সেইদিন দাদী গোসল করে ঘরে আসলো। আমার সামনে অবলীলায় শরীরের ঊর্ধাঙ্গ অনাবৃত করে জামা কাপড় বদলাতে লাগলো। তের বছর বয়সের বালকের কামনা ভয়ংকর হয়। কিন্তু দাদীকে দেখে আমার বিবমিষা লাগলো। ঐ ঝুলে থাকা স্তনের মত কুৎসিত আর কী হতে পারে! আমি বিবমিষায় জর্জরিত হয়ে চোখ ফিরিয়ে নেই।
সেদিন এই ডাইনি আবার আমার মাকে ধমক খাইয়েছে বাবার কাছে। কারণ খুব সামান্য। সে দুধ চেয়েছিলো। কিন্তু আমার মা সেমাই রান্না করে দুধ আগেই শেষ করে ফেলেছিলো। ছোট ভাইটা জেদ ধরেছিলো সকালে সেমাই ছাড়া নাস্তা করবে না। তাই বাধ্য হয়ে দাদীর ভাগের দুধটাকে দিয়ে সেমাই তৈরি করে ফেলেছিলো। ঐদিন সকালেই আবার গোয়ালার এসে দুধ দিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সে আসে নি। তাতেই এই বিপত্তি। আমার বাবা বিশালদেহী জাঁদরেল লোক। তার ধমক শুনলে সোমত্ত পুরুষও পিছু হটবে। আর আমার মা তো দুর্বল এক নারী!
আমার দাদা ভালো মানুষ ছিলো। মারা গেছে বছর পাঁচেক হলো। দাদা আমাকে কিনে দিতেন চকলেট আর সুপার বিস্কুট। সুপার বিস্কুটের স্বাদ ভুলতে পারি না। দাদীর কারণে দাদার সাথেও আমার বাবা অনেক কলহ করেছেন। দাদা আর বাবা দুজনেই রাগী মানুষ। তাদের ঝগড়া একটা দেখার মত বিষয় ছিলো। তবে একটা সময় দাদা হাল ছেড়ে দিয়ে গম্ভীর মুখে পায়চারি করতে শুরু করতেন। তাকে দেখে আমার মায়া লাগতো। দাদীকে দেখে কখনও লাগে নি।
অথচ এই মাঝরাত্তিরে দাদীর ডুকরে ডুকরে কান্না শুনে কেমন যেন অসহায় লাগছে। জীবন সায়াহ্নে থাকা মানুষের কী নিয়ে দুঃখ হয়? মরে যাবে বলে? কাছের মানুষ চলে গেছে বলে? যৌবন হারিয়ে ফেলেছে বলে? এই সমস্ত প্রশ্নের জবাব পাওয়ার মত বড় আমি কখনও হতে পারবো কি না জানি না। দাদীকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে না। তার সাথে প্রশ্ন করার মত সম্পর্ক নেই। দাদী কাঁদছে হুহু করে। ডিমলাইটের নীল আলোয় পরিবেশটা কেমন যেন ভৌতিক লাগছে। পরিবেশটা অশুভ। মনে হচ্ছে তার কান্না শুনে আজরাইল চলে আসবে। আমার ভয় করছে।
দাদী এখন প্রতিরাতেই কাঁদে। প্রতি রাতেই তার কান্না আগের চেয়ে দীর্ঘ আর প্রলম্বিত হয়। সে কি মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করে? ও দাদী, তুমি কি ভয় পাও? ভয়ের কী আছে? আমি আছি না? কান্না পাইলে আমারে ডাকো না কেন? ভয় পাইলে আমারে বলো না কেন? আমার মায়া লাগে। আমি দাদীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি “ও দাদী, কান্দো কেন?”। দাদী আমার প্রশ্নের উত্তর দেয় না। একমনে কেঁদে যায়। তার এই বিজাতীয় বিষাদ অরণ্যে আমার প্রবেশাধিকার নেই।
প্রতিরাতে এই কান্নার শব্দ শুনতে আমার আর ভালো লাগে না। জিজ্ঞেস করলেও কোন উত্তর দেয় না। সারাদিন তো ভালোই থাকে। রাত হলে কী এমন হয়? আমার সকালে ইশকুল। ঘুমাতে হবে না? ও দাদী, একটু থামো না? এত কান্নার কী আছে? মাথায় তেল দিয়ে দিবো? তাহলে মাথা ঠান্ডা হবে। সুনিদ্রা হবে। দাদী ঘুমায় না। দাদী কান্দে।
এক রাতে দাদী আর কান্দে না। আমার কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। তার নিঃশ্বাসের শব্দটা ঠিক স্বস্তিকর না। ঘরঘর শব্দ হয়। অসুস্থতা আর বয়স কি সবকিছুকে অসুন্দর করে দেয়? হঠাৎ একটা ঝাঁঝালো গন্ধ পাই। প্রস্রাবের। এই কিছুদিন আগে আমিও বিছানায় প্রস্রাব করেছি। এখন দাদী করছে। দাদী আসলে শেষের দিকে এগুচ্ছে, নাকি শুরুর দিকে? আমার গন্তব্যও কি এরকম চক্রাকার? দুইজনের দুই বিন্দু কি একসাথে মিলে যাবে?
পরের দিন।
দাদী আবার কাঁদছে। আমিও কাঁদছি। দুজন দুজনের মত করে কাঁদছে। পুরো বাড়ি নিজঝুম। আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত কান্নাঘরে কেউ আসে না ভাগীদার হতে। শুধু বাতাসের হাহাকার আসে জানালা থেকে। আর কোত্থেকে যেন উড়ে আসে একটা চামচিকা। সে ঘরের ভেতর চক্রাকারে উড়তে থাকে, আর মাঝেমধ্যে কাছে এসে ডানা ঝাঁপটিয়ে যায় একান্ত স্বজনের মত।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০২১ দুপুর ২:৩৩