মাদক ও এইচ আইভি ঝুঁকি ঃ প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
মাদকদ্রব্য ও মাদকাসক্তি -----
মাদকদ্রব্য, ভেষজদ্রব্য যা প্রয়োগে মানবদেহে মস্তিষ্কজাত সংজ্ঞাবহ সংবেদন হ্রাস পায় এবং বেদনাবোধ কমায় বা বন্ধ করে। সচরাচর ব্যবহৃত অধিকাংশ মাদকদ্রব্যই আফিমজাত। আফিম আসলে উদ্ভিদের পূর্ণতাপ্রাপ্ত অথচ অপক্ক শুঁটি থেকে আহরিত আঠালো নির্যাস। ক্যানাবিস থেকে উৎপন্ন মাদকদ্রব্যগুলির মধ্যে আছে গাঁজা,ভাং, চরস, মারিজুয়ানা,হাশিশ ইত্যাদি। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রেই মাদকদ্রব্যগুলির মুখ্য ভেষজক্রিয়া ঘটে। তামাক অন্যতম মাদকদ্রব্যের মধ্যেই পড়ে। তামাক এর শুকনা পাতা সাধারণত সিগারেট, বিড়ি,হুক্কা ও পান খাওয়ার জর্দায় ব্যবহৃত হয়। এরকম মাদকদ্রব্যে আসক্ত হওয়াকে বলে মাদকাসক্তি।
এইচ আই ভি এবং এইডস কি-------
বাঁচতে হলে জানতে হবে----টেলিভিশনের এই বিজ্ঞাপনটির মাধ্যমে আমরা জানতে পারি এইডস এর ছোট্ট একটি ধারণা। কিন্তু এতটুকু জানলে তো আর বেঁচে থাকা যাবে না। ভালভাবে বাঁচতে হলে এর সম্যক ধারণা থাকা অতীব জরুরী।এইডস হলো এমন একটি অবস্থা, যার ফলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।এতে করে দেহে অতি সহজেই বিভিন্ন অনুজীব আক্রমন করে দেহের অনাক্রম্য ব্যবস্থা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না।১৯৮৩ সালে সর্বপ্রথম ফরাসি বিজ্ঞানী লুক মন্টেগনিয়ার ঐওঠ সনাক্ত করেন।
মাদক ঝুঁকি------- প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
১. সারাদেশে মাদকের ভয়াবহ বিস্তার লাভ ঃ সমাজের কিছু নোংরা ও লোভী মানুষ নিজেদের ভোগবিলাস ও প্রাচুর্য বাড়াতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে ভয়ংকর সব নেশার উপকরণ। যাদের এসব নিয়ন্ত্রণ করার কথা,সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথাকথিত কিছু সদস্য সামান্য অর্থের বিনিময়ে সে কাজে আশকারা দিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের নিরব ভূমিকা পালন করা ছাড়া উপায়ই থাকছে না।
২ .মাদকের সহজলভ্যতা ঃ মাদক ব্যবসায়ীরা এখন দেশেও মাদকদ্রব্য তৈরী করছে,যার ফলে দেশের তরুণ-তরুণীদের হাতের নাগালে চলে এসেছে এসব মাদকদ্রব্য।যার ফলে মাদকের ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে।
৩. সামাজিক ও পারিবারিক অশান্তি ঃ বেকারত্ব দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। এটা সমাজের আরেকটি অভিশাপও বটে।পরীক্ষায় অকৃতকার্যতা,প্রেমে বিফলতা বা অন্য কোথাও হেরে যাওয়া কিংবা ঠকে গেলে মন খারাপ থেকে নেশার প্রবণতা তৈরী হয়।পরিবারে মা-বাবার ঝগড়াও সন্তানের মাদকাসক্তে পরিণত করতে পারে।
৪. পাশ্চাত্য কৃষ্টির অনুকরণ ঃ আমাদের দেশে পাশ্চাত্য কৃষ্টি অনুকরণে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। পাশ্চাত্যের জীবনযাত্রা অনুকরণের ফলে মাদকের ঝুঁকিও বেড়ে চলেছে।
৫.মূলহোতাদের মূলোৎপাটনে অপারগতা ঃ দেশে ভয়াবহভাবে মাদকের বিস্তার লাভ করেছে।মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন এখন আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে অধিকতর গতিশীল বটে, কিন্তু তার পরও মাদকের ছোবল বন্ধ হচ্ছে না।সীমান্ত দিয়ে অবাধে আসছে মাদকদ্রব্য। মাদক ব্যবস্থার যারা মূল হোতা তারা রাঘোববোয়াল এবং এরা সবসময় থেকে যাচ্ছে ধরাছোয়ার বাইরে। এদের মূলোৎপাটন করতে না পারলে এ সমাজকে মাদকের দংশনমুক্ত করা যাবে না।
