somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একঘেয়ে মফস্বলের কথকতা

০৫ ই মে, ২০১৫ রাত ৮:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এই ছিমছাম, কোলাহল বিবর্জিত ছোট্ট শহরে খুব দ্রুত রাত নামে। গোধূলির ধূসর অন্ধকারে মিলিয়ে যায় মরা রোদ্দুরের বিষণ্ণতা। বিকেল বেলায় লেকের ধারে কিছু মানুষ আসে। আসে প্রেমিক প্রেমিকারা বিকেলের পড়ে আসা রোদে নিজেদের উষ্ণতা ভাগাভাগি করতে। স্বাস্থ্যসচেতন মানুষেরা জগিং করে দম বাড়িয়ে নেন। কেউ কেউ আসেন পুরো পরিবার সহ। ছোট্ট ছেলেটা বাবার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে হাওয়াই মিঠাই খাওয়ার আবদার করে। পরিবারের সকলে মিলে হাওয়াই মিঠাই খেয়ে বৈকালিক ভ্রমণের শেষ পর্যায়ে উপনীত হয়ে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নেয়। আমরা নিয়মিত এখানে আসি সপরিবারে। আমি চন্দ্র, আমার স্ত্রী বসুন্ধরা, এবং আমাদের একমাত্র সন্তান রকেট। এই শহরের অন্যান্য পরিবারদের মতো আমরাও একটি নিরাপদ একঘেয়ে জীবন কাটাতে অভ্যস্ত। আমি এবং আমার স্ত্রী, দুজনেই একটি চেইনশপে কাজ করি সপ্তাহে পাঁচদিন। যে দুইদিন ছুটি পাই আমরা সাধারণত ঘুমিয়েই কাটাই। রকেটের বয়স ছয় হবে এই মাসে। ওর সাথে খুনসুটি করি মাঝেমধ্যে। শহরের একমাত্র সিনেমাহলে বাইরের দেশের উচ্চ প্রাযুক্তিক সাই-ফাই বা এ্যাকশন জাতীয় ছবি চললে দেখি। মোটামুটি বলা যায় এই আমাদের জীবন। এর বাইরে কিছু ঘটে না, বা বলা যায় আমরা ঘটতে দেই না। এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুব ভালো। শুধু যে প্রশাসনিক সুব্যবস্থায় এমন একটি প্রায় অপরাধবিহীন সচ্ছল শহর গড়ে উঠেছে তা নয়, এখানে সবার মধ্যে প্রোথিত আছে নৈতিকতা এবং ভালো-মন্দ নিরুপনের শিক্ষা। তাই এখানে রাতের বেলায় নির্জন রাস্তায় একটি মেয়ে নির্ভয়ে চলাচল করতে পারে। বহুদিন আগে এখানে টুকটাক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছিলো, প্রশাসন সজাগ হয়ে তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। এমনই কঠিন এই শহরের বিচার ব্যবস্থা। খুন বা ধর্ষণের ঘটনা তো ঘটার প্রশ্নই আসে না। এইখানে সর্বোচ্চ পর্যায়ের নাশকতা হলো সিনেমার টিকেটের লাইনে দাঁড়িয়ে মৃদু বচসায় লিপ্ত হওয়া।

