somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘দুর্ভিক্ষকন্যা’ বাসন্তী

১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৭৪-এর ‘দুর্ভিক্ষকন্যা’
বাসন্তীকে হয়তো কেউই মনে
রাখেনি। তবে তিনি
প্রতিনিয়ত তার আশপাশের
লোকজনকে মনে করিয়ে
দিচ্ছেন সেই ভয়াবহ ’৭৪
সালের কথা। স্মরণ করিয়ে
দিচ্ছেন সেই দুর্ভিক্ষকে,
যাতে অনাহারে মারা
গিয়েছিল প্রায় দশ লাখ
বাংলাদেশী। কুড়িগ্রামের
চিলমারী উপজেলার সেই
বাসন্তী আজও বেঁচে আছেন
খেয়ে- না খেয়ে। দেশের
দুর্ভিক্ষ বহু আগে শেষ হলেও
বাসন্তীর প্রতিটি দিন এখনও
তার জীবনে দুর্ভিক্ষ হয়েই
আসে। তখন ১৯৭৪ সাল।
চারদিকে শুধু হাহাকার।
কোথাও খাবার নেই, পানি
নেই। যতসব অখাদ্য খেয়ে জীবন
ধারণের চেষ্টা করছে মানুষ।
ঠিক সে সময় পত্রিকার
পাতাজুড়ে প্রকাশিত হয় একটি
করুণ ছবি। আর তাতেই তোলপাড়
হয়ে যায় সমগ্র বিশ্ব। দুনিয়ার
দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় বাংলাদেশের
মরণাপন্ন কোটি মানুষের
প্রতি। ছবিটিতে দেখা যায়,
জাল পরিহিতা বাসন্তী
কলাগাছের তৈরি ভেলা
ঠেলছে আর ভেলায় চড়ে তার
বোন দুর্গতি ক্ষুধা নিবারণের
জন্য কলার মাঞ্জা কাটছিল।
এখন প্রায়ই দেখা যায়,
বাসন্তী খুব সকালে আধা-
পেটো কিছু খেয়ে খড়ি
কুড়াতে বেরিয়েছেন। খড়ি
কুড়ানো তার রোজ দিনকার
কাজ। নদীর ধারে প্রচণ্ড
রোদের তাপকে উসকে দেয়া
বালির মাঝে খড়-কুটো
কুড়াচ্ছেন। তিনি একাই আপন
মনে কথা বলছেন আর হাসছেন।
তার ভাষা বোঝার উপায়
নেই। কোনো মানুষকে দেখলে
তার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
খেয়ে-না খেয়ে অনাহারে
অর্ধাহারে তার শরীর ভেঙে
পড়েছে। পরনের কাপড় পুরনো
আর ময়লা। মাথার চুল বেশ
খাটো। দিন বদলের পালায় এ
দেশের অনেক কিছু বদলে
গেলেও ’৭৪ এর দুর্ভিক্ষে
ব্যাপক আলোচিত ক্ষুধা ও
দারিদ্র্যের মূর্ত প্রতীক
কুড়িগ্রামের চিলমারী
উপজেলার আলোচিত
বাসন্তীর কোনো পরিবর্তন
হয়নি। বাকপ্রতিবন্ধী
বাসন্তীর বয়স ৬০ বছর মতো।
কবে, কখন, তার বিয়ে হয়েছে,
কখন স্বামীকে হারিয়েছেন
কিছুই মনে নেই তার। দাম্পত্য
জীবনে সে কখনও সন্তানের মুখ
দেখেননি। বাসন্তী সচেতন
তো নই-ই এমনকি নিজের
ব্যক্তিগত বিষয়েও চিরকাল
অসচেতন রয়ে গেছে। স্বামী-
সংসার হারানোর আগেও
তাকে মা-বাবার ওপর
নির্ভরশীল থাকতে হয়েছে।
পরগাছা হয়ে বেড়ে ওঠা
বাসন্তী বর্তমানে তার
দু’দাদা আশু ও বিশুর ওপর
নির্ভরশীল। জানা গেছে,
কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী
উপজেলার বজরা দিয়ারখাতা
গ্রামের জেলে পরিবারের
বাকপ্রতিবন্ধী বাসন্তীর জন্ম
১৯৪৬ সালে। ব্রহ্মপুত্র নদ
বেষ্টিত বজরা দিয়ারখাতা
গ্রামের অভাবী জেলে
পরিবারের নানান
প্রতিকূলতার মধ্যে সে বেড়ে
উঠতে থাকে। এরপর বাসন্তী
পরিবারসহ জেলে
পরিবারগুলো রাক্ষসী ব্রহ্মপুত্র
নদের ভাঙনের মুখে সবকিছু
হারিয়ে আশ্রয় নেয় রমনা
ইউনিয়নের খড়খড়িয়া গ্রামে।
