somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জঠর: হামিম কামালের রোমাঞ্চকর অধিবাস্তব অভিযান

০৫ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ২:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


"আমাকে যদি কেউ এভাবে ভালোবাসতো, তো আমি সন্তানের মা হওয়ার বাসনা পরিত্যাগ করতে পারতাম"।
আমার কাছে মনে হয়েছে এই লাইনটিই জঠর উপন্যাসের প্রাণভোমরা। বিচ্ছিন্নভাবে এই বাক্যটি পাঠ করলে একটা বড় রকমের ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়। প্রকৃতিমাতার অশেষ অনুগ্রহেই কেবল সন্তান লাভের মত অবর্ণনীয় সুখের অনুভূতি ধারণ করা সম্ভব। মাতৃত্ব একটি বিশাল অর্জন। মানবজাতিকে চলমান করে রেখেছে বংশপরম্পরায় নিজের বীজ ছড়িয়ে দিয়ে নশ্বর এই জীবনের ওপাড়ে মহিরুহ হয়ে টিকে থাকার প্রেরণা। মাতৃত্বের সাথে অন্য কোন অনুভূতির তুলনা হয় না। যে অকল্পনীয় ব্যথা সহ্য করে একজন নারী মা হয়ে ওঠেন, তার সাথে তুলনাযোগ্য কিছু নেই। আমি দেখেছি ছোট্ট শিশুকে তার পুতুলটিকে বাবু ডেকে যত্ন নিতে, মিছেমিছি ঔষধ দিতে, খাইয়ে দিতে, স্নেহানুভূতিতে আপ্লুত হতে । বাৎসল্যের এই অভাবনীয় বোধ সে কোথা থেকে পেলো? বলছিলাম আমার তিন বছর বয়েসী মেয়েটির কথা। যার মাঝে মাতৃস্বত্বা আবিষ্কার করে আমি হয়ে উঠেছি শিশিরভেজা সবুজ ঘাসের মত আর্দ্র, ঘরের আঙিনায় লতিয়ে ওঠা গুল্মটির মত হরিৎ। নারী জীবনের এই অসাধারণ উন্মেষপ্রক্রিয়া শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে পরিণত বয়সে এসে উপনীত হলে তারা হয়ে ওঠেন কুসুমপেলব এবং একইসাথে চিনের মহাপ্রাচীরের মত দৃঢ় আর বিশাল। কিন্তু জঠর উপন্যাসে বিজয়া কুসুমকলি নামক নারী চরিত্রটি এ কী বললেন? আজকাল নানা ধরণের ঘটনা ঘটছে। পরকীয়া, নাগরিক জীবনের ক্লেশ, অশান্তি এসব বেড়েই যাচ্ছে। এমন কী মা পর্যন্ত হয়ে উঠছেন হন্তারক। জঠর উপন্যাসের বিজয়া চরিত্রটি কি তবে তেমন কোন মানসিক বৈকল্যে ভোগা অথবা ভোগের নেশায় একশটি যৌনতার দেবী ইশতার হয়ে ওঠা কোনো নিম্ফ? সে কেন মাতৃত্বের স্বাদ থেকে স্বেচ্ছায় নিজেকে বঞ্চিত করতে চাচ্ছে? সে ব্যাপারে আলোচনার পূর্বে জঠর উপন্যাসের কালপঞ্জিতে চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক।

উপন্যাসের শুরুতে সমতট নামক এক কল্পিত শহরে ঘুণে ধরা, ক্লেদাক্ত, অশূদ্ধ পরিবেশে বসবাসকারী একটি যুগলের দেখা পাই। মোম এবং সোমা। নানা সমস্যায় জর্জরিত, দূষিত, অর্ধমৃত সেই শহরে অসুস্থতা আর মৃত্যুই যেন পরম আকাঙ্খিত ধন! মানুষ বাঁচছে অথবা বাঁচছে না, মরছে অথবা মরছে না, ব্যবসা চলছে, চলছে খুব। ভুখানাঙ্গা মানুষের শরীরসেতু দলিয়ে মুচড়িয়ে বখতিয়ারের ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে চলে যাচ্ছে