গাড়ির শব্দ শুনেই গ্রামের ছেলে মেয়ে বুড়ো সবাই এসে গাড়ির এক পাশে দাড়ায় আর সামনে দাড়িয়ে আছে, আছবার ম,বাবা, শাশুরী, পরিবারের আরো লোকজন । আছবা গাড়ি থেকে নেমে হাই হিলে ঠক ঠক শব্দ তুলে সামনে আগাতে থাকে মায়ের দিকে। হঠাৎ কিছু দেখে আছবার বুকের ভিতর ধ্বক করে উঠে পাদুটো থমকে যায়,সে নিজের অজান্তেই দিক পরিবর্তন করে আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় একটা তিন/সারে তিন বছর বয়সের বাচ্চার দিকে। ছেঁড়া-ফাটা একটা ফ্রক পরা কিন্ত বাচ্চাটা দেখতে খুব সুন্দর, এত মায়াবি চেহারা দেখলেই যে কারো আদর করতে ইচ্ছা করবে। আছবা বাচ্চাটার সামনে যেয়ে হাঁটু গেড়ে বসে বাচ্চাটার গালে হাত বুলিয়ে জিগেস করে , মেয়ে— তোমার নাম কি ?
এতক্ষন অবাক হয়ে, আছবার দিকে তাকিয়ে থাকা ছোট্ট মেয়েটা আছবার এই কথায় লজ্জা পেয়ে কোন কথা না বলে, মাথা নীচু করে নেয়। পাশ থেকে অন্য ছেলে মেয়েরা ওর নাম ফেলানী, বলেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠে!
- আছবা, (বেশ অবাক হয়ে)কেন, ওর নাম ফেলানী কেন? বাচ্চাগুলো আরো আগ্রহ নিয়ে বলে ওর মা ওকে ফেলাই চলে গিয়েছে তো তাই ওরে সবাই ফেলানী ডাকে।
একথা শুনে আছবা মনে খুব কষ্ট পায়, অতৃপ্ত মাতৃত্ব বোধটা মাথা চারা দিয়ে উঠে, আছবার চোঁখে পানি চলে আসে, কষ্ট করে চোঁখের পানি আটকে রেখে মনে মনে বলে, এত সুন্দর একটা মেয়েকে রেখে মা’টা কি ভাবে চলে গেল !!
আছবা , সাহেদকে বলে ল্যাগেজ থেকে কিছু চকলেট বের করে মতিকে দাও সব বাচ্চাদের দিতে, আছবা নিজের হ্যন্ডব্যাগ খুজে কয়েকটা চকলেট পেয়ে ফেলানীর ছোট হাত নিজের হাতে নিয়ে চকলেট গুলো দিয়ে বলে, মেয়ে তুমি আবার এসো আমার কাছে , আসবে তো মেয়ে?
ফেলানী কিছু না বুঝেই মাথা কাত করে সম্মতি জানায়। আছবার কিছুতেই এই মেয়েটাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছে না , তার পা চলতে চায় না, আছবার খুব কান্না পাচ্ছে সে দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে নিজেকে সামলাতে পারে না, আম্মু কেমন আছো’ বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে ।
এত বছর পর মেয়েকে পেয়ে চৌধুরী গিন্নীর চোখেও আনন্দের অশ্রু তিনি মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বলে, সোনা মা আমার, কত দিন পর তোকে পেলাম।সোনা মা তোমার শাশুরীকে সালাম করো, সাহেদের মাকে দেখিয়ে বলেন।
সাহেদ ততক্ষনে নিজের মা, শাশুরীর সাথে কুশল বিনিময় শেষ করে চৌধুরী সাহেবের সাথে কথা বলছে।
আছবা মাকে রেখে, টিশু দিয়ে চোখ মুছে শাশুরী মাকে সালাম দিয়ে জিগেস করে ,
- মা কেমন আছেন ?
