আমি ভেবেছিলাম আমার ডাকে এডি আর কোনোদিনই ফিরবে না। তবুও যখন ওকে একটাবার ডাকতেই সে চলে এলো। আমি বি্স্মিত হলাম। তার চাইতেও বেশি হলাম আনন্দিত। মনে হচ্ছিলো একটা আটকানো নিশ্বাস আমার বুকের মধ্যে থেকে ছাড়া পেলো। আমি বললাম,
- এডি আমি ভালো নেই। এডি চুপ করে রইলো।আমি আবারও বললাম।
- তোমাকে ছাড়া আমি ভালো নেই এডি। এডি এবার উত্তর দিলো।
- তোমাকে ছাড়া আমিও ভালো নেই নীলমনি।
আমি এডিকে জিগাসাই করতে পারলাম না কেনো এমন করলো সে। এডিও চুপ করে রইলো। আমি বললাম,
- আমি ভেবেছিলাম তুমি আসবেনা। এডি বললো,
- তোমাকে ছাড়া আমি যাবো কোথায়? আমার চোখে ভেসে উঠলো ঐ মেয়েটার শত শত চিঠি। ভালোবাসি বলা কথাগুলো।আমি বললাম,
- তুমি আমার সাথে এমন করলে কেনো?
- আমি তোমার সাথে কিছু করিনি নীলা। আমি তোমাকেই ভালোবাসি।
আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। বার বার জানতে চাইলাম এই কথাটা কতখানি সত্যি। এডি বললো,
- এই পৃথিবী যতখানি সত্যি তার চাইতেও বেশি সত্যি।
তবুও আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। আমি মানতেই পারছিলাম না আমার এডিকে অন্য কেউ বলবে ভালোবাসি আর সেও তার জবাব দেবে?
উফ ভাবতেই পারিনা আমি। আজ এতগুলো দিন পরেও সেই ভাবনাটা ভাবতে গিয়ে আর লিখতে গিয়ে হৃদয় ভেঙ্গে যাচ্ছে আমার।
কিন্তু কি করবো আমি? আমি তো নিরুপায়। এডিকে ছাড়া আমি বাঁচতেই পারছিলাম না। সেই কদিনের অভিমান, দুঃখ, কষ্ট ও বিসর্জনের চেষ্টায় ফেইল করেছিলাম আমি। এডি আমাকে একবারেই কোনো জোরাজুরি করেনি। আমার সিদ্ধান্তের উপরই ছেড়ে দিয়েছিলো সব। ঐ চিঠিগুলো দেখার পর বা ঐ মেয়েটার সাথে কনভারসেশন জানার পর আমি কি করবো না করবো সবই আমার উপরই ছিলো। এডির একটা অনেক বড় গুন দেখেছি আমি সে যতই বদরাগী আর রগচটা স্বভাব দেখার না কেনো কখনও আমার কোনো মতামত সিদ্ধান্ত ভালোলাগা বা মন্দ লাগায় খুব বেশি জোরাজুরি করেনি সে। হ্যাঁ দাবী খাঁটিয়েছে, ভালোবাসার দাবী কিন্তু এডি সব সময় আমার মতামত বা সিদ্ধান্তকে সন্মান দেখিয়েছে।
কিন্তু আমি মানতেই পারছিলাম না আমার এডি কি করে আমার ভালোবাসর অসন্মান করলো? কি করে আরেকটা মেয়েকেও বলতে পারলো ভালোবাসি? কিন্তু আমার তখন উভয় সঙ্কট। না পারছি ফেলতে না পারছি গিলতে। ওকে ছাড়া একটা দিন বেঁচে থাকাও যেমন অসম্ভব, ওকে নিয়ে এক মুহুর্ত বসে থাকাও দূর্বিসহ। সবখানেই ফুটে উঠছে ঐ মেয়েটাই। আমি এডির থেকে কিছুই জানতে চাইলাম না কেনো সে ওমন করলো। শুধু বললাম ঐ মেয়েটার সাথে আর কখনও কোনো যোগাযোগই করতে পারবে না। ওকে সাফ জানিয়ে দাও তুমি ওকে ভালোবাসো না। এডি বললো, আচ্ছা। জানিয়ে দিচ্ছি।