ধর্মোন্মাদদের দল, তাদের পিছু নিয়েছে কর্পোরেট মাফিয়ারা। এই বিপদসঙ্কুল বিরুদ্ধ পরিবেশে সবুজ হৃদয়ের, তাজা ফুসফুসের প্রাণবন্ত মানুষেরা দিনে দিনে হারিয়ে ফেলে তাদের তাৎপর্য। হয়ে ওঠে বিবর্ণ। খোয়াতে থাকে প্রাণশক্তি। এভাবেই চলে যেতে হয়, এমনটাই নিয়ম এখানে। মোম এবং সোমা যুগলের ক্ষেত্রেও এমন একটি আক্রমণ এলো। মোমের অর্ধাঙ্গিনী সোমা ফুসফুসের এক বিরল রোগে ভুগতে শুরু করলো। মোমের ভাষ্যে, "শহরের প্রবীণতম চিকিৎসকটি তার মৃত্যুপ্রহর ঘোষণা করে ফেললেন এরপর। শহরের অপরাপর অসংখ্য হতভাগ্য মানুষের তুলনায় সোমার অসুখটা হয়তো ভদ্রস্থ ছিল রীতিমতো। কিন্তু ওই 'অপর' মানুষগুলো নির্লিপ্ত স্বাভাবিকতায় মৃত্যুর পরোয়ানাকে মেনে নিয়ে থাকে। আমি মোম তা করতে পারি নি"।
দীর্ঘ প্রারম্ভিকার পর এই বোধনচিহ্নময় মনোলোগের মাধ্যমেই মূলত উপন্যাসটির যাত্রা শুরু হয়। এর পরের দৃশ্যকল্পে মোমের এক নিবিড় মায়াময় স্বপ্নের মাধ্যমে সে তার ভাবী যাত্রাটি শুরু করার ব্যাপারে একটি 'ঐশ্বরিক' ইঙ্গিত পায়। সে স্বপ্নে তারা একটি অরণ্যসংকূল নির্জন ভূখণ্ডের রুপালী নদী ধরে ডিঙি নৌকোয় করে কোথাও যাচ্ছিলো। সামনে অরণ্যের গহীন অন্ধকার, আর স্বচ্ছ জলের ভেতর বহুবর্ণী উদ্ভিদ এবং মাছ। বৈঠা চালিয়ে মোম যাচ্ছে কোথায়? হঠাৎ সোমা উঠে দাঁড়ালো টলটলায়মান পায়ে কোনমতে ভারসাম্য রক্ষা করে। নিঃসন্দেহে ঝুঁকিপূর্ণ। এমন একটা পলকা নৌকোয় করে অনির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছোনোর জন্যে যে পরিমাণ মানসিক এবং শারীরিক শক্তির প্রয়োজন তা কি এই দম্পতি বহন করতে পারবে?
মোমের দরকার ছিলো একজন গার্ডিয়ান এ্যাঞ্জেলের। যে তাকে সঠিক পথ দেখাবে। প্রকৃতির কুটিল, নৃশংস এই পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করে দিতে প্রজ্ঞাবান কারো পরামর্শ দরকার ছিলো তার। প্রকৃতির নির্মিত 'মায়াচক্র' একটা আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলো মোম এবং সোমার জীবনে। মোম এবং সোমা, এক বৃষ্টির দিনে যাদের অকস্মাৎ একটি পার্কে দেখা হয়ে যায় একটি কদম গাছ খুঁজতে গিয়ে। এভাবেই সৃষ্টি হয় মায়াচক্র। তারা সানন্দে এই চক্রে নিজেদের অন্তরীণ করে রাখেন। এর ধারাবাহিকতায় তুষ্ট প্রকৃতি তার উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে পরবর্তী পদক্ষেপ নেন। তাদেরকে বন্দী করেন মায়াশেকলে। যাবতীয় ধর্মীয় এবং সামাজিক নিয়ম কানুন নিষ্ঠার সাথে পালন করে তারা বিবাহ করেন। কিন্তু সুসময় সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আর তাই, সোমা আক্রান্ত হলো এক জটিল ব্যাধিতে।
