তখন তো টি এন টি ফোন ছিলো। এই টি এন টি ফোনেই নেট লাগাতাম আমরা। আমার ঐ বন্দীদশার জীবনে সেটাই ছিলো একমাত্র মুক্ত হাওয়ার এক টুকরো খোলা পথ। তবুও কি সেখানেও কোনো রক্ষা ছিলো? মা যতক্ষন থাকতো না বাড়িতে মানে অফিসে থাকতো ততক্ষনের বুক ভরে শ্বাস নেওয়া। বাড়ি ফিরতেই মানে গাড়ির হর্ন শুনলেই তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে ভালোমানুষ সেজে বসে থাকা। আসলেই রাপুঞ্জেলের ঐ বন্দী রাজকন্যার সাথে বিশেষ কোনো পার্থক্য ছিলো না আমারও। তারপরও মা থাকতেন ডালে ডালে আর আমি পাতায় পাতায়। অফিসে যাবার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত ভালোমানুষী মুখ করে ঘুরে বেড়ানো আর দরজা পেরুলেই এক দৌড়ে সেই নীল জানালার কপাট খুলে বসা। অবশ্য একফোটাও সময় নিয়ে বসতাম না আমি। খুলেই তোমাকে চিল্লিয়ে ডেকে উঠতাম ....মমমমমমমমমমমমমমমমমমমমমমমম।
ওমনি তুমি সেই স্বপ্নের রাজপুত্র ঘুম থেকে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসতে। চিল্লিয়ে ডাকা বললাম কারন আমাদের সেই লিখে লিখে মনের ভাব আদান প্রদানের দিনে আমরা শুরু করেছিলাম এমন সব নানা রকম শব্দ বাক্যের গঠন যা আসলে যে কারো থেকেই আলাদা রকম ছিলো। তবে তুমি সাধু বাবা আজ এই কথা বললেই বলো এসব নাকি সবই আমার থেকেই তুমি শিখেছিলে। আচ্ছা ধীরে ধীরে সবই বলবো। তোমার শেখানো দুষ্টুমীগুলো, কোড, ইমোজী সবই। তুমিও কি কম দুষ্টু ছিলে? বিশ্বাস করো তুমি ছিলে আমার গুরু। কিন্তু তুমি উল্টা ভাবো আমিই আজীবন দুষ্টের শিরোমনি।
তো যাইহোক আমাদের খুব ইচ্ছে হয়েছিলো দু,জনের কন্ঠ শুনি। তাই নাম্বার আদান প্রদান হলো। আমি ফোন দিলাম তোমাকে মানে আমার স্বপ্নের রাজকুমারকে। ওপাশ থেকে ঠিক আমার স্বপ্নের রাজকুমারের যেমনটা ভয়েস হওয়া দরকার ঠিক তেমনটাই ভেসে এলো।
-হ্যালো নীলমনি.... কিন্তু নীলমনি তখন ভয়ে বা আনন্দেই বা অজানা অকারনে একদম চুপ।
- কথা বলো না কেনো নীলমনি? হা হা আজ সেই কথা মনে পড়ে বড় হাসি পাচ্ছে আমার। আমার চুপ করে থাকায় অস্থির হয়ে উঠছিলে তুমি। কিন্তু যদি সেদিন কান পেতে আমার বুকে আমার হার্টবিট শুনতে পেতে। আমি জানি ঠিক সেই স্বগীয় আনন্দ তুমি আর কখনই ভুলতে না। বুকের মধ্যে তো তখন ড্রাম পিটছিলো। কিন্তু সেই ড্রামের অদ্ভূত সেই শিহরিত আবেগের সূর ঠিক বুঝে যেতে তুমি। এই সূর সৃষ্টি হয়েছিলো শুধু তোমার জন্য। আর কারো জন্য নয়। তোমার গলা শুনেই আমার এত্ত এত্ত আদর লাগছিলো। এই কথা আমি মরে গেলেও তোমাকে বলিনি সেসব দিনে। কিন্তু আজ আর বলতে কোনো দ্বিধা নেই।