এডি ওকে জানিয়ে দিলো। ঐ মেয়েটাও হয়ত দুঃখ পেয়েছিলো তা তার পরের মেইলগুলোতে দেখেছি আমি। কিন্তু তখন আমার তার কথা চিন্তা করার সময় ছিলোনা। আমি তখন কোনো এক অন্ধ ক্রোধেই হয়ত উন্মত্ত্ব হয়ে উঠেছিলাম। যে কোনো মূল্যেই আমি ঐ মেয়ের অপসারণ চাইলাম এডির জীবন থেকে। মেয়েটা চলে গেলো।
কিন্তু রবিঠাকুরের মধ্যবর্তিনী গল্পের মত কাঁটা হয়ে ফুটে রইলো আমাদের মাঝে। আমি ঠিকই সেই আগের মতই এডির সাথে বসে থাকতাম ঘন্টার পর ঘন্টা কিন্তু সেই আগের মত প্রান খুলে কথা বলতে পারতাম না আর। বলতে চাইতাম এডি তোমাকে আমি কলিজার চাইতেও বেশি ভালোবাসি কিন্তু বলতে গেলেই কাঁটার খঁচখঁচ। আমার গলা বুঁজে আসতো। মন থেকে আর আসছে না সেই কথা সে বেশ বুঝতে পারতাম।
আমি বুঝলাম খুব অল্পদিনের মাঝেই যে আমি ভুল করেছি। যে বাঁশি একবার ভেঙ্গে যায় তা হাজার বার সারাই বা ঝালাই করলেও আর আগের মত সূর ওঠে না। আমি সারাদিন ওর সাথে শুধু ঝগড়াই করতাম। কথায় কথায় টেনে আনতাম ঐ মেয়েটার কথা। কাঁদতাম। চিল্লাতাম। যা ইচ্ছা তাই করতাম। প্রথম প্রথম এডি আমাকে বুঝাতে চেষ্টা করতো। বার বার বলতো সে দুষ্টামী করেছে। ভুল করেছে আর কখনই এমন হবে না। তবুও আমি মানতামই না মানে আসলেই মেনে নেবার আর চেষ্টা করিনি তা নয় কিন্তু মানতে পারতাম না। আমার গলা বুঁজে আসতো ওকে একটাবার ভালোবাসি বলতে গেলেই আমার কন্ঠরোধ হয়ে আসতো। আসলে আমি নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে গিয়েছিলাম এডির কাছে না।
শেষের দিকে এডি চুপ করে থাকতো। আমাকে বুঝাবার ধৈর্য্য এবং ক্ষমতাই বুঝি ওর লোপ পেয়েছিলো। তার নিজের জীবনটা দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না আসলে। আমি বার বার বলতাম আমি ভুল করেছি। আমি চলে যাবো। আমি আর তাকে ভালোবাসতে পারছি না। এডি বুঝতো আমি যা বলছি তা মিথ্যে না। আমি আমার কাছে পরাজিত হয়ে পড়েছি। এডির আসলে আর কিছুই করার নেই। ওর কলিজা কেটে দিলেও আমি আর মানতে পারবো না।
এইভাবে এক রাতে। তখন নিঝুম রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে আসছে। এডি বার বার বলছিলো ঠিক আছে তুমি যা চাও তাই হবে কিন্তু তোমাকে আমি কিছু কথা বলতে চাই। একটু ফোন দাও প্লিজ প্লিজ প্লিজ। আমি তখন আমার নিজের কঠিন সিদ্ধান্তে অবিচল। আমি চলে যাবো। যাবোই আমি আর কখনই ফিরবো না। আমি বার বার বলছিলাম, ভেবোনা একবার ফিরেছি বলে আবারও ফিরবো। তোমার যা খুশি তুমি করতে পারো। ঐ মেয়েটাকে আবার ডাকো। কিন্তু আমাকে আর দেখবে না কোনোদিন। সেসব দিনে আমার ভেতরে কি এক প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠেছিলো ভাবলেই ভয় পাই আমি। এডির কোনো কথা, কোনো প্রমিজ, কোনো অনুনয় বিনয়ই আমার কানে ঢুকতোনা, বুকে বাঁজতো না। আমি ক্রোধিনী পাগল হয়ে গিয়েছিলাম।
