( এটা পাঁচ বছর আগের ঘটনা )
একদিন আমাদের ক্লাসে কয়েকটা মেয়ে ঘোষনা দেয় ওরা এবারের সামারে নরওয়েতে জব করতে যাবে । কেউ আগ্রহী হলে ওদের সাথে যেতে পারে, ওরা কয়েকজন গত সামারে গিয়েছিল।
জব হল হোম সার্ভিস,কোন কঠিন কাজ না। ( বুড়েদের বাসায় যেয়ে তাদের মেডিসিন দিতে হবে আর কারো কারো খাবার গরম করে দিতে হবে তিনবেলা।
কয়েকজন বল্ল, সামারে কাজ তো আমরা এখানেই করব, ওখানে যাব কেন?তখন তারা বর্ণনা করল।
সুইডেনের চেয়ে নরওয়েতে ডবল স্যালারী। ট্যাক্স সুইডেনের চেয়ে বেশী হলেও আমরা স্টুডেন্ট তাই বছর শেষে সেটা ফিরত পাব।থাকার জন্য কোম্পানি বাসা দিবে, গাড়ি দিবে ( গাড়ি শুধু কাজের সময়ের জন্য) শুধু খাবারটা নিজেদের।তুমি ফ্রীতে থাকতে পারছ ও অন্য দেশে কাজ করার তোমার একটা অভিজ্ঞতা হবে ।
আরেক জন প্রশ্ন করল ভাষা তো একটা প্রবলেম ? তারা বল্ল এটা খুব সমস্যা হয় না, (সুইডিশ) ইসবেঞ্চকা ও নর্ষ্কা ( নরওয়েজীয় ) ভাষায় কিছুটা মিল আছে আর কিছুটা ইংলিশকার সাহায্য নিতে পারব। এটা খুব সমস্যা হবে না ।
আমার কাছে আইডিয়াটা ভালই লাগল আর টাকার অঙ্কটা হিসাব করে দেখলাম ছয়সপ্তাহে ৫০ হাজার ক্রনার ( ট্যাক্সসহ )তবু তখনই কিছু বল্লাম না, কারন বাসা থেকে রাজী হবে কিনা জানি না। অনেক দেন দরবার করে বাসা থেকে অনুমতি আদায় করে ওদের বল্লাম আমিও যাব কখন কি করতে হবে তোমরা আমাকে জানিও।কারন তখন ছিল জানুয়ারী মাস।
ওদের সাথে একই কম্পানিতে এ্যপলিকেশন করলাম মার্চে । এটা নরওয়ের একপ্রান্তে তবে দূর্গম পাহাড়ি এলাকা না বলে সুগম পাহাড়ি এলাকা বলাই যায় । পাহাড় কেটে কেটে এত সুন্দর রাস্তা করেছে দেখতে খুবই মনোরম। ওসলো থেকে ট্রেনে যেতে ১২ ঘন্টা সময় লাগে।
এর পর ইন্টারভিও হল টেলিফোনে , বিভিন্ন কাগজ পত্র আদান প্রদান করা হল মেইলে, মে মাসের শেষে কন্ট্রাট পেপারে সাইন করি জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে আগষ্ট এর প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ওদের ওখানে আমরা কাজ করবো ।
দিন গড়িয়ে মাস পেরিয়ে অবশেষে আমাদের যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এল জুন এর পঁচিশ তারিখ আমরা ছয়জন সন্ধ্যা ছয়টায় স্টকহোমের অরল্যান্ডা থেকে মাত্র এক ঘন্টায় ওসলো এসে পোঁছলাম মানে সাতটায়। আমাদের ট্রেন ছাড়বে রাত সোয়া দশটায়। আমরা এয়ার পোর্ট থেকে বের হয়ে ট্রেন ষ্টেশনের পাশে একটা রেষ্টোরেন্টে রাতের খাবার খেয়ে আরো একটু ঘুরে ফিরে সারে নয়টার দিকে ট্রেনে যেয়ে বসলাম।
ঠিক সময়েই ট্রেন চলতে শুরু করলো।রাত বারোটা পর্যন্ত সবাই মিলে গল্প করলাম এর পর একে একে ঘুমের রাজ্যে পারি দিতে লাগলো বাসে ট্রেনে আগে যত যার্নি করেছি দিন বা রাত আমার ঘুম আসে না, আজকে তো মনে আরো নানা চিন্তা ———-আমরা ছয়জন ট্রেন ইষ্টিশন থেকে আলাদা হয়ে যাব, আমরা ভিন্ন ভিন্ন এলাকাতে কাজ করবো ও যে যেই এলাকাতে কাজ করবো তার বাসা সেই এলাকাতে, তবে আমাদের মেইন অফিস একটা সেখানে আমাদের দেখা হবে সকাল ও সন্ধ্যায় । অফিসে আমাদের তেমন কাজ নেই শুধু সকালে নাম সাইনইন করে এ্যাড্রেস ও গাড়ি নিয়ে আমারা চলে যাব, আবার বিকালে কাজ শেষে সাইন আউট করে গাড়ি রেখে আসব। অচেনা অজানা জায়গা, ভাষা একটা প্রবলেম , এ্যাড্রেস খুঁজে বের করতে পারবো তো!
