somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প- নিছকপ্রতিবার

২০ শে জানুয়ারি, ২০২২ রাত ১০:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


অফিস থেকে বের হয়ে বদরুলের মন ফুরফুরা হয়ে গেলো। আজকে সপ্তাহের শেষ দিন। আগামীকাল ছুটি। এখন ভালো দেখে একটা বৃহস্পতিবার খুঁজে বের করতে হবে। সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস হলে ভালো। কোথায় পাওয়া যেতে পারে ভালো বৃহস্পতিবার? সে নিউমার্কেটে খুঁজেছে, নেই। হকার্স মার্কেটে খুঁজেছে, নেই। পলওয়েল মার্কেটে খুঁজতে গিয়েও বিব্রত হতে হয়েছে। তারা বৃহস্পতিবার চেনেই না। নাহ, এভাবে আর পোষাচ্ছে না। টাকা পয়সা খরচ করে হলেও ভালো দেখে একটা বৃহস্পতিবার কিনে নিতে হবে। অন্তত আজকে রাতের জন্যে। কিছুক্ষণ এলোমেলো হাঁটলো সে। একবার গেলো কাকরাইলের দিকে, আরেকবার দিলকুশার দিকে, আরেকবার যাত্রাবাড়ী। তার বাসা মিরপুর। মিরপুরে কোথাও ভালো বৃহস্পতিবার পাওয়া যায় না। অনেক খুঁজে দেখেছে সে। তাই অত্র এলাকায় না পেলে অন্য এলাকাতেই দেখতে হবে। তাকে ইতস্তত ঘুরতে দেখে একজন বাইকার এসে থামলো তার পাশে।
-কই যাবেন ভাই?
-বৃহস্পতিবার পাওয়া যায় এমন কোন জায়গায় নিয়ে যান।
-বৃহস্পতিবার তো পাওয়া মুশকিল এই আকালের সময়ে। তবে আপনি যখন এত করে বলতেছেন, তো পাঁচশ টাকা ভাড়া দিয়েন। খুঁজে খুঁজে একটা ভালো বৃহস্পতিবার বের করে দিবো।
পাঁচশ টাকা! এ কেমন ডাকাতে আবদার! বদরুল বুঝলো এভাবে হবে না। সে বাইকারটিকে বিদায় করে দিলো। এর চেয়ে বাসে করেই যাওয়া ভালো। সে শুনেছে শুক্রাবাদে ভালো বৃহস্পতিবার পাওয়া যায়। সে অবশ্য কখনও ট্রাই করে দেখে নি। তবে বন্ধুরা তাকে প্রায়ই বলে শুক্রাবাদে গিয়ে বৃহস্পতিবার কিনতে। কিন্তু কেন যেন কোন সপ্তাহান্তেই তার শুক্রাবাদে নামা হয় না। শুক্রাবাদে এলে গাড়ি হুশ করে বেরিয়ে যায়। তার চোখে নামে ঘুম, শরীরে জেঁকে ধরে ক্লান্তি। শুক্রাবাদে তবে কি কখনই নামা হবে না তার? শুনেছে শাহবাগ আর বাংলা মোটরেও বৃহস্পতিবার পাওয়া যায়, তবে সেখানে অনেক দাম। তাই ওসব জায়গায় আর তার যাওয়া হয় না।
শুক্রাবাদ জায়গাটা চেনার একটা সহজ তরীকা আছে। ঢাকা শহরের দীর্ঘতম আবর্জনার স্তূপ সেখানে। ঘুমিয়ে পড়লে হঠাৎ করে নাকে ধক করে গন্ধ এসে লাগে। তখন বোঝা যায় যে শুক্রাবাদ এসে গেছে। এবারও সে কীভাবে যেন শুক্রাবাদে আসার আগে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো। বাসটাও সুযোগ বুঝে কেটে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো। গন্ধের ধকে সে জেগে উঠলো। পড়িমড়ি করে গেটের কাছে গিয়ে বাসের বডিতে দুটো চাপড় দিলে তাকে শুক্রাবাদে নামিয়ে দিতে বাধ্য হয় ড্রাইভার। এখন দেখা যাক এখানে বৃহস্পতিবারের দর কেমন। আশেপাশে আছে মাঠ, কলেজ, রেস্টুরেন্ট আর লেক। সে কোথায় গিয়ে বৃহস্পতিবার খুঁজবে? এক লোক সামনে সিগারেট বিক্রি করছে। তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-ভাই, এখানে বৃহস্পতিবারটা কোথায়?
-এ্যাঁ? বার? এই সিঁড়ি ধইরা সোজা উইঠা যান, বার পায়া যাইবেন।
সে দেখিয়ে দিলো।
কথামত বদরুল বৃহস্পতিবার খুঁজতে উপরে উঠে গেলো। জায়গাটা কেমন যেন আলো-আঁধারিতে আবৃত। চিকচিক করে আবার ডিসকো লাইটও জ্বলছে। প্রচুর হল্লা করছে মানুষ। তাকে ঘিরে ধরলো কয়েকজন উর্দি পরা লোক।
-কী লাগবো মামা, হুইস্কি, ব্র্যান্ডি, ভদকা?
-আমার বৃহস্পতিবার লাগবে। দাম কেমন?
-হ, বৃহস্পতিবারে বইসা খাইতে পারেন। এক বোতল ২২০০ টাকা। ফ্রেশ মাল। লইয়া যান।
-নাহ, দামটা বেশি মন হচ্ছে। কমে হবে না?
