somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শুধু ক্ষমতা ধরে রাখার পরিকল্পনা না করে জলবায়ুজনিত ক্ষতির মুখ থেকে দেশ বাঁচানোরও পরিকল্পনা করা দরকার

১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


২৩ জানুয়ারি ২০১৬ আমেরিকায় মাত্র কয়েক ঘণ্টার তুষারপাতে জনজীবন মুহূর্তের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে। সেখানে ২০ জনেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। শহরজুড়ে মানুষজন ঘরবন্দী হয়েছিল ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময়। হাজার হাজার ফ্লাইট বাতিল করতে হয়েছে। এর প্রভাব গোটা পৃথিবীজুড়ে পড়তে দেখা গেছে। এত বেশি তুষারপাত হয়েছে যে, অধিকাংশ জায়গায় এক মিটারেরও বেশি তুষার জমতে দেখা গেছে। অথচ মাত্র কিছুদিন আগে, ডিসেম্বরের শেষ মাথায়, বড়দিনের সময় নিউইয়র্কের জনগণকে দেখা গেছে হাফপ্যান্ট টিশার্ট পরে ঘুরতে। যা বিগত হাজার বছরেও কেউ কল্পনা করতে পারেনি। ডিসেম্বরে সাধারণভাবে নিউইয়র্কের তাপমাত্রা থাকার কথা শূন্যের নিচে, সেখানে গেল বছর ওই সময়ের তাপমাত্রা ছিল ২০ ডিগ্রির উপরে। ইউরোপের অবস্থাও প্রায় অভিন্ন। ইতালির পালেরমো অঞ্চলে দেখা গেছে বড়দিনের দিন যুবক-যুবতীরা সাগরপারে গিয়ে খালি গায়ে বল খেলছে, পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি করছে। এতদিন যা কোনো ফিকশন লেখকও কল্পনা করতে পারেনি, তা বাস্তবে হতে দেখা গেছে।
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ১২ দিনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা শেষ করতে হয়েছে ১৪ দিনে। এবারের সম্মেলনের সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে দেখানো হচ্ছে একটি খসড়া চুক্তি। চটকদার শব্দে ঠাসা ওই খসড়া চুক্তিতে বলা হয়েছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি দুই ডিগ্রির নিচে ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অথচ প্যারিসের কপ-২১ সম্মেলনে খসড়া চুক্তি করা হলেও তা অনুমোদন করা হয়নি। বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের এপ্রিলে জাতিসংঘ আরেকটি সম্মেলন আহ্বান করবে এবং বিশ্বনেতাদের সম্মতিতে সেখানে চুক্তিটি অনুমোদন করা হবে। যদি ২০১৭ সালে চুক্তিটি সঠিকভাবে অনুমোদন পায় তবে ২০১৮ সাল নাগাদ তা কার্যকর করার প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। সুতরাং খসড়া চুক্তির সাফল্য নামে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে যা প্রচার করা হচ্ছে, তা যে ভালো ভালো কিছু শব্দে ঠাসা একটা উঁইপোকার ঢিবি সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা যদি নির্মোহ বিবেচনায় যাই তবে বলতেই হয়, প্যারিস সম্মেলনের যে সাফল্য প্রচার করা হচ্ছে তা আসলে কোনো সাফল্য নয়, সাফল্য নামের চালবাজি মাত্র। কারণ ২০১৭ সালের বৈঠকে খসড়া চুক্তি যে যথাযথভাবে অনুমোদন পাবে তার নিশ্চয়তা কী? সে সময় বিশ্বনেতারা যে নতুন কোনো বাহানা সৃষ্টি করবে না তার গ্যারান্টি কী? সুতরাং ২০১৭ সালের আগে কপ-২১ সম্মেলনের সাফল্য যদি উল্লেখ করতেই হয় তা হলো একটি খসড়া চুক্তি করা সম্ভব হয়েছে, যা কোপেনহেগেনসহ অতীতের কোনো সম্মেলনে সম্ভব হয়নি। খসড়া চুক্তি নামের এ সাফল্য যতটা না কপ-২১ এর, তার চেয়ে অনেক বেশি ফরাসি কূটনীতিকদের।
