব্জী খেলে বমি পায় কিন্তু ভয়ংকর রাগী মায়ের উপরে কথা বলার সাধ্য আছে!মেয়েটা বলে-
- জানো আমিও একদম মাছ আর সব্জি খেতে ভালোবাসিনা কিন্তু আমার মায়ের ভয়ে কিছুই করার নেই।
- কেনো ? ভয় কিসের?
এই প্রশ্নে মেয়েটার মুখ মলিন হয়ে যায়। ছেলেটা মনে হয় বুঝতে পারে। বলে ঠিক আছে বলতে হবেনা একটা গান শোনাও তো-
মেয়েটার লজ্জা লাগে। সে গান শোনাতে পারে না বা কোন গানটা শোনাবে খুব সুন্দর খুব প্রিয় সেই গানটাই খুঁজে পায় না। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায় আবোল তাবোল কথার পিঠে কথা দিয়ে। শুরু হয় এই পৃথিবীর নেভার এন্ডিং এক আশ্চর্য্য লাভস্টোরীর পৃথিবীর দুটি প্রান্তে তাদের নিজেদের অজান্তেই। মেয়েটার মনে হয় এই বুঝি তার স্বপ্ন দিয়ে গড়া এক স্বপ্নের রাজকুমার আর ছেলেটারও মনে হয় হয়ত ওমন কিছুই। ছেলেটা জানতে চায়,
- তোমার বার্থডে কবে?
- অগাস্টে। তোমার?
- আমারও অগাস্টে......
-আরে কি বলো ? তুমি আর আমি তো একই রাশির তাহলে। তাই তো তোমাকে আমার এত ভালো লাগে। বলেই লজ্জা পায় মেয়েটা হয়ত চুপ করে যায়। আর ছেলেটা হয়ত মনে মনে হাসে। কে জানে? ছেলেটা বলে, গান শোনাও। মেয়েটা গান খুঁজে পায় আজ মনে মনে-
আকাশে সূর্য আছে যতদিন
তুমিতো আমারই, আর কারও নয়,
তুমি তো আমারই আর কারও নয়
রাত ছাড়া চাঁদ নেই নদী ছাড়া ঢেউ
তুমি কার জানিনা তো আমি ছাড়া কেউ
ফুটবে একটাও ফুল যতদিন
তুমি যে আমার যেন, এই মনে হয় !!
কথা ছাড়া সুর বলো আসে কাছে কার?
তুমি ছাড়া আমার কে আছে আর?
পৃথিবীও একদিন হয়ে যাবে শেষ
আমাদের প্রেম তবু হবেনা তো ক্ষয় !!
গান শেষে চুপ করে থাকে দুজনেই। চোখ দিয়ে জল পড়ে মেয়েটার। ছেলেটা বলে,
- লাভ ইউ নীলমনি...
মেয়েটা জল ভরা চোখে হা করে তাকিয়ে থাকে...
তার চোখ দিয়ে জল পড়া বন্ধ হয়ে গেছে.....
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০২১ বিকাল ৫:৫৭