এখানে আশ্রয় নিয়ে জেলে
পরিবারগুলো ব্রহ্মপুত্র নদে
জাল দিয়ে মাছ ধরে সেগুলো
বাজারে বিক্রি করে
জীবিকা নির্বাহ করতে
থাকে। তখন বাসন্তীর ভরা
যৌবন। ১৯৭০ সালের শেষের
দিকে বাসন্তীর পরিবারের
লোকজন তাকে একই গ্রামের
বাবুরামের সঙ্গে তার বিয়ে
দেয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা
যুদ্ধ শুরু হলে পাক সেনারা
চিলমারীতে আসার আগেই
স্বামী বাবুরাম
বাকপ্রতিবন্ধী স্ত্রী
বাসন্তীকে ছেড়ে একই
এলাকার সাইব রানী নামের
এক বয়স্ক মহিলাকে নিয়ে
প্রেমের টানে ভারতের
সুখচরে চলে যায়। এরপর
বাসন্তীর বড় ভাই আশুরাম দাস,
ছোট ভাই বিশুরাম দাসসহ
জেলে পরিবারগুলো ব্রহ্মপুত্র
নদ পাড়ি দিয়ে চলে যায়
মুক্তাঞ্চল রৌমারীতে। এদের
মধ্যে অনেকেই ভারতের
আত্মীয়স্বজন, শরাণার্থী
শিবির ও মাইনকার চরে আশ্রয়
নেয়। এভাবেই তারা যুদ্ধের ৯
মাস অতিবাহিত করে। দেশ
স্বাধীনের পর বাসন্তীসহ
জেলে পরিবারগুলো ফের
নিজ ভিটে-মাটিতে ফিরে
আসে। কিন্তু পাক সেনারা
যুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাসের
তাণ্ডবলীলায় এই জেলে
পল্লীটি সম্পূর্ণ আগুনে পুড়ে
যায়। তারা খোলা আকাশের
নিচে বসবাস করতে থাকে।
ভাইদের সঙ্গে বাসন্তী নিজ
মাতৃভূমিতে ফিরে এলেও তার
স্বামী বাবুরাম আর ফিরে
আসেনি। অসহায় প্রতিবন্ধী
বাসন্তীর দেখা-শোনার
দায়িত্ব পড়ে তার বড় ভাই
আশুরাম ও বিশুরাম দাসের ওপর।
যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে দেশ
পুনর্গঠনে মুজিব সরকার
জোরেশোরে কাজ শুরু করে। এর
অংশ হিসেবে নিঃস্ব
জেলে পরিবারগুলোকে
পুনর্বাসন করতে সরকারের পক্ষ
থেকে তাঁবু, খাদ্যদ্রব্য, মাছ
ধরার জাল, দড়ি ও আর্থিক
সাহায্য-সহযোগিতা করা হয়।
এভাবেই চলছিল জেলে
পরিবারের জীবনযাত্রা।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ’৭৪-এ
আকস্মিক দুর্ভিক্ষ শুরু হয়।
তত্কালীন জেলা প্রশাসক রুহুল
আমিন মজুমদার দুর্ভিক্ষের
খোঁজ-খবর নিতে একটি জাতীয়
দৈনিক পত্রিকার
ফটোসাংবাদিকসহ
চিলমারীর রমনায় আসেন। এ
সময় জেলা প্রশাসক রুহুল আমীন
মজুমদারকে তত্কালীন রমনা
মডেল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান
আনসার আলী দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে
অবগত করেন। কিন্তু জেলা
প্রশাসক তখনও বুঝে উঠতে
পারেননি এই দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে।
পরে সেই ফটো
সাংবাদিককে ইউপি
চেয়ারম্যান ইউনিয়ন পরিষদ
সভাকক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে
দু’জনে চলে যান জেলে
পল্লীতে। তখন ব্রহ্মপুত্রের নদের
পানি চিলমারীসহ আশপাশের
এলাকাগুলোতে থৈ-থৈ
করছিল । ঠিক সেই মুহূর্তে
জালপরিহিতা বাসন্তী
কলাগাছের তৈরি ভেলা
ঠেলছে আর ভেলায় চড়ে তার
বোন দুর্গতি ক্ষুধা নিবারণের
জন্য কলার মাঞ্জা কাটছিল। এ
ধরনের একটি ছবি দেশের
গুরুত্বপূর্ণ দৈনিক পত্রিকায়
পাতাজুড়ে ছাপা হয়েছিল।