৬.শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদক সেবনের প্রবণতা ঃ অনেক দক্ষ ও প্রবীণ পুলিশ অফিসারের বক্তব্য থেকে জানা যায় যে মাদকের নেশা ছড়িয়ে দেবার পেছনে উচ্চবিত্তের পরিবারের স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদেও অগ্রণী ভূমিকা আছে। বিভিন্ন সময়ে অনেক অভিভাবক বিভিন্ন মাধ্যমে অভিমত দিয়ে থাকেন যে মিডিয়া তথা টিভি, সিনেমা,উত্তেজক সাময়িক পত্রপত্রিকা প্রভৃতির অশুভ প্রভাবই বয়:সন্ধিকালের স্কুল ও কলেজে পড়া ছেলেমেয়েদেও মাদকাসক্ত করে তুলেছে। মাদক সেবনের ভাল জায়গা হলো স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়,হষ্টেল,পার্ক ইত্যাদি।
মাদকের ভয়াবহ চিত্র ঃ সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হলো,মাদকাসক্তরা শুধু তাদের আসক্তির পেছনেই বছরে খরচ করছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা।টাকার এই সংখ্যাটি জাতীয় উন্নয়ন বাজেটের এক চতুর্থাংশের বেশী হলেও মারাত্বক ক্ষতিসাধন ছাড়া জাতীয় উন্নয়নে এর কোনই অবদান নেই। তাছাড়া এই অর্থের সিংহভাগই আবার পাচার হয় বিদেশে। মাদকের ভয়াবহ বিস্তার সংক্রান্ত সা¤প্রতিক কালের এক বেসরকারী জরিপ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৭-২৫ বছরের তরুণদের মধ্যে মাদকসেবীর সংখ্যা ৮৭%,এর মধ্যে ছাত্রের সংখ্যা ৮৩%। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মাদক ব্যবসায়ীদের দাপট।একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৮০০০ কোটি টাকার সিগারেট পুড়ছে, যা দিয়ে দুটি যমুনা সেতু প্রতিবছর নির্মান করা যায়।তাছাড়া মাদকের কারণে বিভিন্ন অপচয় রোধ করতে পারলে দেশে সোয়া কোটি ক্ষুধার্ত লোককে পর্যাপ্ত আবার দেওয়া যাবে।
মাদক ঝুঁকি থেকে দেশকে বাঁচাতে করণীয় ঃ
১.মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রত্যেকটি বাহিনীকে আরও তৎপর হওয়ার জন্য আমাদের সকলের সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে হবে।
২. মাদক ব্যবস্থার মূলহোতা বা রাঘোববোয়ালদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
৩. সরকারের উচিৎ সারাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদক প্রতিরোধক সেল খোলা।
৪. সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা ও দেশীয় সংস্কৃতির চর্চার সঠিক পরিবেশ তৈরী করতে সরকারকে আরও নতুন নতুন পদক্ষেপ নিতে হবে।
৫. সীমান্ত এলাকা দিয়ে মাদকদ্রব্য যেন প্রবেশ না করে, তার জন্য সকল মহলকে আরও তৎপর হতে হবে।
এইডস ঝুঁকি ঃ প্রেক্ষিত বাংলাদেশ ঃ
১. বর্তমানে বাংলাদেশে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। যা আগামীতে এইডস ঝুঁকির মাত্রা আরও বাড়িয়ে তুলছে। এইডস মহামারী আকারে রূপ নিতে এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