প্যারিস সম্মেলনে জলবায়ুজনিত ক্ষতিপূরণ হিসেবে বাংলাদেশ ৬৯ বিলিয়ন বা ৬ হাজার ৯০০ কোটি মার্কিন ডলার দাবি করেছে। ২০৩০ সাল পর্যন্ত কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং জলবায়ুর বৈরিতা মোকাবিলার জন্য ওই অর্থ দাবি করা হলেও এর কোনো সুস্থ সুরাহা হয়নি। বিশ্বনেতারা তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে এবং গা বাঁচাতেই অধিক আগ্রহী থেকেছেন। অতীতে আমরা দেখেছি জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবিলায় ধনী দেশগুলো গরিব দেশগুলোকে যে পরিমাণে অর্থ সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি করেছে তারা তা যথাযথ পূরণ করেনি। প্রতিশ্রুতির বিপরীতে অর্থ ছাড় করেছে খুবই সামান্য। ২০০৯ সালে ধনী দেশগুলো ওয়াদা করেছিল ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গরিব এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলার করে অর্থ সহায়তা দেবে, কিন্তু তারা তাদের ওয়াদা যথাযথভাবে পালন করেনি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক গড়াগড়ির অভিযোগ উঠেছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং মহাআপত্তির বিষয় হলো ধনী দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুত অর্থ ঋণ হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। এদিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশের বন্ধুদেশ জাপান। তারা মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অর্থ ঋণ জলবায়ুর তহবিলে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে।
২.
জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বনেতারা কার্বন প্রতিরোধে একমত হতে না পারলেও তারা যে এর প্রভাবমুক্ত তা কিন্তু নয়। তারা কার্বনজনিত বৈশ্বিক পরিবর্তনের অগ্নিটিলার ওপর দাঁড়িয়েও পুঁজিবাদী ব্যবসায়ীদের চাপে সবসময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। ব্যবসায়ীরা জানেন কার্বন কমানোর চেষ্টা মানে তাদের ব্যবসার মুনাফা হ্রাস পাওয়া। যা ব্যবসায়ীরা কোনোভাবেই হতে দিতে চান না। রাজনীতিক বা বিশ্বনেতারাও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে খুব বেশি আগ্রহ দেখান না। তাছাড়া ধনী দেশগুলোর জনগণ যেসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে তাদেরকে সেখান থেকে সরিয়ে আনাও প্রায় অসম্ভব। এতে নেতাদের জনপ্রিয়তায় টান পড়ার আশঙ্কা থাকে। রাজনীতিকরা বড় ধরনের কোনো আশঙ্কায় যেতে আগ্রহী হন না। কিন্তু তারাও যে কার্বন প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাদের নিজ দেশে কার্বনবিরোধী কর্মসূচির মধ্য দিয়ে। যেমন প্যারিসের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের আগেই গত আগস্টের শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ঘটা করে তার দেশে জলবায়ু বিষয়ক এক ঘোষণা দেন। ওই ঘোষণায় তিনি বলেছিলেন, আমেরিকা ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন-ডাই অক্সাইড নির্গমনের মাত্রা এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনবে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার ঘোষিত জলবায়ু বিষয়ক পরিকল্পনাকে আমেরিকার এযাবৎকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ (জলবায়ু ইস্যুতে) পদক্ষেপ বলে ঘোষণা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমেরিকার সকল বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প থেকে কার্বন নির্গমন কমিয়ে আনা হবে এক-তৃতীয়াংশ এবং আগামী ১৫ বছরের মধ্যে বায়ু এবং সৌরশক্তির ব্যবহার অধিক হারে বাড়ানো হবে। প্রচলিত বিদ্যুতের পরিবর্তে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎশক্তি ব্যবহারের ওপর জোর দেয়া হবে। তিনি বলেছিলেন, এই পদক্ষেপের দ্বারা আগামীর জন্য একটি পরিচ্ছন্ন এবং নিরাপদ আমেরিকা রেখে যাওয়া সম্ভব হবে।
এছাড়া গত জুন মাসে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত জি-৭ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো নিজ নিজ দেশের বাতাস থেকে কার্বনের পরিমাণ কমাতে একমত হয়েছিল। তারা কার্বন মুক্তির জন্য বৈশ্বিক অর্থনীতির নীতি পরিবর্তনের কথা বলেছিল। ইতিপূর্বে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ২৮ দেশ ২০৩০ সালের গ্রীনহাউস গ্যাস ১৯৯০ সালের তুলনায় ৪০ শতাংশ কমাতে ঐকমত্য প্রকাশ করেছে।