চোখ বন্ধ করে এসব ভাবতে ভাবতেই,সকাল সারে দশটায় ট্রেন আমাদের গন্তব্যে এসে পৌঁছল।আমাদের রিসিপ করার জন্য কোম্পানী থেকে লোক আসবে, তাদের পেতে খুব বেশী দেরী হল না।আমাদের নেওয়ার জন্য ছয়জন লোকই এসেছে। উনাদের সাথে প্রাথমিক কথা বার্তার পর জানাল আমরা কে কার সাথে যাব উনারা আগেই এটা ঠিক করে রেখেছিলেন। এবার আমরা একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যার যার গাড়িতে যেয়ে বসলাম। মনটা খুব খারাপ লাগতেছিল,চোখে দিয়ে কিছু পানিও আস্তে চাচ্ছিল অনেক কষ্ট করেই আটকে রেখেছিলাম।
ট্রেন ইষ্টিশন থেকেও পয়তাল্লিশ মিনিট লেগেছে আমার বাসায় আস্তে আসার সময় ভদ্রলোক আমাকে আমাদের অফিস, সেন্টরুম দেখিয়ে নিয়ে এসেছে আরো অনেক কথাই হল কাজের ব্যাপারে। উনি বেশ উৎসাহ আর সাহস দিচ্ছিলেন, এতে কিছুটা ভালো ফিল করছিলাম ।
এই জায়গাটা সম্পর্কে ওদের কাছ থেকে কিছু জেনেছি আর নেট থেকে ও কিছু জেনেছি খুব সুন্দর জায়গা, পানিও খুব সুন্দর তবে মানুষ খুবই কম এখানে যারা থাকে বেশীর ভাগই বুড়ো মানুষ , রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে তার কিছুটা নিদর্শন পাচ্ছিলাম। আসলেই খুব সুন্দর।আর
বাসার ভিতর ঢুকে মনটা পুরো ভালো হয়ে গেল এত সুন্দর একটা বাসা!! উনি বাসার দরজা খুলে চাবিটা আমার হাতে দিয়ে মুচকি হেসে বল্লেন এটাই তোমার টেম্পুরারি সংসার । উনি আর কথা না বাড়িয়ে আগামী কাল অফিসে কথা হবে বলে চলে গেলেন।
এক বেড রুম,ড্রয়িংরুম,ছোট একটা কিচেন,আরো ছোট একটা ব্যালকনি । বাসার ডিজাইন থেকে ফার্নিচার সবই নিউ মডেলের এত সাজানো গোছানো ও যেখানে যে জিনিসটা প্রয়োজন সেখানে ঠিক সেটাই আছে ছোট বাসা ঘুরে দেখে মুগ্ধতায় আমার মন ভরে যাচ্ছে এত খুশী, এত খুশীতে বেড রুমে এসে যেই জানালার পর্দা সরিয়েছি ওমা গো এটা কি ?????????????——-বলে এমন বিকট এক চিৎকার দিয়েছি আমি নিজেও বুঝতে পারি নি।
কিছুক্ষন পর কিছুটা হাল্কা হয়ে ভয় আর আতংক নিয়ে জালানার পর্দাটা আস্তে আস্তে সরালাম চোখ কচলিয়ে ভালো করে তাকিয়ে দেখি অ —নে—-ক উঁচু কালো একটা পাহাড় আকাশটাকে ঢেকে ফেলছে কি ভয়ংকর! আমি এখানে থাকবো কেমন করে আমার সব ভালো লাগা নিমিষেই নিঃশেষ হয়ে গেল।অনেকক্ষন বিছানায় শুয়ে থাকলাম।বুকের ভিতর তখনো ধুক পুক ধুক পুক করছে। তবু উঠে ওয়াশ রুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলাম। ক্ষুধা বেশ লেগেছে টের পেলাম, আস্তে আস্তে কিচেনে গেলাম , সেখানে হাড়ি পাতিল গ্লাস প্লেট সবই আছে কিন্ত কোন খাবার নেই । আপেল,কলা,ব্রেড ,কর্ণফ্লেক্স, ওট এসব সাথে নিয়ে এসেছি, ট্রেনে সকালের নাস্তা কলা ব্রেড দিয়েই করেছি এখন আর এগুলো খেতে ইচ্ছা করছে না, তবু একটা আপেল খেয়ে নিলাম । মনে মনে ভাবলাম হাটতে হাঁটতে সেন্টরুমে যাই রাস্তা ঘাটও চেনা হবে কিছু খাবারও কিনে নিয়ে আসি।
তাছাড়া আজকেই বাজার করতে হবে কাল সকালে তো কাজই শুরু করবো যদিও দুইদিন ইন্ট্রো করবো। আসার সময় যে সুপারশপটা দেখেছি খুব বেশী দুরে না আমার ধারনা হেঁটে যেতে আমার পনর,বিশ মিনিট লাগবে । বাজারের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হলাম।