ছবিটি প্রকাশিত হওয়ামাত্রই
বিশ্বমানবতা নাড়া দিয়ে
ওঠে। ওই ছবিটিকে সম্বল করে
জনতার সামনে তত্কালীন
সরকারের ব্যর্থতার বিষয়টি
প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াসে একটুকুও
ত্রুটি রাখেনি সে সময়কার
বিরোধী দলগুলো। তত্কালীন
সরকার বাসন্তীর জালপরা
ছবিটিকে ঘিরে বিব্রতকর
অবস্থায় পড়ে। সরকারের পক্ষ
থেকে ছবিটিকে
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র
বলে আখ্যায়িত করা হয়।
বাসন্তীকে জাল পরানো
হয়েছিল, নাকি দারিদ্র্যের
কারণে সে নিজেই জাল পরে
সম্ভ্রম রক্ষা করেছিল, তা
নিয়ে অনেক বিতর্ক চলেছে।
সে বিতর্কের ইতি টানেনি।
কিন্তু ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষের পর
ছোট বোন দুর্গতির আর খবর
পাওয়া যায়নি। আলোচিত
বাসন্তীকে পুনর্বাসনের জন্য
সরকারিভাবে পরিকল্পনা
গ্রহণ করা হয়েছিল। জোড়গাছ
মাঝিপাড়ায় ২০৪টি
পরিবারের মধ্যে ১৭৬টি হিন্দু
পরিবার এবং ২৮টি মুসলমান
পরিবারকে নিয়ে
সরকারিভাবে বাসন্তী গ্রাম
করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একই
পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৯৬
সালে প্রথম দিকে
দারিদ্র্যবিমোচন কর্মসূচির
আওতায় উল্লেখিত ২০৪টি
পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য
সুদমুক্ত ঋণ প্রদান করা হয়। এ
ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ১২
হাজার টাকা। মোট ৬টি গ্রুপে
ঋণ হিসেবে দেয়া হলেও
বাসন্তীকে কোনো গ্রুপেই
রাখা হয়নি। পরে জমি
অধিগ্রহণ না করতে পারায়
সরকারিভাবে বাসন্তী গ্রাম
নির্মাণের পরিকল্পনাটি
ভেস্তে যায়। সরকারি উদ্যোগ
ব্যর্থ হওয়ার পর কারিতাস
নামের একটি এনজিও ব্রহ্মপুত্র
নদের তীরে প্রায় গ্রাম গড়ে
তোলে। এনজিওটি বাসন্তীর
নামে একটি ঘর বরাদ্দ দেয়।
এটাই ছিল বাসন্তীর একমাত্র
ঠিকানা। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র নদের
ভাঙনে বাসন্তী গ্রামটি
আবারও ভাঙনের মুখে পড়ে। ঘর
সরিয়ে আনা হয় নতুন চরে।
ক্ষুধার জ্বালায় গ্রামটির
অনেক পরিবার কারিতাসের
ঘরগুলো বিক্রি করে দেয়।
বাসন্তী এখন তার দাদার ছোট
ঘরে থাকে। সে নিজে
রান্না করে খেতে পারে
না। নিজের নামের
প্রতিবন্ধী ভাতা কার্ডে ৩
মাস পর ৯০০ টাকা পেলে তা
দাদার হাতে তুলে দেয়।
দাদাদের অভাব-অনটনের
সংসারে খেয়ে না খেয়ে
দিন কাটায়।

তথ্যসূত্র : Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:৪৯
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিচার চাই? না ভাই, আমরা "উল্লাস" চাই

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৩৭





দীপু চন্দ্র দাস একটি পোশাক শিল্প কারখানায় চাকরি করতো। সম্প্রতি দীপু দাস তার যোগ্যতা বলে সুপার ভাইজার পদে প্রমোশন পেয়েছিলো।

জানা যায়, সুপারভাইজার পজিশনটির জন্য আরও তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×