মিস্টার ওবামার ঘোষণাকে সে সময় জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্ব সংস্থাগুলো অভিনন্দন জানালেও সমালোচকরা প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাদের ভাষায় রাজনীতিকদের সব কিছুর পেছনে একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। প্যারিসের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের আগেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাড়াহুড়ো করে ওই ঘোষণা দিয়েছিলেন মূলত প্যারিস সম্মেলনকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে। কঠোর সমালোচকদের মতে ওই ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট ওবামা উন্নত বিশ্বের প্রতি এক প্রকারের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন। জলবায়ু সম্মেলনে একক আধিপত্য বিস্তার এবং জলবায়ু ইস্যুতে অন্যান্য দেশের প্রতি চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবে ওবামা ওই ঘোষণা দেন এবং সে কারণেই সম্মেলনের সাফল্য ঝুলে যেতে বাধ্য হয়। তুলনামূলক উদার সমালোচকরা মনে করেন জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তনে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ অবস্থা এতটাই নাজুক যে ওবামা সরকারের প্রতি জনসমর্থন ধরে রাখার জন্য ওই ঘোষণা দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
অভিজ্ঞজনদের অনেকেই মনে করেন, সমালোচকদের তোলা দুটি প্রশ্নই গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকা বিভিন্ন সময়ে তাদের বিশ্ব মোড়লি ধরে রাখা এবং অন্যান্য দেশের ওপর চাপ প্রয়োগ করার জন্য নানা প্রকারের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বৈধ বা অবৈধ বিবেচনা না করে যেখানে যুদ্ধ করা সম্ভব সেখানে যুদ্ধ বাধায়, যেখানে অবরোধ দেয়া সম্ভব সেখানে অবরোধ জারি করে। এর বাইরে উন্নত দেশগুলোর প্রতি খবরদারি অব্যাহত রাখার জন্য এ জাতীয় অনেক বৈধ পদক্ষেপ গ্রহণ করে এক ঢিলে তারা দুই পাখি শিকারের চেষ্টা করে। বারাক ওবামা জলবায়ু বিষয়ক পরিকল্পনা ঘোষণা করে একদিকে উন্নত দেশগুলোর প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন, অন্যদিকে নিজ দেশের জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তন রোধে ব্যাপক পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করেছেন। গত ৫/১০ বছরের ওয়েদার ম্যাপ দেখলে বোঝা যাবে এই সময়ের মধ্যে আমেরিকার জয়বায়ুতে কি পরিমাণ অস্বাভাবিক পরিবর্তন এসেছে। খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, পাহাড় ধস, অতিমাত্রায় তুষারপাত লেগেই আছে। কোনো কোনো এলাকায় জলবায়ুর বৈরিতায় মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। হাজার হাজার মানুষের জীবনযাত্রা হুমকির মধ্যে পড়েছে। যে কোনো মূল্যে এই বৈরী পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্যই প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তড়িঘড়ি জলবায়ু বিষয়ক ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছেন। আমেরিকার জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে তার সরকারের জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য এই ঘোষণা করা ছাড়া অন্য কোনো গত্যন্তর ছিল না।
বারাক ওবামার জলবায়ু বিষয়ক ঘোষণা যে খুব একটা সহজ কিছু তা একেবারেই নয়। আমেরিকার মতো মহাআধিপত্যবাদী দেশ মাত্র ১৫ বছরের মধ্যে কার্বন নির্গমন বর্তমানের চেয়ে এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনার যে চ্যানেঞ্জিং ঘোষণা দিয়েছে, তা যে খুব সহজে দিয়েছে এমনটা ভাবার কোনো সুযোগ নেই। বরং ঘোষণা দিতে তারা বাধ্য হয়েছে, প্রকৃতিই তাদের বাধ্য করেছে।
৩.