শহরের এই ভীষণ নিরাপদ আর একঘেয়ে জীবনে আমরা প্রায়ই হাঁপিয়ে উঠি। তখন ইচ্ছে করে কারো কলার ধরে মাথাটা দেয়ালের সাথে ঠুকে দিয়ে হিংস্র গলায় শাসিয়ে দেই, "এই একঘেয়ে জীবন থেকে পালাও, নইলে সামনে সমূহ বিপদ। রক্ষা পাবে না কেউ।" জানি না এমন ক্ষ্যাপাটে চিন্তাভাবনা শুধু আমাদেরই আসে নাকি অন্য কারোও এমন মনে হয়। অপরাধহীনতায় ভুগতে ভুগতে শহরের গায়ে তেল-চর্বি জমে বড্ড মন্থর হয়ে গেছে। এখানে স্বাস্থ্যবান বৃদ্ধদের সংখ্যা বাড়ছে ক্রমশ, বাড়ছে গড় আয়ু। এখানে সবারই আছে কাজ, সবাই ভালো মাইনে পায়, নেই বেকারত্বের অভিশাপ, নেই দুর্ঘটনা। এমন কী প্রেমে ব্যর্থ হবার ঘটনাও নাকি এখন আর ঘটছে না। আর তেমন কিছু ঘটলেও সেক্ষেত্রে সবাই নিজ নিজ নিয়তি মেনে নিয়ে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে যার যার কাজে সে সে মগ্ন হয়ে পড়ে। এসব দেখি, আর আমাদের মনের ভেতর রাগ পুঞ্জিভূত হতে থাকে। একদিন আমরা এই বলয় ভেঙে বেরিয়ে আসবো ঠিকই। তবে অধৈর্য্য হলে চলবে না। খুব ধীরে ধীরে এই অশ্লীলরকম নিরাপদ আর পরিতৃপ্ত শহরকে একটা বিশাল ঝাঁকি আমরা দেবই ঠিকঠিক।

এক শনিবারে বৈকালিক ভ্রমণ শেষে বসুন্ধরা আমাকে প্রস্তাব দিলো সিনেমাহলে নতুন যে সুপারহিরো এ্যাকশন সিনেমাটি এসেছে সেটি আমরা দেখতে পারি। আমি সাগ্রহে মাথা নাড়লাম। হ্যাঁ, অবশ্যই দেখা যেতে পারে। এখন বাজে সাড়ে ছয়টা। ম্যাটিনি শো'র টিকিট পাওয়া যাবে না। অগত্যা আরো তিন ঘন্টা অপেক্ষা করা ছাড়া আর গতি নেই। এই সময়টায় কী করা যায়? ছোট্ট শহরে ঘুরে বেড়ানোর মত জায়গা খুব বেশি নেই। আর আমাদের টাকাও খুব বেশি নেই সাথে। মাসের শেষে একটু টানাটানি থাকেই। আর এই মাসে অনেক বেশি খরচ করা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। রকেটের জন্যে নতুন জামা-কাপড় কিনতে হলো, নতুন স্কুলব্যাগ আর টিফিন বক্স কেনা হয়েছে।
-এই তিন ঘন্টা কীভাবে কাটানো যায় বলো তো?
বসুন্ধরা সুধোয় আমাকে।
-কিছুই করার নেই ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো ছাড়া।
-টাকা পয়সা কেমন এনেছো সাথে?
-খুব বেশি না।
-হু, বেশি আনার মত অবস্থাও তো নেই। চলো বাসায় চলে যাই।
-আরে নাহ! বাসায় গিয়ে একবার সটান হয়ে শুলে আর আসতে ইচ্ছা করবে না। এর চেয়ে চলো ঘুরে বেড়াই।

আমরা হাঁটতে থাকি। কিছুক্ষণ হাঁটার পর আমাদের ক্ষুধা লেগে যায়।
-এই চলো না কিছু খেয়ে নেই।
দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম শহরের সবচেয়ে অভিজাত এবং দামী রেস্তোরার সামনে। সেখান থেকে ভাজা মুরগীর লোভনীয় গন্ধ এসে আমাদের ক্ষিধেটা চাগিয়ে দিলো। কিন্তু ওখান থেকে কিছু খেলে সিনেমা দেখার টাকা থাকবে না। তাই আমি তার প্রস্তাব বাতিল করে দেই। ওদিকে রকেট অস্থির হয়ে গেছে।
-বাবা! ক্ষুধা লেগেছে তো! চলো না কিছু খাই এখান থেকে!
-না বাবা, তাহলে আর সিনেমা দেখা হবে না।
-সিনেমা কখন শুরু হবে?
-এই তো বাবা, আর কিছুক্ষণ পরে!
-বাবা! কোলে উঠবো। আর হাঁটতে পারছি না।