পাঠ পরিক্রমায় আমরা আন্দাজ করতে পারি যে, মোম এবং সোমা ছিলো নি:সঙ্গ। তাদের আত্মীয়-স্বজন, শুভানুধ্যায়ী, বন্ধু বান্ধব খুব বেশি ছিলো না। তাই প্রকৃতির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আসন্ন মহা অভিযানের রসদ সংগ্রহ করতে মোম খুঁজে ফিরছিলো এমন কাউকে যিনি তাদেরকে একটা কার্যকর রূপরেখা প্রদান করতে পারেন। এমন অবস্থায় সহজাত প্রবৃত্তি বা বলা যায় ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা চালিত হয়ে মোম খুঁজে পায় পার্শ্ববর্তী টং এর দোকানের একজন নিয়মিত এবং নীরব খদ্দের, একজন শ্মশ্রুমণ্ডিত বৃদ্ধকে, যাকে সে তার বর্তমান সংকটকাল খুলে বলে। মোম এই বৃদ্ধের নাম দেয় বেদব্যাস। তিনি নীরবে সব শোনেন, কিন্তু কোন মতামত দেন না। এসময় মোমের মনে এক ধরণের দ্বৈরথ চলতে থাকে। সে কি ঠিক মানুষের কাছে গেছে, নাকি খামোখা একজন চালচুলোহীন ভবঘুরে বৃদ্ধ ভিখারীর পেছনে সময় নষ্ট করছে? পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা জানতে পারি যে মোম সঠিক মানুষের কাছেই গিয়েছিলো। তার কাছ থেকে সে একটি "অচিন্ত্য উপহার" লাভ করে, যার নাম "প্রজ্ঞালিপির খাতা"।
এবং এই অংশে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও অধ্যায়টি মাত্র দুই পৃষ্ঠা বিস্তৃত, তবে প্রজ্ঞালিপির খাতা সম্পর্কে বেদব্যাসের দীর্ঘ বয়ান, কার্যপ্রণালী, নানারকম তত্ত্ব এবং তথ্যের ব্যাখ্যা বিপুল জটিলতায় ভরপুর এবং অনেকাংশেই দুর্বোধ্য। এজন্যেই হয়তো লেখক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বেশি করতে চেয়েছেন, যা জটিলতাটিকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। একদম সোজা সাপ্টা ভাষায় সরলীকরণ করে যা অবশিষ্ট থাকে তা হলো, প্রজ্ঞালিপির খাতায় আসন্ন অভিযান সম্পর্কে দিক নির্দেশনা রয়েছে। সাদা খাতাটিতে ধীরে ধীরে একটি মানচিত্র ফুটে উঠবে। একটি দ্বীপ, যার রং নীল, এবং চারপাশের পানির রং সবুজ। ধীরে ধীরে দ্বীপটির রং সবুজ এবং পানির রং নীল হয়ে উঠলে বেদব্যাসের প্রণীত নির্দেশনা অনুযায়ী মোম বুঝতে পারে রওনা দেবার সময় এসে গেছে।
এখান থেকে গল্প হয়ে ওঠে দারুণ গতিময়। নানারকম বাধা-বিপত্তি, সংশয়, বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচল, নানারকম মানুষ সব মিলিয়ে একটা টানটান উত্তেজনাপূর্ণ ভ্রমণ শুরু হয়। তাদের কাছে কোনো পথপ্রদর্শক ছিলো না, মানচিত্র ছিলো না।"পথই চিনিয়ে দিবে পথকে" এই আপ্তবাক্য বুকে ধারণ করে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে পথ চলতে থাকে এই সাহসী এবং দৃপ্ত যুগল। পথিমধ্যে তাদের দেখা হয় মোমের শিক্ষাগুরুর সাথে, বদ মতলবকারী ধুরন্ধর এক লোকের সাথে, যে তাদের অনিষ্ট করতে প্রস্তুত ছিলো। প্রজ্ঞা এবং শক্তির সমন্বয়ে তাকে পরাভূত করতে সক্ষম হয় তারা। দীর্ঘ গন্তব্যে পৌঁছুতে বারবার বাহন বদল করতে হয় তাদের। বাস থেকে ট্রেন, আবার নতুন ট্রেন, পথই চিনিয়ে দিচ্ছিলো নতুন পথ। তাদের গন্তব্য ছিলো নীলাভূমি নামক অঞ্চল। তবে তার আগে মনের ডাকে তারা নেমে পড়লো শপথনগরে। সেখানে মোমের বন্ধু অপু বসবাস করে। মেধাবী এই ছেলেটি পদার্থবিদ্যার শিক্ষক। শপথনগরে পরবর্তীতে তারা আরো কিছু শুভানুধ্যায়ী পেয়ে যায়। অপুর প্রেমিকা বিজয়া, বিজয়ার বন্ধু নীপার, এবং অপুর মাসী।