২. সারা বিশ্বে বর্তমানে এইডস রোগীর সংখ্যা ৩৩.২ মিলিয়ন। প্রতিদিন নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে ৬৮০০ জন করে।মৃত্যুর সংখ্যা দৈনিক অন্তত ৫৭০০ জন। বাংলাদেশে সরকারী হিসাবে এইডস রোগীর সংখ্যা ১২০৭,যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে এই সংখ্যা প্রায় ৩০০০।উন্মুক্ত সীমান্ত, ভাসমান পতিতা, দারিদ্র্যতা এইডস ঝুঁকিতে সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে।
৩.দেশের হাসপাতালগুলোতে অজ্ঞতা ও অবহেলার কারণে এইডস প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
৪. এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত সুস্থ ব্যক্তির দেহে সঞ্চালিত হওয়ার মাধ্যমেও বাংলাদেশে এর প্রকোপ ধীওে ধীওে বাড়ছে।
৫. এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির সূচ, সিরিঞ্জ ও দাঁত চিকিৎসা এবং অস্ত্রোপাচারের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে সুস্থ ব্যক্তি এইডস দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে।
৬. যেসব মাতা-পিতা এইডস দ্বারা আক্রান্ত তাদের সন্তানদেরও এইডস হচ্ছে।
এইডস রোগের লক্ষণসমূহ ঃ ঐওঠঅওউঝ এর কোনো নির্দিষ্ট লক্ষণ নেই।এটা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়।ফলে রোগী বিভিন্ন রোগে তাড়াতাড়ি আক্রান্ত হয়। তবে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ধবংস হয়ে যাওয়ার কিছু লক্ষণ রয়েছে। এগুলো হলো-দ্রুত শরীরের ওজন কমতে থাকা, দীর্ঘমেয়াদী জ্বর-কাশি, শ্বাসকষ্ট,লাগাতার ডায়রিয়া, শরীরের গ্রন্থিগুলো ফুলে যাওয়া, খাবারে অরুচি, চামড়ায় বিবর্ণ ছাপ,শারীরিক দূর্বলতা ইত্যাদি।এগুলো যে শুধু এইডস হলেই হবে তা নয়, তাই নিশ্চিত হওয়ার জন্য রক্তের ঐওঠ টেস্ট করতে হবে।
এইডস ঝুঁকি কমাতে করণীয় ঃ
১. দৈহিক মিলনের সময় অবশ্যই কনডম ব্যবহার করতে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
২. এইডস কেন হয় এবং কি কি পদক্ষেপ নিলে এড়ানো যায়, এ ব্যাপারে গনমাধ্যমে আরও খোলামেলা আলোচনা করতে হবে।
৩. ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
৪. সম্মিলিতভাবে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধ করতে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
শেষের কিছু কথা ঃ
মাদক ও এইডস ঝুঁকি বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম অন্তরায়। বাংলাদেশের তরুণ সমাজই সবচেয়ে এই ঝুঁকির মধ্যে আছে।পৃথিবীর মানুষ যদি অবিকৃত ও সত্য ধর্মকে জানে,বিশ্বাস করে ও সে ধর্মানুযায়ী নিজেকে পরিচালিত করে, তবে অবশ্যই এইডস থেকে বাঁচতে পারবে এবং এইডস নির্মূল হবে। মানবজাতি যদি ইতিহাস অনুসন্ধান ও গবেষণায় অধিকতর মনোযোগী হয় এবং তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের শিক্ষায় অধিকতর মনোনিবেশ করে, তবে অবশ্যই সত্য, সুন্দর ও কল্যাণকে খুঁজে পাবে এবং সত্য ধর্মের আলোকে জীবন পরিচালনার মাধ্যমে এইডস ও মাদকাসক্তি নির্মূলে সক্ষম হবে। দেশের যুবসমাজ যদি ধর্মবিমুখ, ভোগবাদী ও বস্তুবাদী বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্ধ অনুকরণ করে, তবে অচিরেই এইডস ও মাদকাসক্তি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়বে,এতে কোন সন্দেহ নেই এবং বাংলাদেশকে ঐতিহাসিক ধবংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করতে হবেই।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