-হাফ ১১০০ টাকা, লইয়া যান।
-আচ্ছা দেন, ভালো দেখে দিয়েন।
তাকে কাগজে মুড়িয়ে একটা বোতল ধরিয়ে দেয়া হলো।
সে খুশিমনে বৃহস্পতিবার হাতে নিয়ে বের হলো। তার বাজেট ছিলো ২০০০ টাকা। আরো বিভিন্ন রকম বৃহস্পতিবার কিনে ফেলা যেতেই পারে। সে কাগজে মোড়ানো বোতলটা নিয়ে সামনেই আরেকটা মার্কেটে ঢুকলো। ধানমন্ডির মার্কেট, চাকচিক্যই আলাদা। সুসজ্জিত সব দোকান। ফোনের, গেজেটের, পোষাকের, খাবারের। সবই আছে, কিন্তু বৃহস্পতিবার কোথায়? সে ফোনের দোকানে গিয়ে বৃহস্পতিবার খুঁজলো, পেলো না। পোষাকের দোকানেও নেই। অবশেষে একটা স্ন্যাকসের দোকানে গিয়ে খুঁজলে তাকে একটা কোক আর প্রিঙ্গেল ধরিয়ে দিয়ে বলা হলো, এগুলোই বৃহস্পতিবার। বৃহস্পতিবার বগলদাবা করে সে বের হলো মার্কেট থেকে।
ল্যাম্পপোস্টের আলোয় হাঁটতে ভালো লাগছে। এই হৈ-হল্লা, কোলাহলও উপভোগ্য মনে হচ্ছে। অবশেষে বৃহস্পতিবারকে আটক করা গেছে! কিছুদূর হাঁটার পর তাকে পুলিশ ধরলো।
-এই ব্যাগের মধ্যে কী? দেখান।
-এর মধ্যে আছে বৃহস্পতিবার।
-কীসের বৃহস্পতিবার? চেক করবো।
বদরুল অম্লান বদনে ব্যাগ থেকে কেরুর ব্র্যান্ডির বোতল বের করে দেখালো। তার এমন সরলতায় আপ্লুত হয়ে পুলিশ তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো কিছুক্ষণ। তারপর চোখ মুছে বললো,
-ভাই, তোমার মত মানুষ হয় না। অন্য কেউ হইলে আমি বোতলটাই রেখে দিতাম। কিন্তু তুমি বলে শুধু পাঁচশ টাকা নিয়ে ছেড়ে দিবো। দেও ভাই, পাঁচশ টাকা দেও।
বদরুলের মনে হলো এও বৃহস্পতিবারের এক আয়োজন। সে পাঁচশ টাকা বের করে দিলো। পুলিশ তার সাথে করমর্দন করে ডিউটিতে চলে গেলো।
সে বৃহস্পতিবার হাতে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। যাওয়ার পথে তার খুব তৃষ্ণা পেলো। বাসের মধ্যে বসে চুকচুক করে বৃহস্পতিবার পান করতে লাগলো। জিনিসটা তেতো। তবে কিছুক্ষণ খাওয়ার পর একটা আবেশ আসে। ভালোই লাগছিলো। কিন্তু অন্যান্য যাত্রী এবং কন্ডাক্টররা কী কারণে যেন ক্ষেপে উঠে তাকে বাস থেকে নামিয়ে দিলো। তার খুব দুঃখ হলো তখন। সে বাকি পথটা হেঁটেই যাবে ঠিক করলো। চুকচুক করে বৃহস্পতিবার পান করতে করতে তার কেমন যেন অস্বস্তি লাগা শুরু হলো। পেটের ভেতর একটা দলা পাকানো অনুভূতি। যেকোন মুহূর্তে উদগীরণ ঘটে যেতে পারে। অবশ্য বাসা প্রায় এসেই গেছে। এটুকু সময় চেপে রাখতে হবে আর কী।
বাসায় গিয়ে সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। বেসিনের মধ্যে উগড়ে দিলো উগ্র তরল। তার মেসমেটরা রাগ চেপে রেখে ধৈর্য ধরে তার বমন প্রক্রিয়া শেষ হবার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো।
বমি শেষ হবার পর সে যখন একটু জিরিয়ে নিচ্ছে, ক্যালেন্ডারে চোখ বুলিয়ে নিয়ে দেখলো, আজকে বুধবার। তার বুক ভেঙে আর্তনাদ বেরিয়ে এলো।
-সদরুল ভাই! সর্বনাশ হয়ে গেছে!
তারস্বরে ডাকলো মেস ম্যানেজারকে।
-কী হয়েছে?
-আজকে বুধবার। অথচ আমি জানতাম যে আজকে বৃহস্পতিবার!
-ঠিকই তো আছে। আজকে বুধবার, গতকাল বুধবার ছিলো, আগামীকালও বুধবার।
-বৃহস্পতিবার কবে তাহলে?
-বৃহস্পতিবার আবার কী?
সে সন্দিঘ্ন চোখে তাকিয়ে থাকলো।
বদরুল আর কথা বাড়ালো না। ঘুম থেকে উঠে সকাল হলেই বৃ্হস্পতিবার চলে আসবে। এইসব শনিবার, রবিবার, সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবারের চক্র থেকে তাকে বের হতে হবে। সে একদিন চলে যাবে চিরবৃহস্পতিবারের দেশে। সেখানে পথে, মাঠে, ঘাটে, ফুটপাথে, মার্কেটে, সবখানে বৃহস্পতিবার পাওয়া যাবে।
বদরুল কেরুর বোতলটা ময়লার বাক্সে ফেলে বসে বসে কুটকুট করে প্রিঙ্গেলস খেতে লাগলো। সতর্ক চোখে তাকিয়ে থাকলো ক্যালেন্ডারের দিকে। কখন বৃহস্পতিবার রাত এসে যায় কিচ্ছু বলা যায় না!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জানুয়ারি, ২০২২ রাত ১০:৪৬
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×