আমি এতদিন জানতাম যে রেহানা মরিয়ম নূর এর কাহিনী হচ্ছে মেডিকেল কলেজে একটা মেয়ের এ্যাবিউজড হওয়ার ঘটনা জেনে ফেলার পর রেহানা নামক একজন শিক্ষিকার সংগ্রামের কাহিনী। এটাকে মূল গল্প হিসেবে ধরতে গেলে অনেক কিছু মিস করে ফেলবেন। যেমন করেছিলো সনিতে দেখতে উপস্থিত দর্শকেরা। ছবি শেষ হবার পর তাদের প্রতিক্রিয়া শুনছিলাম টুকটাক আশপাশ থেকে “কী, শেষ হয়ে গেলো?” “সত্যি শেষ?”, “স্টোরি তো দাঁড়াইলোই না”- এরকম।
আসল গল্পটা আপনাদের বলি। আসল গল্পটা হলো, রেহানার শিশু কন্যাসন্তান স্কুলে দুরন্ত এক ছেলের দ্বারা আক্রান্ত হবার পরে তার হাতে কামড় দেয়। এজন্যে তাকে ট্রায়ালের মুখোমুখি হতে হয়। অভিভাবক থেকে শিক্ষক, সবার কথা হচ্ছে রেহানার মেয়ে ইমুকে ক্ষমা চাইতে হবে তার কৃতকর্মের জন্যে। কিন্তু রেহানা তার মেয়েকে ক্ষমা চাইতে দেবে না। তার কথা হচ্ছে যে দুষ্টু ছেলেটা আগে তাকে চিমটি কেটেছে তাকে ক্ষমা চাইতে হবে। যদি না চায়, ইমুও ক্ষমা চাইবে না। ছেলেটা প্রায়ই এই অকাজটা করতো। এখন অভিভাবক, সমাজ, শিক্ষকরা যদি তাকে প্রশ্রয় দেয়, তাহলে কী হবে?
ওহ হ্যাঁ, এখন মেডিকেল কলেজের হ্যারাজমেন্টের কথাটা বলা যায়। সিনেমার শুরুতে রেহানা একটা পরীক্ষার পরিদর্শক হিসেবে কক্ষে প্রবেশ করে। খুব কড়াভাবে গার্ড দিতে থাকে। মিমি নামের একটা মেয়ে স্কেলে নকল করে নিয়ে আসায় তাকে বহিষ্কৃত করে রেহানা। ঐদিনই ঐ হলেরই একটা মেয়ে, এ্যানি মিমির পক্ষে কথা বলার জন্যে একজন পুরুষ শিক্ষকের কক্ষে যায়, এবং সেখানে এ্যাবিউজড হয়। রেহানা সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয়।
এখান থেকেই রেহানার সংগ্রামের শুরু, এবং বাকিটুকু খুব একটু অননুমেয় নয়। মেয়ে নিজের শিক্ষাজীবনের কথা চিন্তা করে আর এগুতে চায় না। আর যাদের যাদের কাছে অভিযোগ জানানো হয়, কেউ সহযোগিতা করতে রাজী নয়। তারপর রেহানার সেই ক্লান্তিকর একা একা পথ চলা, চাকুরি এবং ক্যারিয়ার পর্যন্ত হুমকির মুখে পড়ে যাওয়া এরকম গল্প আপনারা অনেক দেখেছেন এবং শুনেছেন।
তাই বাকিটুকু সিনেমাতেই দেখে নিয়েন।
সিনেমাটা আমার অনেক ভালো লেগেছে। কারণ, এটা নির্মেদ এবং অর্থপূর্ণ। দৃশ্যগুলির মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ আছে। কোন দৃশ্য অথবা সংলাপ অযথা মনে হবে না। একটার সাথে একটা জট পাকিয়ে কাহিনী জটিল হতে থাকে, এবং দর্শককে অনায়াসে এই জটিলতায় টেনে নেয়। অনেক সময় সরাসরি কিছু না বলেও অনেককিছু বলে দেয়া হয়। অযথা কাহিনী টেনে ক্লিশে করা হয় নি। যেমন, রেহানা যখন এ্যাবিউজারের বিরুদ্ধে কলেজে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত, সেই সময় একটা দৃশ্যে দেখা যায় সে তার মেয়ের সাথে Guess Game খেলছে। তখন কোন শব্দ শোনা যায় না। হঠাৎ করে মেয়েটা বলে ওঠে, “মা পারে নাই, পারে নাই!”।
