বিশ্ব চারুকলার সবচেয়ে বড় মেলা বসে ইতালির ভেনিসে। যা তামাম দুনিয়ার শিল্পামোদিদের কাছে বিয়েন্নালে দি ভেনেসিয়া বা ভেনিস বিয়েন্নালে নামে পরিচিত। ১৮৯৫ সাল থেকে শুরু হওয়া ভেনিস বিয়েন্নালের আয়োজন করা হয় প্রত্যেক বেজোড় বছরে। অর্থাৎ প্রতি দু’বছরে একবার।
২০১৫ সালের বিয়েন্নালে দি ভেনেসিয়া শুরু হয় ৯ মে, শেষ হয় ২২ নভেম্বর, রোববার। এটি ৫৬তম ভেনিস বিয়েন্নালে। এ বছর ৮৯টি দেশের জাতীয় চারুশিল্প স্থান পেয়েছে ভেনিস বিয়েন্নালে। ২০১১ সালের ভেনিস বিয়েন্নালে প্রথম বারের মতো বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করে। সে সময় ঢাকার বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টসের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ থেকে ৫ জন শিল্পী এসেছিলেন। এরপর ২০১৩ সালে বাংলাদেশ দ্বিতীয় বারের মতো অংশগ্রহণ করে। তখন ঢাকা থেকে এসেছিলেন ৭ জন শিল্পী এবং রোম থেকে একজন প্রবাসী শিল্পী যোগ দিয়েছিলেন তাদের সঙ্গে। ২০১৫ সালের বিয়েন্নালে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করেনি।
রোববার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় আমরা ওই দিনটি বেছে নিলাম বিয়েন্নালে দি ভেনেসিয়ায় যাওয়ার জন্য। বেলা তিনটার দিকে রওনা করলাম ভেনিস বাংলা স্কুলের সভাপতি সৈয়দ কামরুল সরোয়ার, চ্যানেল আই ইউরোপের বিশেষ প্রতিনিধি এমদাদুল হক এমদান ও তার মেয়ে ফারজানা হক তুরিন’সহ।
বিয়েন্নালের প্রধান প্যাভিলিয়নগুলো তৈরি করা হয় ভেনিসের জারদিনি এবং আরসেনালের বিস্তর এলাকাজুড়ে। আমরা অনেকগুলো প্যাভিলিয়ন ঘুরে ঘুরে দেখলাম। বিভিন্ন দেশের চারু শিল্পীদের সমসাময়িক শিল্পভাবনা আমাদের মুগ্ধ করলেও মনের মধ্যে একটা অপূর্ণতা অনুভব করতে থাকলাম। কিছুতেই মনের খচখচানি দূর করতে পারছিলাম না। অবশেষে প্যাভিলিয়ন থেকে বেরিয়ে ইনফরমেশন ডেস্কে গেলাম। জানতে চাইলাম এ বছর বাংলাদেশের কোনো প্যাভিলিয়ন নেই কেন? ২৫/২৬ বছরের এক ইতালীয় যুবক কমপিউটরে খুটখুট করে বললো, কে বলেছে বাংলাদেশের প্যাভিলিয়ন নেই! সে এক টুকরো কাগজে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের ঠিকানা লিখে দিল খচখচ করে। আমরা তো খুশিতে বাকবাকুম। তাকে ধন্যবাদ বলারও সময় পেলাম না। ঠিকানা হাতে ছুটতে শুরু করলাম ‘ভিয়া গারিবালদির’ পথে। কিন্তু হায়... সেখানে গিয়ে আমাদের উচ্ছ্বাস আর গদগদ ভাব পিঁপড়ে কাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। আমরা সবাই প্রচণ্ড হতাশা এবং রাগ অনুভব করলাম ভেতরে ভেতরে।