সেই রাতে এডি খুব অনুনয় করছিলো। ঠিক আছে চলে যাবে মেনে নিচ্ছি শুধু দুইটা মিনিটের জন্য একটাবার শুধু ফোন দাও। এটাই আমার শেষ অনুরোধ। আমার কি মনে করে দয়া হলো জানিনা। আমি ফোন দিলাম। ওমন বিশালদেহি রগচটা বদরাগী ছেলেটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। সে বার বার বলছিলো আমি যাই করি না কেনো শুধু একটা কথাই তুমি বিশ্বাস করো আর মনে রেখো আমি এই পৃথিবীতে শুধু একজনকেই ভালোবাসি সেই মেয়েটাই তুমি। আর কেউ না।
আমি চুপ ছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম তোমাকে আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু ওর কান্না দেখে হয়ত একটু ভড়কে গিয়েছিলাম। তাই কিছু বলিনি। এডি বলেই চলেছিলো আমার এই পৃথিবীর সবটুকু ভালো লাগা ভালোবাসা শুধু তোমাকেই ঘিরে। এখানে আসলে আর কেউ নেই। একজনও না শুধুই তুমি। কান্নায় ওর গলা বুঁজে আসছিলো। সব কথা ঠিকঠাক বুঝাও যাচ্ছিলো না। এডি শিশুর মত আকুল হয়ে কাঁদছিলো। কিন্তু তবুও আমার দয়া হলো না। আমার বিশ্বাস এতটাই ভেঙ্গে গিয়েছিলো যে আমি সেই বিশ্বাস আর জোড়া লাগাতেই পারলাম না।
আজ এতগুলো দিন পরে ভাবি কি করে এত নির্দয় হয়েছিলাম আমি!
এরপর ১২ বছর কেটে গেছে।
আজ এডি অনেক বড়।আমিও পার করে এসেছি জীবনের অনেকগুলো দিন মাস বছর। এডি আমার নাম দিয়েছে নিষ্ঠুর নীলমনি। সংক্ষেপে ইংলিশ হরফে এনএন।
আমাদের দুজনের নামের অদ্যাক্ষর দিয়ে একদিন আমাদের নাম আমরাই দিয়েছিলাম এনএন কিন্তু আজ এডি তার নিজের নামের অদ্যাক্ষরটি কেটে সেখানে বসিয়ে দিয়েছে নিষ্ঠুর কথাটা।
তাই এনএন এখন নিষ্ঠুর নীলমনি।
সেদিনের সেই আকুল হয়ে আমার কাছে আমাকেই ভিক্ষা চাওয়া ছেলেটা আজ গুরু গম্ভীর এক অফিসের কর্মকর্তা। তার সুকঠিন মুখ আর গুরুগম্ভীরের ব্যক্তিত্বের সাথে আজ থেকে এক যুগ আগে সেই রাত্রিতে আকুল হয়ে কাঁদা শিশুটিকে কেউ কখনও মিলাতেই পারবেনা।
এডির ধরা ছোঁয়া এবং ওর সকল রকম ছায়া থেকে খুব সুনিপুনভাবে দুরে সরিয়ে রেখেছিলাম আমি নিজেকে। এডি আমাকে কোথাও কখনও যেন আর খুঁজে না পায় তার সকল রকম সচেষ্টতার কোনো ত্রুটি ছিলো না আমার।
কিন্তু তারপরও হঠাৎএকদিন....
কিন্তু সে আরেক অন্য গল্প। অন্য কথকতা।
হয়ত কখনও লিখবো নয়ত না।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ বিকাল ৪:২৬