হ্যাঁ, মা আসলেই পারছিলো না।
রেহানা যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। তখন তার এক কলিগ তাকে একটা গল্প বলে। একজন মাকে বাঁচানোর জন্যে ছেলে কিডনি দিতে চায়, কিন্তু তার স্ত্রী রাজী না এতে। পরে তাকে মিথ্যে করে বলা হয় যে মায়ের সাথে তার টিস্যু মেলে নি। ছেলেটি আর কিডনি দিতে পারে না। তার তিন সপ্তাহ পর মা মারা যায়। এই যে একটা মিথ্যা কথা বলা হলো, তা কতটা জাস্টিফাইড? রেহানাও কিন্তু একটা খুব বড় মিথ্যা কথা বলেছিলো। সেটা কতটুকু জাস্টিফায়েড? রেহানা কি ভুল করে না? এখানে এ্যাবিউজার দানব না আর রেহানাও মহামানবী না। ভুল আসলে আমাদের সিস্টেমে। যেখানে ছোট্ট ছোট্ট ভুল শৈশব থেকে শিক্ষা দেয়ার ফলে ভুলেরা দানবীয় হয়ে ওঠে। সেগুলি শুধরানোরও কোন উপায় থাকে না।
এ্যানির সাথে কথা প্রসঙ্গে জানা যায় রেহানার ইচ্ছে ছিলো টেবিল টেনিস খেলোয়াড় হওয়ার। কিন্তু সে তা হতে পারে নি? কেন? এর উত্তরে রেহানা কিছু বলে না। কিন্তু দর্শকদের অনুমান করতে কষ্ট হবার কথা না!
তার সাথে কথা প্রসঙ্গে একজন বলে যে সে এখনও নোজপিন পরে, এটা ভালো। যাদের মনের মধ্যে কৌতূহল ছিলো যে রেহানার স্বামী কোথায় তারা উত্তর পেয়ে যাবেন।
পুরো ছবিতে নীল রঙের ব্যবহার একটা চমৎকার আবহ তৈরি করেছে। তা রেহানার হিমশীতল, কিন্তু ঋজু ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করে। আবহ সঙ্গীতের ব্যবহার তেমন নেই, কিন্তু টেনশনের মুহূর্তে ঘড়ির টিকটিক শব্দ, প্রিন্টার, সিলিং ফ্যানের বিজবিজে আওয়াজ সুচারূভাবে কাজে লাগানো হয়েছে।
আর অভিনয়ের কথা না বললেই নয়। রেহানা চরিত্রে বাঁধন ছিলেন অসাধারণ। তার মেয়ের চরিত্রে শিশুশিল্পীটারও প্রশংসা না করলেই নয়। একদম ছোট চরিত্রগুলিও এক্সপ্রেশন এবং সংলাপ প্রক্ষেপণে নিখুঁত ছিলো। আর এ কারণেই ছবিটা এত জমজমাট লেগেছে।
আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ এর প্রথম ছবি “লাইভ ফ্রম ঢাকা” দেখে অভিভূত হয়েছিলাম। “রেহানা মরিয়ম নূর”ও প্রত্যাশা মিটিয়েছে শতভাগ।
হ্যাঁ, অবশ্যই রেহানা মরিয়ম নূর Totally worth the hype!
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই নভেম্বর, ২০২১ রাত ১১:০০