বইয়ের ভূমিকায় লেখক লিখেছেন তার স্ত্রীর দুরারোগ্য অসুখের চিকিৎসা করতে গিয়ে যেসব অভিজ্ঞতা এবং মানসিক টানাপোড়েনের সম্মুখীন হতে হয়েছে দেশে এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে, তারই রূপকরূপ এই উপাখ্যান। তাই এই উপন্যাসে যখন অপুর মাসি জিজ্ঞেস করেন "তোমরা কি বাংলা থেকে এসচো?" তখন আমরা জ্ঞাত হই নতুন দেশে এসে গেছে মোম এবং সোমা। শপথনগরের রহস্যময় ভূখণ্ডে উন্মোচিত হবে তাদের অভিযানের নতুন মাত্রা।
এই পর্যায়ে মূল কাহিনীর সমান্তরালে কিছু সাবপ্লট ধরে এগিয়েছেন লেখক। মিঠাইবুড়ো, শৈলশিরার সাধিকা এসব অধ্যায় বেশ বৈচিত্র এনে দিয়েছে লেখাটিতে।
আড্ডা, ভোজন, নগর পরিভ্রমণ, এভাবে বেশ কেটে যাচ্ছিলো তাদের দিন। মোম এবং সোমা জানতো তাড়াহুড়োর কিছু নেই। সময়মতই তারা সংকেত পেয়ে যাবে নীলাভূমিতে যাত্রা করার। এর মাঝে বিজয়া কুসুমকলির সাথে বেশ সখ্যতা হয়ে যায় তাদের। বিজয়া এবং অপু। তারা বুদ্ধিমান, প্রাজ্ঞ এবং ঋদ্ধ। এই অভিযানের জন্যে মানসিক রসদ যোাগাতে তারা ছিলো আকূলপ্রাণ। মোম এবং সোমার মত তারাও কোন তাড়াহুড়ো করে নি। জানতো, সময় হলেই তাদের সব প্রশ্নের জবাব দেবে তারা। অবশেষে যখন মোম বুঝতে পারলো যে আবারও তাদের যাত্রা শুরু করার সময় উপনীত, তখন সব খুলে বললো তাদেরকে। আর এই পর্যায়েই বিজয়া সেই অসাধারণ উক্তিটি করলো, যা এই লেখার শুরুতেই ব্যবহার করেছি, এবং উপন্যাসটির প্রাণভোমরা হিসেবে আখ্যা দিয়েছি। পুনরাবৃত্তি করা যাক,
"আমাকে যদি কেউ এভাবে ভালোবাসতো, তো আমি সন্তানের মা হওয়ার বাসনা পরিত্যাগ করতে পারতাম"।
উপন্যাসটিতে এমন হেঁয়ালি ভরা বাক্যের অভাব নেই, তবে তার মধ্যে এটাই সেরা, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; যা শুনে শ্রোতারা হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। বিজয়া এর ব্যাখ্যা প্রদান করলে এক আশ্চর্য প্রাকৃতিক দুর্নীতি এবং জিঘাংসার স্বরূপ উন্মোচিত হয়।
বিজয়া এবং অপুর সম্পর্ক, আর মোম এবং সোমার সম্পর্কের তুলনা এই পর্যায়ে আবশ্যিক হয়ে পড়ে। বিজয়া এবং অপু ছিলো প্রকৃতির বাধ্যগত সন্তান। হ্যাঁ, তারা ছিলো একে অপরের প্রাণেশ্বর। তারা ছিলো বিশ্বস্ত এবং অদম্য। প্রকৃতিমাতার বেঁধে দেয়া পাণ্ডুলিপি অনুসারেই মসৃণ গতিতে অগ্রসর হচ্ছিলো তারা। পরিচয়-পরিণয়-বন্ধন-সঙ্গম এই চেনাপথেই তাদের নিয়তি বাঁধা