সেলুনে গিয়েছিলাম ছেলেকে নিয়ে। উদ্দেশ্য, তার চুল কাটানো এবং আমার শেভ করা। যদিও দুজনের চুলই যথেষ্ট বড় হয়েছিলো, কিন্তু চুল বিষয়ে বাপ-ব্যাটার দর্শন আলাদা। রুহিন চুল একটু বড় হলেই অস্থির হয়ে যায়, আর আমি চুল সহজে কাটাতে চাই না। কিন্তু চেয়ারে বসার পর বিহারী বাকপটু নাপিত কীভাবে কীভাবে যেন আমাকে চুল কাটতে প্ররোচিত করে ফেললো। তার কথা হচ্ছে, আমি লম্বা মানুষ, মাথাটা বড়, চুল বড় রাখলে আরো বড় বড় লাগে ইত্যাদি। খুব কনভিন্সিং যুক্তি না যদিও, তবুও রাজী হয়ে গেলাম।
নাপিতটা টিপিক্যাল বিহারী নাপিতদের মতই। প্রচুর কথা বলে, আর গান শোনে। সে ছেড়ে দিয়েছিলো উর্দু ইসলামিক গান। গানের কথা তেমন বুঝি নি, তবে বোঝা যাচ্ছিলো আল্লাহ’র প্রশংসা জাতীয় কিছু। সে তো একদম ভক্তিতে গদগদ! গানের তালে প্রায় দুলে দুলে চুল কাটছে। এর মধ্যে এলেন হুজুর চেহারার একজন বয়স্ক লোক। খাঁটি ইসলামিক লেবাসের একজন বরিশাইল্যা। কথা কম বলেন। নাপিতের কথায় হ্যাঁ হু করছেন। এদিকে নাপিত তখন আবেগের নাইনথ ক্লাউডে! ভক্তির চরম শিখরে! এই সময়ে সে লেবাসধারী বরিশাইল্যা হুজুরকে পেয়ে তো খুবই আহ্লাদিত। সে চিন্তাভাবনা করে হুজুর খুশি হবেন এমন লাইনে কথা চালিয়ে যাওয়ার পায়তারা করলো-
-বলেন তো হুজুর সবচেয়ে বড় ধর্ম কী?
উত্তর আমাদের সবারই প্রত্যাশিত। যেহেতু প্রশ্নটা করা হয়েছে একজন হুজুর লেবাসধারী ব্যক্তিকে। কিন্তু তিনি উত্তর দিতে তেমন একটা উৎসাহিত নন। বিহারী নাপিত আবারও জিজ্ঞাসা করলো,
-বলেন না হুজুর সবচেয়ে বড় ধর্ম কোনটা?
হুজুর এবার অনুত্তেজিত কন্ঠে উত্তর দিলেন,
-ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করবা না। তুমি সবার চেয়ে বড় এমন অহংকার করা ভালো না।
বিহারী নাপিত কিছুটা দমে গেলো। কিন্তু সেও হাল ছাড়ার পাত্র না। বললো,
-যেটা সত্যি, সেইটা কি চাপা থাকে? এই যে আপনি আমার চেয়ে বয়সে বড়। এটা তো না বললেও সবাই জানে। তেমনই মুসলমানের ধর্ম সবচেয়ে বড় আর সেরা এই কথাও সবাই জানে। না কি হুজুর?
কিন্তু হুজুরকে মোটেও টলানো গেলো না। তিনি নিজের ধর্মকে অবশ্যই ভালোবাসেন, এতে কোন সন্দেহ নেই, তবে এ নিয়ে প্রকাশ্যে উচ্চবাচ্য করার মত মানুষ তিনি না। কিছুক্ষণ নাপিতের সাথে টুকরো টুকরো কথাবার্তা চালিয়ে নিজের কথা বলার সংকোচ কাটিয়ে এবার গল্পের ঝাঁপি খুলে বসলেন,
-আমার একটা অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেলো। তখন আমার বয়স কম। যাত্রাবাড়ীতে এক হোটেলে খাইতে গেলাম। হিন্দুর হোটেল। খুবই বাজে খাবারের কোয়ালিটি। ঠিক করলাম যে আর জীবনেও হিন্দুর হোটেলে খাবো না। তার পরের দিন, আমি এক জায়গায় বেড়াইতে যাবো। মিষ্টি কেনা দরকার। মিষ্টি কিনলাম এক দোকান থেকে। কেনার পর দেখি যে মালিকের গলায় পৈতা। মানে ঐটাও হিন্দুর দোকান।
ভদ্রলোকের কাহিনী শুনে আমি মুগ্ধ। কী চমৎকার ভাবে জীবনের আয়রনি অনুধাবন করেছেন, এবং নিশ্চিত যে এ থেকে তিনি শিক্ষাও নিয়েছেন।
আমি জীবনে এই প্রথমবারের মত চুল কাটার সময় চলতে থাকা গল্পে অংশ নিলাম। নাপিতকে গল্পটার শিক্ষা বুঝিয়ে বললাম। সেও বেশ মাথা নাড়ালো।
উর্দু ইসলামিক গান তখনও চলছে। কিছুক্ষণের মধ্যে আবারও নাপিতের জোশ ফিরে এলো। এই বেকায়দা স্বভাবের হুজুরের সাথে একটা দফারফা করে ফেলা দরকার। তাই সে আরো একটা জ্বলন্ত বিষয় সামনে তুলে আনলো,
-তবে যত যাই কন। একটা শ্রেণিরে আমি খুবই ঘৃণা করি এতে আমার পাপ হোক আর যাই হোক।
-তারা কারা?
-তারা হইলো শিয়া।
-শিয়াদের খারাপ লাগলেও তুমি ঘৃণা করতে পারবা না।
-আরে হুজুর, ওরা জাইনা শুইনা ভুল করতেছে।
-ভুল করুক। যদি সে তার ভুল বুঝে তওবা করে, দেখা যাবে সে তোমার আগে বেহেশতে যাবে। তাই কাউকেই ঘৃণা করা যাইবে না।
এ কথার পর হতাশ হয়ে বিহারী নাপিত আর তেমন কথা না বলে চুল কাটতে লাগলো মন দিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে চুল কাটা শেষ হয়ে গেলো। আমি একজন সত্যিকারের মুক্তমনা মানুষের কাছ থেকে জীবন এবং ধর্ম বিষয়ক চমৎকার কিছু অনুধাবন শোনার সুন্দর অনুভূতি নিয়ে ছেলের হাত ধরে বাড়ির পথে রওনা দিলাম।
এই বরিশাইল্যা হুজুর কথা কম বলেন। কিন্তু তার প্রচুর কথা বলা উচিত। সম্ভব হলে ওয়াজের সুপারস্টার হওয়া উচিত। আমাদের ভেতরের সংকীর্ণতা দূর করার জন্যে তারাই যোগ্যতম মানুষ। তার জন্যে ভালোবাসা।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০২১ রাত ১০:০১