- বউ মা আমি ভালো আছি, শাশুরী আছবাকে জড়িয়ে ধরে বলে , চল বউ মা ভিতরে চল ।
চৌধুরী সাহেব, সাহেদকে বলেন, হ্যা, হ্যা চল সবাই ভিতরে চল তোমরা ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে রেষ্ট নেও, রাতে সবাই মিলে কথা বলা যাবে।
ওরা নীচেই ওয়াশ রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসে । ততক্ষনে টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে , আছবার সব পছন্দের খাবার রান্না করা হয়েছে। করল্লা ভাজি, চিংরীমাছ দিয়ে কচুরলতি,টাকিমাছ দিয়ে মাসকলাই এর ডাল , পাবদা মাছের দোপেয়াজা আর সাথে আছে পোলাও, কোর্মার আয়োজন।
খেতে বসে এত পছন্দের খাবারও আছবার গলায় আটকে যাচ্ছে, নিচে নামতে যাচ্ছে না, সবাই আছবাকে বলে, এটা নেও,ওটা নেও সাহেদও কয়েকবার বলে হ্যা আছবা মাছের দোপেয়াজাটা খেয়ে দেখ খুব টেষ্টি হয়েছে কিন্ত আছবা কিছুই খেতে পারছে না, আছবার ভিতর বয়ে যাচ্ছে এক ভয়ংকর ঝড়। সে ঝড় আছবাকে উলট- পালট করে দিচ্ছে, আছবা আপ্রান চেষ্টা করছে সেটা প্রতিরোধ করার কিন্ত সবটা তো পারছে না , তার চেহারা ও আচরনে কিছুটা ছাপ দেখা যাচ্ছেই ।
এয়ারপোর্ট থেকে সারা রাস্তা হাসোজ্জ্বল ও প্রাণচঞ্চল ছিল আছবা, যার মুখে কথার ফুল ঝরছিল মনে হচ্ছিল বারো বছরের না বলা কথা গুলো এক মূহুর্তেই বলতে চাচ্ছে সেই আছবা কেমন যেন একটু ঝিমিয়ে গেল, তেমন কথা বলছে না, চেহারাটাও কেমন অন্ধকার লাগছে সেটা খেয়াল করে আছবার বড় বোন আতিয়া বলে ,
- আছবা তোর কি খারাপ লাগছে ?
- না আপু খারাপ লাগছে না, এই একটু টায়ার্ড লাগছে। আছবা আস্তে করেই বলে।
মেঝ ভাবি হাসতে হাসতে বলে , আচ্ছা যাও তোমাদের রুমে যেয়ে রেষ্ট নাও। সাহেদ, আছবার হাত ধরে বলে, হ্যা আছবা চল আমরা কিছুক্ষন রেষ্ট নেই। বড় ভাবি বলে, হ্যা তার আগে আমাদের বাচ্চাদের গিফ্ট গুলো দিয়ে যাও ওরা তোমাদের জন্য অনেক কষ্ট করেছে । সাহেদ লাগেজের চাবি গুলো ভাবীর হাতে দিয়ে বলে ভাবী এই নিন চাবি সবার জন্যই গিফ্ট আছে সবার নামও লিখা আছে আপনারা বের করে নিবেন।।
- ওকে তোমরা তাড়াতাড়ি এসো কিন্ত, আমরা তোমাদের জন্য অপেক্ষা করবো ।
- সাহেদ বলে হ্যা, রাতে সবার সাথে কথা হবে , সাহেদ আছবার হাত ধরে নিয়ে যায়
দরজা খুলে রুমে ডুকেই সাহেদ খুব আশ্চার্য হয়ে বলে, ওয়াও—- সাহেদ খুশীতে বিগলিত হয়ে বলে,আছবা দেখেছ! আমাদের রুমটা সেই রকমই করেই সাজিয়েছে ঠিক ১৩ বছর আগে এরকম করে সাজানো এই রুমেই আমাদের বাসর হয়েছিল।সাহেদ আছবার দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমীর হাসি দিয়ে বলে, দেখছ? সবাই চাচ্ছে আজকে আবার নতুন করে আমাদের বাসর হবে।আছবার দিক থেকে কোন সাড়া না পেয়ে সাহেদ আছবার কাঁধে হাত রেখে বলে,
-আছবা তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? গাড়ি থেকে নামার পরই তোমার চেহারা আষাঢ়ের মেঘলা আকাশের মত অন্ধকার করে রেখেছ কেন? কি হয়েছে তোমার?