আচ্ছা তুমি আমার এত প্রিয় হয়ে উঠেছিলে কি করে বলোতো? আজও ভেবে পাইনা আমি। সেই আদি যুগের যেই চ্যাটরুমে আমাদের পরিচয় হয়েছিলো কত শত মানুষই তো ছিলো সেখানে কিনতু সবাইকে ছাপিয়ে তুমি কেনো আদরের হয়ে উঠলে আমার? তখন এত কিছু মনে পড়েনি আমার। আমরা দু'জন শুধুই বুঁদ হয়ে থাকতাম দু'জনাতে। কোনো চাওয়া পাওয়া নেই, কোনো দাবী দাওয়াহীন মুখোমুখি বসে থাকা। যত টুকুই আছে তাই নিয়েই সুখী থাকা। আচ্ছা এই যে আজকাল এত কিছু বদলে গেলো। ছোট ছোট ১২/১৩ বছরের ছেলেমেয়েদের হাতেও ফোন থাকে। এই যে এত প্রেম অকালে ঝরে যায়। আজ আছে কাল নেই হয়ে যায়।
ছোট ছোট ১৫/১৬ এর ছেলেমেয়েরা ডেট করতে গিয়ে মৃত্যুর মুখেও পড়ে যায় নিজেদের অজান্তেই। আর আমরা দিনের পর দিন কেউ কারো মুখটুকু না দেখেও মন দিয়ে মনটাকে ভালোবেসে ফেল্লাম কি করে? দেখা নেই , কথা নেই , একটু হাঁত দুটোও ছোঁয়া নেই শুধু অদৃশ্যমান এই মন দিয়ে আরেকটি মনের সাথে আষ্ঠে পিষ্ঠে জড়িয়ে যাওয়া। কি আশ্চর্য্য অদ্ভুত তাই না বলো? এত প্রতিকূলতা এত প্রতিবন্ধকতা তবুও সেই অদম্য হাহাকারের মাঝেও অন্তর্জালের একটি জানালার এপাশ আর ওপাশের দুটি অশান্ত হৃদয় শান্ত হয়ে যেত দু,জনের অনুভবেই।
তুমি বেশিভাগ সময় হু হা করতে আর আমি বক বক। সারাদিনের জমানো কথা বা আবোল তাবোল কথা উগরে দিতাম আমি তোমার হৃদয়ে। সেটাই ছিলো আমার সকল শান্তির আশ্রয়স্থল। তোমার বুকের মধ্যেখানে আজও একটা লুকানো সিন্দুকের গায়ে খোদাই করে লেখা আছে আমার নাম। নীলমনি নামে এক বিশাল সিন্দুক। এতটাই ভরে আছে যে সেখানে আর কোনো সিন্দুক রাখার জায়গাই নেই। সেই সিন্দুকে তালা বদ্ধ আছে সে সব দিন, সে সব কথা, সেই ভালোবাসার অনুভুতি আর ক্ষয়ে যাওয়া ক্ষন আর হাজার হাজার অশ্রুজল।
আমি বকবক করতাম আর তুমি বেশিভাগ সময় হু হা। আমি ছোট থেকে বরীন্দ্রসঙ্গীত গাই বটে কিন্তু তখনও আমি সেই গানটা শুনিনি।
এ পারে মুখর হলো কেকা ঐ। ও পারে নীরব কেনো কুহু হায়! আমি ছিলাম কেকা আর তুমি এই কুহু। অনেক পরে এই গানটা শুনতে শুনতে এমনই মনে হয়েছিলো আমার। এই জীবনে এতগুলো দিনের পরে কত অর্জন, কত সুন্দর ক্ষন কিন্তু সেই সোনালী সোনার আভার মোড়ানো অতীত যার খবর জানে শুধুই দুটি হৃদয়। আর এই পৃথিবীর কেউ জানে না।