২০১৫ সালে ইউরোপে স্মরণকালের ভয়াবহ গরম পড়েছে। কোনো কোনো শহরে দিনের তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি অতিক্রম করেছে। এতে ফসলসহ সকল প্রকারের কৃষি উৎপাদন এবং জীববৈচিত্র্য দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হেক্টরকে হেক্টর জমির ফসল পুড়ে গিয়েছে। পানির অভাবে জমির সেচ পদ্ধতি বিকল হয়ে পড়েছে। পাতালে পানির স্তর নেমে গেছে। নদীতে পানির উচ্চতা কমেছে কয়েক সেন্টিমিটার। জঙ্গলে আগুন লাগার ঘটনাও ঘটেছে। বহু পশুপাখি ডিহাইড্রেশন এবং পানিশূন্যতায় ভুগে মারা পড়েছে। অতিমাত্রার গরমে তারা মানিয়ে নিতে না পেরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। ইতালির কৃষি খামারিদের সমিতি জানিয়েছে, তীব্র গরমে গরুর দুধ এবং হাঁস-মুরগির ডিম উৎপাদন ব্যাপক আকারে হ্রাস পেয়েছে। অন্যান্য বছরের তুলানায় গেল বছর গরমের মৌসুমে মাত্র এক মাসে দুধের উৎপাদন ৫০ মিলিয়ন লিটার হ্রাস পেয়েছে। হাঁস-মুরগির ডিম উৎপাদন কমেছে ৫ থেকে ১০ শতাংশ। খামারিরা জানান, ইউরোপীয় গরুর জন্য আদর্শ তাপমাত্রা হলো ২২ থেকে ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু সদ্য গত বছর ৪০ এর উপরে তাপমাত্রা থাকায় গবাদিপশু দানাদার খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করেছে। একেকটা গরু প্রতিদিন প্রায় ১৪০ লিটার পানি পান করেছে, কিন্তু স্বাভাবিক সময় এই গরুগুলোই পানি পান করে অর্ধেকেরও কম। গরুর জন্য পানযোগ্য পানির যোগান দিতে খামারিদের হিমশিম খেতে হয়েছে।
প্রচণ্ড গরমে শুধু দুধ বা ডিমই নয়, শূকরের গোস্ত উৎপাদনেও ব্যাপক প্রভাব পড়ে। ডিহাইড্রেশন এবং অরুচির কারণে শূকরের ওজন দ্রুত হ্রাস পেতে শুরু করে। খামার মালিকরা জানিয়েছেন, খামারের তাপমাত্রা গরু-ছাগলের জন্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে অধিক শক্তিশালী এয়ারকন্ডিশন লাগিয়েও পুরোপুরি সুফল পাওয়া যায়নি। এতে যেমন উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে তেমনি উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। পশুপাখি নানা প্রকারের রোগব্যধিতে আক্রান্ত হয়েছে। অধিক গরমে দুধ, ডিম, গোস্ত উৎপাদন কম হওয়া এবং উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার প্রভাব ইউরোপের দৈনন্দিন বাজারে পড়তে দেখা গেছে। খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধিতে মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। গত বছর অন্যান্য বছরের তুলনায় ইউরোপীয় সরকারগুলোকে খাদ্য উৎপাদনে অনেক বেশি ভর্তুকি দিতে হয়েছে।
শুধু পশুপাখির ক্ষেত্রে নয়, কৃষি ফসল উৎপাদনেও অতিরিক্ত গরম এবং অতি বৃষ্টি ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। গত বছর জুন-জুলাই এবং আগস্টে ইতালিতে ভয়াবহ গরমের পাশাপাশি যে পরিমাণে বৃষ্টি, ঝড় এবং শিলাবৃষ্টি হয়েছে স্মরণকালে এমনটা হতে দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠরা। ইতালির আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, তার ৭৪ বছর বয়সে তিনি