ভয়াবহ মেজাজ খারাপ নিয়ে ফিরে এলাম তথ্য কেন্দ্রে। আমাদের বিস্ফোরন্মুখ চেহারা দেখে ছেলেটা কিছু একটা আন্দাজ করতে পারল। সে আগ বাড়িয়ে বলল, খুঁজে পাওনি তোমাদের দেশের প্যাভিলিয়ন? আমি বললাম, তুমি কি নিশ্চিত জেনে ঠিকানাটা দিয়েছ? সে কোনো কথা না বলে আবার তার কমপিউটরে খুটখুট শুরু করল। ৩০ সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে মাথা তুলল ছেলেটা। চেহারা কাচুকাচু করে বলল, দুঃখিত আমি তোমাদের যে ঠিকানা দিয়েছি ওখানে ২০১১ সালে বাংলাদেশের প্যাভিলিয়ন ছিল। ছেলেটা তার প্রতিটি নিঃশ্বাসের সঙ্গে একবার করে ‘সরি’ বলতে থাকল। আমাদের খুশি করার জন্য বিয়েন্নালের ছোট ছোট ক’টা সুভেনির এগিয়ে দিয়ে বলল, এগুলো বিক্রি করা হয়, কিন্তু আমি তোমাদের উপহার দিচ্ছি, দাম দিতে হবে না। ছেলেটার বিনয় এবং চেহারার বেহাল দশা দেখে আর কিছু বলতে ইচ্ছে করল না। আমরা তথ্য কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে এলাম।
ততক্ষণে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। অনেকটা পথ হাঁটাহাঁটি করে কিছুটা ক্ষুধা অনুভব করলাম। আরসেনালের প্রধান ফটকের সামনে আমার বন্ধু আবদুস সালাম বাদলের একটা বিখ্যাত ইতালিয়ান রেস্টুরেন্ট আছে। আমরা সেখানে গেলাম। রাতের পেটপূজা ওখানেই সাঙ্গ করলাম।
১৮৯৫ সালে প্রথম ভেনিস বিয়েন্নালে শুরু হয়। সে সময়ের রাজা উমবেরতো এবং রানী মারগেরিতা সাভোইয়া এই আন্তর্জাতিক শিল্প মেলা প্রবর্তন করেন। ভেনিসের জারদিনি নামক স্থানে ৩০ দেশের জাতীয় প্যাভিলিয়ন দিয়ে শুরু করা বিয়েন্নালে পরবর্তীতে আরসেনালে’য় সম্প্রসারণ করা হয়। এর আয়োজন ভার গ্রহণ করে ভেনিসের সিটি পরিষদ। শিল্প সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিকভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিনিধিত্বকারী দেশগুলোর বাইরে বাংলাদেশের মতো আরও অনেক দেশ আছে যেগুলো জারদিনি বা আরসেনালের মূল ভেন্যুতে প্যাভিলিয়ন করতে পারে না। কিউরেটররা খুব বেশি খরচ করতে চায় না, ভালো স্পন্সর পাওয়া যায় না, রাষ্ট্রও নিজ খরচে প্যাভিলিয়ন করে না। এসব দেশের শিল্প নিয়ে ভেনিসের অন্যান্য স্থানে (জারদিনি ও আরসেনালের বাইরে) কম ভাড়ার ঘর বা পৌরসভার অব্যবহারিত বাড়িতে প্যাভিলিয়ন করেন কিউরেটররা। ২০১১ সালে এবং ২০১৩ সালে দু’জন ইতালীয় কিউরেটর ভেনিস বিয়েন্নালে বাংলাদেশের প্যাভিলিয়ন করতে আগ্রহী হলেও ২০১৫ সালে তারা খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি। ২০১১ সালের বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন করা হয়েছিল জারদিনির ভিয়া গারিবালদিতে এবং ২০১৩ সালের প্যাভিলিয়ন করা হয়েছিল যাত্তেরে নামক স্থানে। এ বছর ভেনিস বিয়েন্নালে বাংলাদেশের প্যাভিলিয়ন না হওয়ার কারণ সম্পর্কে স্পষ্ট করে কেউ মুখ না খুললেও অভিজ্ঞজনরা ধারণা করেন, বাংলাদেশ দূতাবাস কূটনৈতিকভাবে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। আগ্রহী স্পন্সর এবং কিউরেটর পাওয়া যায়নি, দূতাবাস থেকে সন্ধানও করা হয়নি। ভেনিসে নিযুক্ত বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত অ্যাডভোকেট জানালবেরতো এসকারপা বাসতেরি’র কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কিছু জানেন না বলে জানিয়েছেন। অপর একটি সূত্রে জানা যায় ২০১৩ সালের বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে যে শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের একজন ছিলেন অভিবাসী বাংলাদেশি শিল্পী। মূলত ওই শিল্পীর অনাগ্রহে এ বছর গতবারের কিউরেটর বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন করতে আগ্রহ দেখাননি। পক্ষান্তরে বাংলাদেশকে এড়িয়ে একই জায়গায় (যাত্তেরে) রোম প্রবাসী ওই শিল্পীর একক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।
উল্লেখ্য, প্রবাসী ওই শিল্পী বাংলাদেশের একজন সাবেক রেলমন্ত্রীর (কালো বিড়াল) আশীর্বাদপুষ্ট বলে পরিচিত।
চারুশিল্প দিয়ে ভেনিস বিয়েন্নালে শুরু করা হলেও পরবর্তীতে যুগের চাহিদা মোতাবেক এর সঙ্গে শিল্পের আরও কিছু শাখা প্রশাখা যোগ হয়। ১৯৩০ সালে যোগ করা হয় আন্তর্জাতিক সংগীত উৎসব। ১৯৩৪ সালে আন্তর্জাতিক থিয়েটার উৎসব। ১৯৩৪ সালে আন্তর্জাতিক চলচিত্র উৎসব। যা বর্তমানে কানের পরেই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসব হিসাবে বিশ্বজুড়ে সমাদ্রিত। ২০১৪ সালের ভেনিস চলচিত্র উৎসবে প্রথম বারের মতো একজন প্রবাসী বাংলাদেশি নির্মাতার ছবি প্রদর্শন করা হয়। ইতালিতে চিত্রায়িত ১৮+ (এইট্টিন প্লাস) নামের ওই চলচিত্রের নির্মাতা কাজী টিপু। ১৯৮০ সালে ভেনিস বিয়েন্নালে যোগ করা হয় আন্তর্জাতিক স্থাপত্য শিল্প উৎসব। ১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক নৃত্য উৎসব এবং ২০০৯ সালে শিশুদের জন্য বিশ্ব আনন্দ মেলা।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৮ শতকে ভেনিস বিয়েন্নালের জন্ম হলেও মূল পরিবর্তন পরিবর্ধন, যোগ বিয়োগ প্রায় সবই সংঘটিত হয়েছে ১৯ শতকে। ১৮ শতকের শেষের দিকে ভেনিস বিয়েন্নালের সূচনা করা হয়েছিল সে সময়ের সমসাময়িক শিল্পের বাজার সৃষ্টি করা এবং শিল্পীদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করার জন্য। শিল্পীরা যেন তাদের কাজ ভালো দামে বিক্রি করতে পারেন, আর্থিকভাবে ভালো থাকেন সে জন্য সেল্স অফিস নতুন নতুন ক্রেতা খুঁজে বের করতো। একাজে সেল্স অফিসকে ১০ ভাগ কমিশন দিতে হতো। পরবর্তীতে এই ধারায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বিয়েন্নালেকে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপ দেয়া হয়েছে। এর উদ্দেশ্য লক্ষ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এনে আরও বেশি উন্মুক্ত এবং উদার নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এখন ভেনিস বিয়েন্নালে মানে বিশ্ববাসী বোঝে সমসাময়িক শিল্প বিনিময়। পারস্পরিক ভাব এবং চিন্তার বিনিময়। আন্তরিকতা এবং বন্ধুত্ব বিনিময়। ভেনিস বিয়েন্নালে এখন বিভিন্ন জাতী গোষ্ঠী, বিভিন্ন ভাষাভাষি মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে তোলার এক বড় মাধ্যমে পরিণত হয়েছে।