ছিলো। প্রকৃতির গুডবুকে আরো অন্যান্য অসংখ্য মানুষের মতই তারা সগর্বে বিরাজমান ছিলো। আর অন্যদিকে মোম এবং সোমা! প্রকৃতির অবাধ্য সন্তান। শাারীরিক প্রবৃত্তি যে তাদের ছিলো না তা নয়। কিন্তু হৃদয়বৃত্তিক অনুভূতির অনুরণনেই তারা কম্পিত ছিলো সবসময়। নিজের অস্তিত্বের স্বার্থে প্রকৃতি তাদের কঠিন পরীক্ষায় ফেলে। বিজয়ার ভাষায়, এ প্রকৃতির এক ভয়ানক দূরভিসন্ধি। এই নিয়মের ব্যত্যয় যারা করে তাদের প্রতি নির্মম হয়ে ওঠে প্রকৃতি। এই যে মানুষের বেড়ে ওঠা, অজস্র সঙ্গম করে বংশধর রেখে যাওয়া, সবই প্রকৃতির পাঠ্যসূচী অনুযায়ী কৃত। সঙ্গম ক্ষমতা হারালে মানুষের চামড়া কুঁচকে যায়, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস্ব পায়, ক্রমশ অথর্ব হয়ে উঠে মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে তারা। নিষ্ঠুর প্রকৃতি তাদেরকে বুঝিয়ে দেয়, "এবার চলে যাও বাছা, তোমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে!"। মোম এবং সোমার মাঝে এক অদ্ভুত অসামাঞ্জস্য লক্ষ্য করে প্রকৃতি। তারা মানসিক ঘনিষ্টতায় এতই তৃপ্ত, যে শরীরের কথা তাদের কদাচ মনে পড়ে। এর ফলে প্রকৃতি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, এবং সবশেষে এক বিপুল চক্রান্তের পরিকল্পনা করে। মোম এবং সোমার মধ্যে যেকোন একজনকে ছিনিয়ে নিতে হবে। এর ফলে একজন নিঃসঙ্গ হয়ে যাবে, এবং সে নতুন একজন সঙ্গী খুঁজে নিয়ে অত্যন্ত 'প্রাকৃতিক' ভালোবাসবে সঙ্গীকে। আর এভাবেই জয়ী হবে তার কূট পরিকল্পনা।
রহস্য গল্পের ঝানু ডিটেকটিভ যেমন সমস্ত কার্যকারণ বিশ্লেষণ করে একটি চমক জাগানিয়া উপসংহার টানেন, তেমনি বিজয়ার এই বিদায়ভাষণ নিঃসন্দেহে পাঠকহৃদয়কে চমকিত করবে, ভাবনার খোরাক জুটোবে, অনেকদিন স্মৃতির চিলেকোঠায় জোৎস্না ছড়াবে।

অবশেষে তারা পৌঁছোয় লৌকিক দ্যুলোকে। তাদের কাঙ্খিত গন্তব্যে। এ পর্যায়ে কাহিনীটা দারুণ থ্রিলিং এবং এ্যাডভেঞ্চারাস হয়ে ওঠে। যেমনটি অনেক সিনেমা বা বইয়ে দেখেছি আমরা, প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকার, শত্রুকে পরাভূত করার এক অসম দুঃসাহসিক অভিযান শুরু হয়। প্রকৃতির পক্ষ থেকে হত্যাচেষ্টা করা হয় সোমাকে। কখনও বিশাল উল্কাপিণ্ড পাঠিয়ে, কখনও সাগরজলে ডুবিয়ে। বারংবার ধ্বংস হয় তাদের ভিটে। প্রেরণ করা হয় ভৌ্তিক শিশুদের। যারা ভয়াল ফিসফিস করে ওঠে "আমাকে নাও, আমাদের নাও।" প্রেরণ করা হয় শ্যাওলাবাহিনী, যারা এক প্রতীকী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, বংশবিস্তার করেই ছাড়বে। সোমা এবং মোম প্রাণপনে লড়তে থাকে নিজেদের সমস্ত শক্তি এবং কৌশল প্রয়োগ করে। ঠান্ডামাথার একেকটি চালে পরাভূত করতে থাকে প্রকৃতিকে।