আছবা মুখে কোন কিছু বলে না, শুধু অনুভুতিহীন চোখে সাহেদের দিকে তাকিয়ে থাকে। সাহেদ, আছবার এই চাহনী দেখে ভয় পেয়ে যায়। সাহেদ বলে, ওকে বলতে না চাইলে বলো না, এখন রেষ্ট নাও সাহেদ হাত ধরে আছবাকে খাটে বসিয়ে দিয়ে বলে, আছবা শুয়ে পরো রেষ্ট নাও কিছুক্ষন ভালো করে,আমি চাই না তুমি অসুস্থ্য হয়ে যাও বলে সাহেদ নিজেই বিছানায় গাঁ এলিয়ে দেয়। বড জার্নির পরে এতক্ষনে সত্যি তার খুব টায়ার্ড লাগছে। আছবাও অন্যদিকে পাশ ফিরে শোয়।
এত বড় জার্নি করে আছবাও খুব ক্লান্ত কিন্ত ওর ঘুম আসছে না এতদিন পর আপনজনকে কাছে পেয়েও আছবার কোন কিছুই ভালো লাগছে না। নিজের মেয়েটার কথা খুব মনে পরছে ,মেয়ের কথা মনে করে আছবার দুচোখ বেয়ে পানি পরে যাচ্ছে অনবরত, মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে না পারার ব্যাথাটা খুব বেশী যন্ত্রনা দিচ্ছে ফেলানীক দেখার পর থেকে ।আছবা নিজেই অবাক হচ্ছে কেন ওকে এত আপন আপন মনে হচ্ছে ,মনে হচ্ছে ওই আমার মেয়ে, ওকে বুকে জড়িয়ে নিতে পারলেই আমার বুকে এতদিনের জমে থাকা সব কষ্ট সব যন্ত্রনা দুর হয়ে যাবে । আছবা নিজেকে সামলাতে পারছে না,আছবা চোখ মুছে সাহেদের দিকে ফিরে আস্তে করে সাহেদের বুকে হাত রাখে, মুখটা সাহেদের কানের কাছে নিয়ে ফিস ফিস করে বলে, সাহেদ তুমি কি ঘুমিয়ে পরেছ? আমি একটা কথা বলতে চাই।
-সাহেদ চোখ না খুলে, ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে, আমি শুনছি তুমি বলো ।
- না সাহেদ এভাবে শুনলে হবে না এটা একটা সিরিয়াস কথা তোমাকে মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে ।
- তাহলে পরে শুনবো এখন তুমি ঘুমাও তো ।
- আমার তো ঘুম আসছে না, কিছু ভালও লাগছে না, খুব অশান্তি লাগছে আর কান্নাও পাচ্ছে ।
আছবা ফুপিয়ে, ফুপিয়ে কাঁদছে। কান্নার শব্দে সাহেদ আছবার দিকে ফিরে , হাত দিয়ে আছবার চোখের পানি মুছে দিয়ে,সাহেদ অবাক হয়ে বলে,
- কি হয়েছে আছবা ?
- আছবা তবু ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে ।
- সাহেদ তুমি কি বলতে চাও বল।তবু ফ্যঁচ ফ্যাঁচ কেঁদ নাতো তুমি তো জানো কারো কাঁন্না আমি সহ্য করতে পারি না! এত বছর পর দেশে এলে, ছয়মাস ধরে কত কল্পনা কত প্লান করেছ, সবার সাথে আনন্দ ফূর্তি করবে, এখন আস্তে না আসতেই মন খারাপ করে বসে আছো।
- আছবা কিছুটা আনমনা হয়েই বলে, সাহেদ তুমি দেখেছ কি সুন্দর মায়া মায়া চেহারা বাচ্চাটার ?
- তুমি কোন বাচ্চার কথা বলছো ওখানে তো অনেক বাচ্চাই ছিল ?
-ঐ যে — যে মেয়েটাকে আমি চকলেট দিলাম ওর নাম ফেলানী ।
- আমি বাবার সাথে কথা বলছিলাম তাই খেয়াল করা হয়নি।
- জানো ওর মা ওকে ফেলে চলে গিয়েছে। এত আদরমাখা মেয়েটাকে ফেলে কি ভাবে মা’টা চলে গেল আমি ভেবে পাচ্ছি না, এত খারাপ মা হয় কি করে! আমি হলে এটা কখনো পারতাম না,যদি আমার কাছে খাবার না থাকতো, আমার পরার একটি মাত্র ছেঁড়া কাপড় থাকত তবু আমি আমার মেয়েকে আমার বুকে ধরে রাখতাম।
- আছবা!! এটা নিয়ে তোমাকে এত ভাবতে হবে কেন? হয়ত পরিস্থিতি ওর মাকে বাধ্য করেছে ওকে ছেড়ে যেতে তুমি কিছু না জেনে ওর মাকে কেন দোষ দিচ্ছ! আর এটাই কি তোমার সিরিয়াস কথা! এর জন্যই তুমি আমাকে ঘুম থেকে ঢেকে তুলেছে!!
- না , এখন যেটা বলবো সেটা সিরিয়াস কথা ————-।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১ রাত ৩:২৮