কোনোদিন ইতালিতে এত ঝমঝমে বৃষ্টি হতে দেখেননি। সিমোনে ভিয়ানেল্লো নামের ওই সাবেক কর্মকর্তার সাথে আলাপকালে তিনি জানান, ইউরোপে সাধারণত টিপটিপ করে বৃষ্টি হয়। গরমের মৌসুমে ২২ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে তাপমাত্রা ওঠানামা করে। কিন্তু গত ক’বছর যাবৎ আবহাওয়া এ নিয়ম মানছে না। হুটহাট মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হচ্ছে, শিলাবৃষ্টি হচ্ছে, জলোচ্ছ্বাস হচ্ছে, ঝড় হচ্ছে যা অতীতে খুব একটা হতে দেখা যায়নি। ইতালির কৃষকরা এই নতুন এবং বৈরী আবহাওয়ার সাথে পরিচিত নন। তারা আগের পদ্ধতিতে ফসল ফলাতে গিয়ে বিপদে পড়ছেন। চাহিদামতো ফসল উৎপাদন তো হচ্ছেই না, বরং কৃষকের প্রযুক্তি এবং অর্থ ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। এর থেকে বেরুনোর জন্য নতুন নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে হবে। কৃষককে নতুন এবং এই আবহাওয়ার উপযোগ পদ্ধতি শেখাতে হবে। পাশাপাশি আবহাওয়া যাতে রুদ্ররূপ ধারণ না করে সে জন্য ব্যাপক এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। যে কোনো মূল্যে কার্বন কমিয়ে বাতাসের বিশুদ্ধতা ফিরিয়ে আনতে হবে।
৪.
বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ফলে ইউরোপ আমেরিকার আবহাওয়া এখন আর কোনো নিয়মকানুন মানছে না। শীতের দিনে শীত না পড়ে গরম পড়ছে। গরমের দিনে ভয়াবহ গরমের মধ্যেও মাঝে মধ্যে নেমে আসছে ঘনকুয়াশা। আগস্ট ২০১৫, মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে ইতালিতে দিনের তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর। মধ্য আগষ্টে মাত্র একদিনের ব্যবধানে তাপমাত্রা একটানে নেমে যায় ৪৩ থেকে ১৬ ডিগ্রিতে। আবহাওয়ার এই খামখেয়ালিপনা যেমন ফসলের উৎপাদন ব্যাহত করছে, তেমনি জনস্বাস্থ্যের ওপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। সুতরাং জলবায়ু এবং পরিবেশ বিনষ্টের জন্য দায়ী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ব্যাপক পদক্ষেপ নেয়া এখন সময়ের প্রধান দাবিতে পরিণত হয়েছে।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তার দেশের মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নির্গমন ঠেকাতে পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। ইউরোপের প্রতিটি দেশের জন্য অভিন্ন ঘোষণা এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সে বিবেচনায় প্যারিসের জলবায়ু সম্মেলনে সত্যিকারের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া দরকার ছিল। প্যারিস সম্মেলনে উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু সহনীয় পর্যায়ে রাখতে অর্থ সহায়তার বিষয়টি আরও স্বচ্ছ এবং কার্যকর হওয়া দরকার ছিল। বাংলাদেশের মতো অধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অংশগ্রহণ আরও গোছালো হওয়া দরকার ছিল। এলোমেলো, অপরিকল্পিত এবং সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত ছাড়া রুটিন অংশগ্রহণ করে বিদেশ ভ্রমণ ছাড়া বিশেষ কোনো লাভ হয়নি।
৫.