ছেলেটা বড় বিরক্ত করে। আমি চোখ রাঙিয়ে তাকালাম তার দিকে।
-এত বড় ছেলে কোলে ওঠে নাকি?
-আমি উঠবো! কোলে উঠবো! কোলে নাও!
-এ্যাই চুপ! একটা থাপ্পড় দিবো কিন্তু।
বসুন্ধরাও তার দিকে চোখ রাঙিয়ে বলে। কিন্তু আমাদের আদর বা শাসন কোনোটাকেই তোয়াক্কা না করে সে কাঁদতে থাকে। বোওওওরিং! এই একঘেয়ে শহরে ছিচকাঁদুনে ছেলের ক্রমাগত একঘেয়ে কান্নায় আমরা বিরক্ত হই। আমাদের ভেতর হঠাৎ করে শহরের প্রতি ঘনীভূত রাগটা ফুঁসে ওঠে। আর এই ফুঁসে ওঠার ফলাফলে আমি আর বসুন্ধরা দুজনেই ক্ষেপে গিয়ে রকেটের গালে চড় মারি চটাস চটাস করে। এটা করার পর আমাদের আশ্চর্যরকম হালকা লাগতে থাকে। যেন একগাদা লেক্সোটানিল খাইয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা মজা পেয়ে দুইজন মিলে ওকে বেদম প্রহার করতে থাকি। আহা কী সুখটাই না অনুভব করছি! এই শহর আমাদের নিয়ে অনেক খেলেছে। ধৈর্য্যের চুড়ান্ত পরীক্ষা নিয়েছে। আমরা কত সন্ধ্যেবেলা নিপাট ভদ্রলোকের মুখোশ পড়ে গাবদা-গোবদা সন্তানকে নিয়ে লেকের পাড় ধরে হেঁটেছি খামোখাই, বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট উদযাপন করার আনন্দে পার্টি দিয়ে আমাদের চেয়েও ভদ্দরলোকদের সাথে সম্ভাষণ বিনিময়ের পর কথা খুঁজে না পায়ে জানলার বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার ভান করেছি, প্রতিদিন সকালে শহরের খবরের কাগজে একঘেয়ে উন্নয়নের বিবরণ পড়ে, প্রশাসন এবং অপরাধিদের পিণ্ডি চটকিয়েছি নতুন কিছু ঘটছে না বলে। আমরা এতদিন সুযোগ খুঁজছিলাম এই বেড়াজাল ভেঙে বেরিয়ে এসে কিছু একটা করতে, যেন সবাই অন্তত একবারের জন্য হলেও চক্ষু কপালে তুলে ঈশ্বরকে স্মরণ করে ঘটনার ভয়াবহতা উপলব্ধি করে ভুলবার বৃথা চেষ্টা করে। আজকে সে সুযোগ এসেছে। এই সুযোগ হেলায় হারানো যাবে না। আমরা এমন কিছু করবো যা সবার কল্পনাকে ছাড়িয়ে যাবে, একঘেয়ে এই শহরে আতঙ্কতরঙ্গ সৃষ্টি করে কাঁপিয়ে দেবে সবাইকে!