বের হয়ে মুক্ত হাওয়ায় প্রান ভরে নি:স্বাস নিলাম আর চারপাশটা এত এত সুন্দর মন প্রান জুরিয়ে যায় আমি আমার ভয়ের কথা ভুলে মনের আনন্দে সামনে আগাতে লাগলাম।
আমার বিস্বাস ঐ ভদ্রলোক আমাকে যেই রাস্তা দিয়ে নিয়ে এসে ছিলেন আমি সেই রাস্তা ধরেই যাচ্ছি কিন্ত পনের মিনিটের বেশী হাঁটার পর মনে হল আমি কেমন যেন একটা নিরিবিলি রাস্তায় চলে এসেছি রাস্তায় লোকজন তো নেই ই গাড়িও তেমন নেই আশে পাশে ঘর বাড়িও দেখা যাচ্ছে না। আরো কিছুক্ষন আগানোর পর নিজেকে আবিস্কার করলাম একেবারেই নির্জন এলাকা বড় বড় রাস্তা আছে শুধু, না আছে কোন মানুষ, না কোন গাড়ি আশে পাশে কোন বাড়ি ঘরের চিহ্নও নেই। সামনে তাকাই আকাশ ছোয়া কালো পাহাড় ডানে বামে যেদিকেই তাকাই আকাশছোয়া কালোপাহাড় ভয়ে দৌড় দেওয়ার জন্য পিছন ফিরেছি তাও দেখি আকাশ ছোয়া কালো পাহাড় কেমন যেন একটা আলো আঁধারি পরিবেশ, তাকালেই মনে হচ্ছে পাহাড় গুলো আমার দিকে ছুটে আসছে, এখনি আমাকে পিশে ফেলবে ভয়ে আমি তব্দা হয়ে গিয়েছি।পা যেন আটকে আছে, না পারছি সামনের দিকে আগাতে না পিছন দিকে। মরার আগে শেষ চেষ্টা তো করতেই হবে পিছন দিকে ফিরে এমন দৌড় দিলাম , কিন্ত আমার পা আটকে আটকে যাচ্ছে তবু থামছি না কোন দিকে তাকাচ্ছিও না কিন্ত কোন মানুষজন , ঘরবাড়ি পাচ্ছি না, মনে হচ্ছে আমি যেন পাহাড়ের চোরাবলিতে পরে হাবুডুবো খাচ্ছি — সর্ব শক্তি দিয়ে দৌড়াচ্ছি তো দৌড়াচ্ছি।
আমি জানি না কতটা সময় দৌড়িয়েছি তবে ভয় ও অস্থিরতার মাঝেও আমি আমার এলাকাতে কি ভাবে এলাম আমি জানি না,একটু পরিচিত মনে হলে দাড়ালাম হাঁপাতে হাঁপাতে হাঁটতে লাগলাম হ্যা এইতো আমার বাসা খুশীতে সামনের দিকে আগাচ্ছি আশেপাশে চেয়ে দেখি এখানকার সবগুলো বাড়ি একই মডেলের এখন বুঝতে পারছি না আমার বাসা কোনটা!! এত ভয়ে আমি বাসার নাম্বার ভুলে গিয়েছি ।অনেকটা হতাশ হয়ে ঘাসের উপর বসে আছি চোখ দিয়ে পানি পরছে আর ভাবছি, ( মোবাইল,নেট কোনটাই বাসায় ইন না করা পর্যন্ত কাজ করবে না )কি করবো এখন আমি !! হঠাৎ কারো পায়ের শব্দে তাকাতেই দেখি এক ভদ্রলোক আমার দিকেই আসছে আমি উঠে তার দিকে এগিয়ে যেতেই সেই জিগেস করল, কোন সমস্যা ?
আমি বল্লাম জী বিরাট সমস্যা ! আমি আজকেই এখানে একটা বাসায় উঠেছি, বাহিরে গিয়েছিলাম এখন বাসা চিনতেছি না নাম্বার ভুলে গিয়েছি।
- লোকটা হেসে, তোমার সমস্যার সমাধান তোমার হাতেই আছে । আমি অবাক হয়ে আমার হাতে!
- ভদ্র লোক, হ্যা তোমার হাতে , তোমার চাবির সাথে যে পোপ আছে এটাতেই তোমার বাসার নাম্বার লিখা আছে ।
কিছুটা লজ্জাই পেলাম- লোকটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাসায় আসলাম। কি আর করবো কলা, রুটি খেয়েই রাত পার করলাম। পরের দিন কাজ শেষে বাজার করে বাসায় ফিরলাম।এর পর বাকী দিন গুলো ভালোভাবেই পার করেছি। ছয় সপ্তাহ খুব বেশী সময় না কিন্ত অনেক শিক্ষা নিয়ে নিজ দেশ সুইডেনে ফিরত আসলাম।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৪৩