এই কথাগুলির মানে নিশ্চয়ই জানোনা তুমি। যদিও আমাকে অবাক করে দিয়ে তুমি এমন সব বাংলা শব্দ লেখো আমি আকাশ থেকে পাতালে পড়ে যাই। আচ্ছা বলতে পারবে এই কথাগুলোর মানে কি? "অধীর সমীর পুরবৈয়াঁ নিবিড় বিরহব্যথা বইয়া, নিশ্বাস ফেলে মুহু মুহু হায়" জানি পারবেনা। আমিই বলে দেই, এর মানে হলো অধীর বাতাস পূর্ব দিক থেকে বয়ে আসছে নিবিড় বিরহ ব্যথা বয়ে নিয়ে, সেও নিশ্বাস ফেলছে মুহুর্মুহু মানে বারে বার। হ্যাঁ আমাদের বিরহ বুঝি এক জনমেও শেষ হবার নয়। তাই তো রবিঠাকুরের মত নজরুলও লিখেছিলেন তোমার আমার এই যে বিরহ এক জনমের নহে।
আচ্ছা সত্যি যদি পরজনম বলে কিছু থাকে। সেই জনমে তোমার কাছেই যাবো। আর কোথাও যাবোনা। সত্যিই দেখো এই কথার আর নড়চড় হবে। অনেক দেখলাম তো। শেষ পর্যন্ত নিজের কাছেই ফিরে যাওয়া। আর এই নিজের কাছটাই তো তুমি। আমার আয়না। মানুষ আয়নায় তো নিজেকেই দেখে তাইনা? আর আমি দেখি তোমাকে। বিশ্বাস করো আমি একটু অহংকারীও বটে। কখনও কারো কাছে দীনতা প্রকাশ করিনা। শুধু তোমার কাছেই আমি অহংকারহীন। হেরে যেতে আমার কোনো কষ্ট নেই। জানি তুমি একটু রাগ করেই বলবে হ্যাঁ ঐ পরজনমের আশাতেই থাকো। জানি আমার উপরে আসলে তোমার অনেক রাগ মানে ঠিক রাগ না অভিমান আছে শুধু ভালোবাসার কাছে তুমি এক পরাজিত সৈনিক তাই সেই রাগ আর দেখানো হয়না তোমার।
আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
'আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে .......
বর্যা তোমার অনেক প্রিয়। আমার ঠিক প্রিয় না তবে এমন আঁধারে কিংবা আলোকেও আমার মনে বহু বহু বার এই দূরাশাই হয়েছিলো। তুমি ছিলে আমার কাছে এক ফাগুনের ফল্গুধারা আর আমি অনেক অনেক দুরের তিথির ডোরে বাঁধা এক বন্দী রাজকন্যা। তিথিডোর শব্দটার মানে কি জানো? নিশ্চয় না।
ঋতুর দু ধারে থাকে দুজনে,মেলে না যে কাকলি ও কূজনে,
আকাশের প্রাণ করে হূহু হায়॥
আচ্ছা বলোতো, ঋতুর দু ধারে কি আজীবনই রয়ে যাবো আমরা? কাকলী আর কুজনের মিল কি কখনই হবে না আমাদের। আমার প্রাণেই সেই হাহাকার বাঁজে। জানিনা তার শেষ কোথায়।
যা বলছিলাম রবিঠাকুরের এই কঠিন অর্থবহ গানটাই আজ তুমি হয়ে আসে আমার হৃদয়ে। কিন্তু সেই বহুদিন আগে আমাদের এসব গানের ভাবার্থ বুঝবার ক্ষমতাই ছিলো না । আমরা দুজন কান পেতে শুনতাম যে একটাই গান সেই গানটাই আমাদের প্রানের গান ছিলো আর আসলে সেই গানটাই সত্যি আমাদের জীবনে। পৃথিবীও একদিন হয়ে যাবে শেষ আমাদের প্রেম তবু হবে নাতো ক্ষয়। আসলেই এই সকলের অগোচরে নীরবে নিভৃতে বয়ে চলা কোনো এক কিশোর কিশোরীর প্রেম যে এই ভাবেই অক্ষয় হতে পারে তা কি কেউ জানতো? নাকি জানে? নাকি জানবেই কোনোদিন?
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ৯:২৩