আপনি পীরেন স্নালের নাম শুনেছেন? আমি শুনি নি আগে। এই পরশুদিন জানলাম। একটি গানের মাধ্যমে। গানের দলের নাম মাদল। ঝাঁকড়া চুলের একটা ছেলে গলার শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করে গাইছিলো,
“শালবৃক্ষের মত সিনা টান করে সে
মানুষ হয়ে বাঁচতে পীরেন জান দিয়েছে”
আহা, কী অসাধারণ উপমা! শালবৃক্ষের মত সিনা! মানুষ হয়ে বাঁচতে চাওয়া এই যুবক আবার পাখির মত উড়তে চেয়েছিলো, বন পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে গাইতে চেয়েছিলো, লাল মাটির গন্ধ বুকে পুষতে চেয়েছিলো! এসবই জানতে পাই এই গান থেকে। ক্রমাগত শুনতে শুনতে গান এবং এর গল্প আমার কাছে জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমি বুঝতে পারি, পীরেন কোনো বানানো চরিত্র নয়। এর পেছনে একটি সত্যিকারের বেদনাবিধূর গল্প আছে। সার্চ দিলাম গুগলে। ঢুকে গেলাম ইতিহাসের পাতায়। পীরেন স্নাল ছিলেন গারো সম্প্রদায়ের এক প্রতিবাদী যুবক। তাদের বাসস্থান অধিগ্রহণ করে ইকোপার্ক বানানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। পীরেন স্নাল তার নাড়ী পোঁতা মাটির অধিকার ছাড়তে চায় নি। ২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি সালে তারা এর প্রতিবাদে মিছিলে নামে। মিছিলে গুলি চালায় বনরক্ষীরা। এতে পীরেন স্নাল নিহত হন। আহত হন আরো শতাধিক। পীরেন স্নাল সম্পর্কে এর থেকে বেশি কিছু জানতে পারি নি আর। শুধু জানি, এখনও তাকে হত্যার বিচার চাওয়া হচ্ছে, চাইছেন তার গারো বন্ধুরা। বাঙালীরা কেন চাইছে না? বাঙালীরা কেন পীরেন স্নালের নাম জানবে না? পীরেন স্নাল আর নূর হোসেনের মধ্যে আমি তফাৎ করতে চাই না। দুইজনেই শাসকের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, দুজনেই অধিকার আদায়ের দাবীতে সোচ্চার ছিলেন।
আমি জানি, চাইলেই এসব বিভাজন আলাদা করা যায় না। বাঙালী, গারো, চাকমা, হিন্দু; বিভাজন এসেই যায়। এটা শুধু বাংলাদেশে না, পৃথিবীর সব দেশের ক্ষেত্রেই সত্য। কিন্তু আমি এভাবে মানুষকে দেখতে চাই না। অন্তত আমার দেশের মানুষকে না। মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায় মানুষকে। ভালো, খারাপ। অথবা শাসক, শোসিত। অথবা ধনী-দরিদ্র। মুক্তিযদ্ধের সময় শালবনের বাসিন্দারাও যুদ্ধ করেছিলো, রক্ত দিয়েছিলো। ওহো, তাদেরকে আলাদা করে বলছি কেন! একসাথে যুদ্ধ করেছি আমরা, কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পর আমরা তাদেরকে ‘ওরা’ করে দিলাম। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টি তো, চাইলেই করা যায় শোষণ, তাই না? কখনও ভেড়া চড়ানোর নামে, কখনও কৃত্রিম লেক প্রতিষ্ঠার নামে, কখনও তুঁত গাছ রোপনের নামে, কখনও বিমান বাহিনীর ফায়ারিং রেঞ্জ প্রতিষ্ঠার জন্যে কেড়ে নেয়া হলো তাদের বাসস্থান। এতসব করেও ক্ষান্ত হলে না শাসকযন্ত্র? রক্তপান করতে হলো মাটির ছেলের? অবশ্য কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে দেয়াল তুলে বিভেদ গড়লে এই পরিণতি তো অবশ্যম্ভাবী!
"১৯৬২ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভণর আজম খান মধুপুর বনে ৪০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে ন্যাশনাল পার্ক বা জাতীয় উদ্যান প্রতিষ্ঠার প্রকাশ্য ঘোষণা করে এবং এই ঘোষণার প্রেক্ষিতে প্রায় ২১ হাজার একর এলাকায় যেখানে হাজার হাজার মান্দিরা বসবাস করছে সেখানে কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়”।
আমি জানি না এখনও সেখানে কাঁটাতারের বেড়া আছে কি না। আমি জানি না ২০০৪ পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ। শুধু জানি পীরেন স্নাল আমাদেরই ভাই। তাদেরকে দেয়াল দিয়ে আলাদা করার অধিকার কারো নেই। এই দেশ, এই মাটি, এই আলো-হাওয়াতে সবারই পূর্ণ অধিকার আছে।
আরেকটু ঘাঁটলাম। মধুপুর উদ্যান না কি ঘোরাঘুরির জন্যে চমৎকার জায়গা। এখানে দুটি পিকনিক স্পট আছে, দুটি কটেজও আছে আপনার বিলাসেব্যসনের জন্যে। এই অতি মনোহর পিকনিক স্পট এবং কটেজ আমি চিরদিনের জন্যে বর্জন করলাম। আমি ভোগবাদী মানুষ, একটু কম ভোগ করার ভেতরেই আমার যা বাহাদুরি!
মাদলের প্রতিটি সদস্যকে আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শ্রদ্ধা জানাই। আপনারা শুধুমাত্র একটি গান রচনা করেন নি, জন্ম দিয়েছেন মহান বোধের। এই পপকর্ন সংগীতের যুগে আপনাদের মাঝে বিশুদ্ধতা খুঁজে পাই। পীরেন স্নাল, আপনি বেঁচে থাকবেন শালবনের প্রতিটি পাতায়, পাখির ডানায়, মাটির সোঁদা গন্ধে।
“তারা উন্নয়নের নামে দেখ দেয়াল তোলে
তারকাটাতে ভিন্ন করে মা আর ছেলে
এত দিনের জীবনবোধে হানলো কারা
মায়ের ছেলে হোস যদি রে রুখে দাঁড়া
সেই প্রাণের ডাকে প্রাণ মেলাতে ছুটে গেছে
দামাল ছেলের রক্তে মায়ের বুক ভেসেছে”
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:৪৯