কিন্তু তারা কি জয়ী হয়েছিলো? নাকি সেটা ছিলো একটা ভ্রান্তিযজ্ঞ? অপুর জবানীতে, "এই যে যুদ্ধটা অংশ আর উৎসের, এটা কি আদৌ কোন জয় পরাজয় নির্ধারক যুদ্ধ? মানুষ এমনই এক শক্তি,যেটা বারবার প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে জিতেই ছেড়েছে। মানুষের জিৎই তো প্রকৃতির জিৎ। নিজের ভেতরেই তো প্রকৃতি লীন হে থাকে।"।
সোমের ভাবনাও খুব ব্যতিক্রম কিছু না। সে ভাবে, "কী আশ্চর্য দেখো! তোমাকে হারাতে এসে তোমারই কাছে চাইছি। এতেই প্রমাণিত হয়, এই তুমি কত প্রকটভাবে আমি নিজেই!"।
উপন্যাসটির এর পরেও আরো সাত/আটটি পৃষ্ঠা রয়েছে। সেখানে আছে নতুন চরিত্র, নতুন ঘটনা, নতুন বাঁক, নতুন তত্ত্ব, নতুন ভাবনা। সেটুকু বলে পাঠকের রসাস্বাসদনে ব্যাঘাৎ ঘটাতে চাই না।

জঠর উপন্যাসটি কতটুকু ভালো তার চেয়ে আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এটি কতটা নতুন। অনেক প্রাজ্ঞ ব্যক্তি বলেন সব গল্প নাকি বলা শেষ। তাই বলে কি গল্প উপন্যাস লেখা থেমে থাকবে? মোটেও না। পুরোনো, ক্লিশে, চর্বিত চর্বন কাহিনীকে সৃজন আল্পনায় রাঙিয়ে নতুন করে বলতে হবে। হামিম কামাল তার জীবনে সংঘটিত সঙ্কটকালকে রূপকের নক্সায় আবৃত করে আমাদের কাছে যা উপস্থাপন করেছেন, তা সম্পূর্ণ নতুন একটি গল্প হয়ে গেছে। এটা পড়ে যে আনন্দ আমি পেয়েছি তা অনুসন্ধিৎসু শিশুর বাবার হাতঘড়ি ভেঙে ফেলে তার কলকব্জা নিয়ে খেলার আনন্দের সমতূল্য। সুররিয়াল ছোটগল্প অনেক পড়েছি। কিন্তু আস্ত একটা উপন্যাস, তাও আবার বাংলা ভাষায়? আমার জন্যে এটা একটা নতুন অভিজ্ঞতা। ছোটগল্পে অধিবাস্তবতা ধারণ করা যতটা সহজ উপন্যাসে তা মোটেও নয়, আর এক্ষেত্রে একটি বা দুটো দৃশ্যকল্প নয় পুরো উপন্যাসটিই তেমন, এবং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তা বহাল থেকেছে। বিচ্যুতি নেই বললেই চলে, আরোপিত মনে হয় নি কোথাও। সংলাপগুলো ভারী, দীর্ঘ এবং মর্যাদাময়। মঞ্চনাটকের মতো। কিছু কিছু দৃশ্যকল্প ভায়োলেন্ট, ভীতি উদ্রেককারী এবং আনকোরা। পড়তে পড়তে বইটি রেখে চোখ বন্ধ করে সেসবের দৃশ্যায়ন করতে ইচ্ছে জাগে।
বইটিতে অজস্র ছোট ছোট অধ্যায় আছে। নামগুলোও অভিনব। যেমন,জিভকর্তন, মিত্রসঙ্গম, মানপর্ব, মায়াপর্ব, ভ্রান্তিযজ্ঞ, যুগলাবশেষ প্রভৃতি। এটা পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখার জন্যে চমৎকার কৌশল নিঃসন্দেহে।
উপন্যাসটির নির্মাণে লেখক অত্যন্ত যত্নশীল ছিলেন। কোথাও সুর কেটে যায় নি। আগাগোড়াই নিচ্ছিদ্র এবং পাঠকের নিবিড় মনোযোগ প্রার্থী এই উপন্যাসটিতে পাঠক তার ভাবনার আকাশে নতুন একটি নক্ষত্র খুঁজে পাবেন এই আশাবাদ আমার যৌক্তিক বিশ্বাস।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ২:৩৮
৪৩টি মন্তব্য ৪৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×