আমি আর বসুন্ধরা রকেটকে মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে যাই। কিল, ঘুষি, চড়-থাপ্পড়, কোনকিছুই বাদ থাকে না। রকেট প্রথমে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছিলো। অল্পবিস্তর চড়-থাপ্পড় খেয়ে তার অভ্যাস আছে, তাই ভেবেছিলো এটাও তেমন কিছুই হবে। কিন্তু যখন তাকে ক্রমাগত এবং আরো বলপ্রয়োগ করে মারতে থাকলাম, সে আতঙ্কিত চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তের জন্যে কান্না ভুলে গিয়েছিলো, সেখানে ছিলো নিখাঁদ অবিশ্বাস। অবস্থার ক্রমাবনতি দেখে সে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে, দৌড়ে আবার সে ভীষণ পাকা। আমরা দুইজন স্থুলকায়া মানুষ অল্প একটু দৌড়ে হাঁপিয়ে যাই। তবে আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিলো। কিছুক্ষণ পর সে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে গোঙ্গাতে থাকে। আমরা তখন ধীরে সুস্থে গিয়ে তাকে পাকড়াও করি।
-খুব বেড়ে গিয়েছিলে তুমি বেয়াদব! বাবা-মার শাসন তোমার পছন্দ হবে কেন হারামজাদা! তোর মত ছেলেকে পিটিয়ে মেরে ফেলা উচিত।
-মারো! আরো মারো ওকে!
বসুন্ধরা আমাকে উৎসাহ দেয়।
-বাবা! মা! আমি আর কাঁদবো না। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমাকে মাফ করে দাও! আমি আর তোমাদের ডিস্টার্ব করবো না। প্লিজ আমাকে আর মেরো না। মেরো না!
আমি ওর মাথাটা ধরে জোরে জোরে রাস্তার সাথে ঠুকে দেই। একবার...দুইবার...তিনবার! প্রথমবার সে প্রবল আর্তচিৎকার করেছিলো, কিন্তু ধীরে ধীরে তার শক্তি ক্ষয়ে যেতে থাকে। সে মৃদু ঘরঘর শব্দে কী কী যেন বলতে থাকে। এবার এগিয়ে আসে আমার প্রিয়তমা স্ত্রী বসুন্ধরা। সে রকেটকে উল্টিয়ে চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে গলায় পেন্সিল হিল দিয়ে আঘাত করতে থাকে।
-তুই মর! মর! মর হারামজাদা! তোকে আর কোনো দরকার নেই আমাদের।
একসময় রকেটের মৃদু ঘরঘর শব্দটা মিইয়ে যেতে থাকে। তার মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়। এবার আমি তার কাছে গিয়ে গলা টিপে ধরি। এমনিতেই সে অনেক দুর্বল হয়ে গিয়েছিলো। তাই এতে তার মৃত্যু তরান্বিত হয়। আমি আর বসুন্ধরা দুইজনে আনন্দিত হয়ে হাই ফাইভ করি! ইয়েয়েএএ! এতদিনে একটা কাজের মত কাজ করেছি। এই শহরকে জীবন দান করার জন্যে এমন কিছুরই প্রয়োজন ছিলো। এমন সব ত্যাগের কারণেই তো গড়ে ওঠে সভ্যতা। আমরা না হয় নিজেদের সন্তানকেই ত্যাগ করলাম বৃহত্তর স্বার্থে। একটা মহত্তর অনুভূতি আমাদেরকে আপ্লুত করে।

এতক্ষণ যে হ্যাঁপাটা গেলো! বেশ ক্লান্ত আমরা দুজনেই। ক্ষিধেও পেয়েছে বেশ। তবে এখন আর কোনো দামী হোটেলে গিয়ে ডিনার করার কোনো দরকার নেই। বিনামূল্যেই খাওয়া যাবে। রকেটের টাটকা লাশ। আমার কাছে একটা সুইস নাইফ ছিলো। সেটা দিয়ে ধীরে ধীরে তার মাথা কাটতে থাকি। যদিও হিউম্যান ব্রেইন যথেষ্ট কোলেস্টরেল যুক্ত খাবার, আমার আবার লিপিড প্রোফাইলটা খুব একটু ভালো না। তাই হাই কোলেস্টরেল এ্যাভয়েড করি। তবে বসুন্ধরার জোরাজুরিতে খেতেই হলো।
-এই খাও না সোনা! তুমি আজ সারাদিন কিছুই খাও নি। একটু খেয়ে দেখো, শরীরে বল পাবে।
আমরা যথেষ্ট বল অর্জন করার পর রকেটের লাশটা একটা পরিত্যক্ত ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলি। বাসায় গিয়ে ডিপ ফ্রিজে রেখে আরাম করে খাওয়া যাবে। সিনেমা শুরু হতে এখনও দুই ঘন্টা বাকি। এখন সাড়ে সাতটা বাজে। এই সময়টায় এই নিঝুম মফস্বলের একঘেয়ে মানুষেরা ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখে। রাত দশটার মধ্যেই সবাই ঘুমিয়ে যায়, এবং কোনোরকম ঘুমের ঔষধ ছাড়াই তাদের বেশ ভালো ঘুম হয়।