ভেনিসের জারদিনি এবং আরসেনালের স্থায়ী প্যাভিলিয়নগুলো মূলত নিয়ন্ত্রিত হয় নিজ নিজ দেশের শিল্পমন্ত্রণালয় দ্বারা। স্থায়ী প্যাভিলিয়ন নির্মাণের ক্ষেত্রে ধনী দেশগুলোর অর্থ এবং রাজনৈতিক, কূটনৈতিক প্রভাব ব্যাপক ভূমিকা রাখে। সমালোচকদের ভাষায় ১৯ শতকে স্থায়ী প্যাভিলিয়নের জন্য রীতিমতো স্নায়ুযুদ্ধ করা হতো। এখনও বিয়েন্নালের তহবিল গঠন এবং গুরুত্বপূর্ণ দেশের প্যাভিলিয়ন নির্মাণ নিয়ে পর্দার আড়ালে অনেক হিসাব নিকাশ এবং রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করে।
২০১৫ সালের ভেনিস বিয়েন্নালে নির্মিত মার্কিন প্যাভিলিয়নের ৫টি গ্যালারিতে শিল্পী জন জোনাসের কাজগুলো আমাদের মুগ্ধ করেছে। তার ডিজিটাল এবং শব্দ বিষয়ক চিত্রগুলো অসাধারণ। জার্মানির প্যাভিলিয়নে শিল্পী ওলাফ নিকালাই অভিপ্রায় এবং বিদ্রোহের দাপুটে কাজ তুলে ধরেছেন। ড্যানিশ শিল্পীর পোন্তে দেল্লা দোগানা এবং বেলজিয়াম প্যাভিলিয়নের রাজনৈতিক শিল্প ছিল সত্যিই ভালো লাগার মতো। তবে যে যতো যাই বলুক, শিল্পের রাজমুকুট আমি ইতালিকেই দিতে চাই।
এবছরই প্রথম ভেনিসে বিয়েন্নালের অংশ হিবাসে ৬ মাসের জন্য একটি অস্থায়ী মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। প্রায় ৪০ বছর আগে বন্ধ করে দেয়া একটা জরাজীর্ণ ক্যাথলিক গির্জা সংস্কার করে সুইডেনের শিল্পী ক্রিসটোফার বুশেলের ডিজাইনে মসজিদটি নির্মাণ করা হয় ভেনিসের কানারেজ্জোয়। সান্তা মারিয়া দেল্লা মিজেরিকোরদিয়া নামের পরিত্যক্ত গির্জাটি সংস্কার করা হয় কাতার সরকারের অর্থায়নে।
মসজিদটি খোলার পর দু’সপ্তাহও টিকতে পারেনি। স্থানীয় ক্যাথলিকদের ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার মুখে প্রশাসন ওটি বন্ধ করে দেয়। তারা জানায় গির্জা সংস্কার করে মসজিদ নির্মাণকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি স্থানীয় ক্যাথলিক বাসিন্দারা। আর তাই সংঘাত সংঘর্ষ এড়াতে প্রশাসন ওটি বন্ধ করে দেয়।
উল্লেখ্য, অতীতে প্রায় এক হাজার বছর ধরে ভেনিস স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ছিল। তখন ভেনিসের বন্দরে ব্যবসায়িক কারণে মুসলমানদের ব্যাপক আসা-যাওয়া ছিল। ওই সময় ভেনিসে মুসলিম সংস্কৃতির অনেক কিছু গড়ে ওঠে, যা পরবর্তীতে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। বরং অনেক কিছুই ধ্বংস করা হয়েছে। এসব ঘটনার স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য চলতি বছরের শুরুতে কাতার সরকার ভেনিসের সিটি পরিষদকে প্রস্তাব দিয়েছিল রিয়ালতো ব্রিজের কাছে একটি মুসলিম সংস্কৃতির জাদুঘর নির্মাণ করার জন্য। কিন্তু বিভিন্ন সংস্থার বিরোধিতায় তা করা সম্ভব হয়নি।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:৫৭