২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় দাবি করা হয়, বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের আয়ু আছে আর মাত্র ১০ বছর। সমীক্ষায় বলা হয়, আগামী এক দশকের মধ্যে সুন্দরবনের বড় একটা অংশ পানির নিচে ডুবে যাবে। বর্তমানে সমুদ্রতল থেকে সুন্দরবনের ভূপৃষ্ঠের যে উচ্চতা তাতে মাত্র ৪৫ সেন্টিমিটার পানির স্তর বাড়লেই সুন্দরবনের ৭৫ ভাগ ডুবে যাবে। অন্যদিকে জলবায়ু এবং ভূবিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বৃদ্ধি পেতে পারে। তাদের আশঙ্কা সত্যি হলে বাংলাদেশের ১৮.৩ শতাংশ সাগরতলে হারিয়ে যাবে। বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি প্যানেল তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল মানুষ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যেভাবে বাড়ছে তাতে ওই অঞ্চলের লবণাক্ততা বেড়ে গিয়ে ফসল উৎপাদন কমে যাবে। সুপেয় পানির অভাব দেখা দেবে। মাটির উর্বরতা কমে যাবে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাবে। অতিমাত্রায় ঝড়, বৃষ্টি, খরা, বন্যা এবং জলোচ্ছ্বাস বেড়ে যাবে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, প্রতিবছর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যে হারে বাড়ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে উপকূল এবং চরাঞ্চলের মানুষের জীবন তীব্র সংকটের মধ্যে পড়ে যাবে। প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ মানুষের জীবিকা ধ্বংস হবে এবং আড়াই থেকে তিন লাখ মানুষ বাস্তুহারা হবে। বিশেষজ্ঞদের এসব আশঙ্কার কিছু না কিছু প্রতিবছরই ফলতে দেখা যাচ্ছে। অথচ আমাদের সরকার বা সংশ্লিষ্ট কারও কোনো বিচরণ আছে বলে মনে হচ্ছে না। তারা দেশকে মধ্যম আয়ের দেশ বানানোর কথা বলেই আত্মতুষ্টিতে ভুগছে। দেশের মানুষকে আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্রের মন্ত্র পড়াচ্ছে। শহরভিত্তিক কিছু রাস্তা, ব্রিজ নির্মাণ করে উন্নয়ন দেখাচ্ছে। দেশের বেশির ভাগ মানুষের বাসস্থল গ্রাম-গঞ্জ উপকূল নিয়ে তাদের কোনো গরজ আছে বলে মনে হয় না। দেশ এবং দেশের মানুষকে বাঁচাতে তাদের কোনো দায় আছে বলে দৃশ্যমান হচ্ছে না। তারা জলবায়ুর বৈরিতা ঠেকাতে চরম উদাসীন। ভাব দেখে মনে হয় বিশেষজ্ঞদের কোনো আশঙ্কাই বাংলাদেশের শাসকরা বিশ্বাস করেন না। তারা নিশ্চিন্তে সুন্দরবনের কাছে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছেন। ইটের ভাটা এবং জাহাজ ভাঙার কারখানাসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করছেন। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে সুন্দরবনের শেলা নদীতে ৩ লাখ ৫৮ হাজার লিটার ফার্নেস তেল ঢেলে দিয়েও বাংলাদেশের সরকারের হুঁশ ফেরেনি। পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকারের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। সরকারের উদাসীনতার কারণে প্রায় অভিন্ন ঘটনা এর পরেও ঘটতে দেখা গেছে। সারসহ বিভিন্ন রাসায়নিক নিয়ে ছোট-বড় অনেক ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটেছে।
অবহেলা উদাসীনতা ঝেড়ে বাংলাদেশ সরকারের এখনি ঘুরে দাঁড়ানো দরকার জলবায়ু ও পরিবেশ বিনষ্টের বিরুদ্ধে। বিশেষজ্ঞদের সাথে নিয়মিত হোমওয়ার্ক করতে বিশেষ সেল গঠন করা দরকার। শুধু ক্ষমতা ধরে রাখার পরিকল্পনা না করে জলবায়ুজনিত ক্ষতির মুখ থেকে দেশ বাঁচানোরও পরিকল্পনা করা দরকার।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:৫৪
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×