আমাদের বর্তমান চিন্তা, প্রয়াত সন্তানের লাশ নিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া ঠিক হবে কি না। ওখানে ঢোকার সময় চেক করে, সুতরাং ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। প্রায় চারফুট লম্বা একটা মৃতদেহকে কোনোভাবেই ভালোমত প্যাকেটস্থ করে সন্দেহের ঊর্ধে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। তাই অনিচ্ছা সত্তেও আমাদের বাসায় যাবার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেখানে লাশটা রেখেই আমরা নগর পরিভ্রমণে বেরুবো।

বাসা থেকে বের হয়ে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। এত মানুষ এলো কীভাবে এই রাত্তিরে! সবার মুখে আনন্দের আভা। কেউ হেড়ে গলায় গান গাইছে, কেউ নাচছে, কেউ শ্লোগান দিচ্ছে, একটা উৎসবমুখর পরিবেশ সবখানে। আমাকে দেখে তাদের উচ্ছাস বেড়ে গেলো। তারা আমাদের জড়িয়ে ধরলো, অভিনন্দন জানালো, ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলো। আমরা কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না এর কারণ। তাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় একজন আমাদের সাথে করমর্দন করে কারণটা খোলাসা করলেন,
-তোমরা আজকে যা করেছো তার জন্যে আমরা গর্বিত, উপকৃত, কৃতজ্ঞ। তোমরা নিশ্চয়ই ভেবেছো যে কোনো প্রত্যক্ষদর্শী ছিলো না, ভুল! একজন ঠিকই তোমাদের কর্ম অবলোকন করে সবাইকে জানিয়েছে। আমরা সবাই তখন প্রতিদিনের একঘেয়ে ড্রামা সিরিজ দেখছিলাম। আমাদের মধ্যে অনেকেই আক্ষেপ করতো এই অতি নিরাপদ, অতি নৈতিক, অতি যৌক্তিক সমাজব্যবস্থা আখেরে কোন সুফল বয়ে আনবে না। ভয়াবহ কিছু একটা ঘটবেই, আমরা সেই ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতাম কবে আমাদের একঘেয়ে জীবনপ্রণালীতে তুমুল আঘাত হানতে এগিয়ে আসে ইবলিশের চর! না জানি কতো প্রাণহানি ঘটে! কিন্তু না! তেমন কিছুই ঘটে নি। তোমাদের সন্তান উৎসর্গ নিঃসন্দেহে সেই মহামানবের স্বপ্নপ্রাপ্ত আদেশ পালনের সমতূল্য। তোমরা মহান, তোমরা আধুনিক যুগের মহামানব-মানবী। এখন থেকে পরম নিরাপদ শহরের ধারণাটা বদলে যাবে। নৈতিকতা নামক ঠুনকো আবেগের প্রকাশটা বিলুপ্ত হবে। এখন থেকে খুন হবে, ধর্ষণ হবে। খুন হবে কলেজ শিক্ষক, রিকশাঅলা, দোকানদার, ব্যবসায়ী, কন্ট্রাকটর, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার... ধর্ষিতা হবে তোমার আমার মা-বোন-কন্যা, বুড়ি-ধুরি-ছুড়ি, তিন থেকে পাঁচ, পাঁচ থেকে পঞ্চান্ন, মোটা, সরু, সেক্সি, বেঁটে, লম্বা, কালো, ফর্সা.. সবাই। তথাকথিত পরম মাত্রার নৈতিকতার অসাড়তা প্রমাণ করেছো তোমরা, জানিয়েছো সবাইকেই। তোমরা নমস্য, তোমাদের অভিবাদন!

আমরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন একটা লম্বা মিছিল আমাদের দিকে এগিয়ে আসলো। তারা আমাদের নড করে সম্মান জানিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়লো বসুন্ধরার ওপর। তাকে টেনে হিঁচড়ে ছেঁচড়ে নিয়ে গেলো আমার কাছ থেকে। আমাকে পিছমোড়া করে হাত দুটো বেঁধে ফেললো। বসুন্ধরার জামা-কাপড় ছিড়তে লাগলো তারা। দানবীয় শক্তিতে মুহূর্তের মধ্যে তাকে নগ্ন করে ফেললো। তার যোনী এবং পায়ুপথে মিলিত হলো দুজন। আরেকজন ক্রমাগত চড় মারতে লাগলো তার গালে। তার স্তনে সেফটিপিন দিয়ে ফুড়ে দিচ্ছিলো একজন, আরেকজন এসে প্লায়ার্স দিয়ে স্তনবৃন্ত উপড়ে নিলো। রক্তে স্নাত বসুন্ধরার চিৎকারে তারা আরো আমোদিত হলো। ততক্ষণে একজনের যৌনকর্ম সম্পন্ন হলো, আরেকজন তার মধ্যে প্রবিষ্ট হবার আগে একটি বড়সড় ডিল্ডো দিয়ে তারা যোনী ক্ষতবিক্ষত করে ফেললো। আমাকে এসব দেখতে বাধ্য করছিলো তারা। আমার কানের ভেতর সুঁই ঢুকিয়ে দিলো একজন। আরেকজন অন্ডকোষে প্রচণ্ড লাথি মেরে বসলো। একটা বেসবল ব্যাট দিয়ে আমাকে পেটাতে থাকলো তারা সবখানে, নির্মমভাবে। ওদিকে তখন আরো একটা দল আসছে আমাদের নামে শ্লোগান দিতে দিতে। এই ছোট্ট শহরে এত মানুষ আছে আমি জানতাম না!

জ্ঞান ফিরলে আমরা নিজেদের আবিষ্কার করি সিনেমাহলের অভিজাত আসনে। আমাদের সর্বাঙ্গ রক্তাক্ত, ব্যথায় এক চুলও নড়ার সামর্থ্য নেই। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো সেই নেতৃস্থানীয় লোকটির চেহারা, যিনি আমাদের সবকিছু খোলাসা করে বলেছিলেন। তার সেই বক্তব্য রেকর্ড করে এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে। আর সেই সাথে আমার আর বসুন্ধরার নিপীড়িত হবার দৃশ্য। সিনেমাহল জুড়ে হাজারো মানুষ আমাদের নির্যাতন করার দৃশ্য দেখে উল্লাসে ফেটে পড়ছে। আমি কোনক্রমে বসুন্ধরার দিকে হাত বাড়াই তাকে ছোব বলে। তার হিমশীতল হাত আমাকে জানিয়ে দেয় সে মৃত। বসুন্ধরা মৃত, চন্দ্র আলোহীন। কারা যে আমাদের এত বাহারি নাম দিয়েছিলো! আমরা কখনও পৃথিবীর ছিলাম না, চন্দ্রেরও না। পরম নিরাপত্তা আর নৈতিকতার তত্বে গঠিত একঘেয়ে মফস্বলের ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে আমরা কার খেলার গুটি ছিলাম?

... এবং তার পর থেকে বসুন্ধরা আর চন্দ্রের প্রয়ান দিবসে ফুলে ফেঁপে ওঠা মেট্রোসিটিটা তাদের একঘেয়ে, পাপমুক্ত, পরম নিরাপদ মফস্বলের অভিশাপ থেকে বেরিয়ে আসার বিসর্জনের দিনটি উদযাপন করে গর্ভপাত করা অথবা আস্তাকূড়, বা নর্দমা থেকে প্রাপ্ত শিশুদের মাংস ভক্ষণ করে।
৫৬টি মন্তব্য ৫৬টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৩

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো
অজানার পথে আজ হারিয়ে যাব
কতদিন চলে গেছে তুমি আসো নি
হয়ত-বা ভুলে ছিলে, ভালোবাসো নি
কীভাবে এমন করে থাকতে পারো
বলো আমাকে
আমাকে বলো

চলো আজ ফিরে যাই কিশোর বেলায়
আড়িয়াল... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকরি বয়সসীমা ৩৫ বৃদ্ধি কেনো নয়?

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪২



চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি এটা ছাত্র ছাত্রীদের/ চাকরি প্রার্থীদের অধিকার তবুও দেওয়া হচ্ছে না। সরকার ভোটের সময় ঠিকই এই ছাত্র ছাত্রীদের থেকে ভোটের অধিকার নিয়ে সরকার গঠন করে। ছাত্র ছাত্রীদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×