পৃথিবীতে যদি একটি প্রাণও কষ্ট পেয়ে মরে যায়, খুবই অলক্ষ্যে তার দায় এড়ানো অসম্ভব হয়ে যায়। মানুষ স্বার্থরক্ষায় কত সময় কত অবিচার, অন্যায় করেছে- দায় জমা হচ্ছে যুগে যুগে। ভারতের নির্ভয়া, অথবা দিনাজপুরের ইয়াসমিন- দুখের পাত্রে জল জমায়। মানুষ প্রতিবাদ করেছে, করছে, করবে। বিচার হয়েছে, হচ্ছে, হবে। প্রশ্ন একটাই, ধর্ষণ কি কমবে? ধর্ষণ কি আদৌ থামবে? ধর্ষকাম মানুষের সূচনালগ্নের সঙ্গী, মৌলিক কামপ্রবৃত্তিগুলোর একটি- এই ব্যাখ্যাটি সঠিক? নাকি, ধর্ষকামিতা একটি মানসিক বৈকল্য- এই কথাটি সত্য? তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে মৌলিক কাঠামোগুলো- যেমন সামাজিক বিশ্বাস, আচার-নীতি- এগুলো ধীরে ধীরে ভেঙ্গে পড়ছে। রাজন, রাকিব বিকৃতির শিকার হয়ে আমাদের এই সত্যটুকু শিখিয়ে গেছে। তাহলে কি পরাজয়ই সম্বল? ধর্ষণ হবেই- এটা মেনে নিয়েই কি বাঁচতে হবে? এই দুর্বিসহ পরিস্থিতির পরিত্রাণ কি? ধর্ষণ অপরাধ। অপরাধের শাস্তি আছে। বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণের পর হত্যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড। তবুও ধর্ষকরা সাহস পায় কোথা থেকে? আমরা কথায় কথায় ভারতের উদাহরণ টানি। নির্ভয়াকে ধর্ষণের দায়ে চার ধর্ষকের ফাঁসির আদেশ বহাল রেখেছে হাইকোর্ট। আমাদের দেশে শেষ কবে ধর্ষণের অপরাধে কোন ধর্ষকের মৃত্যুদন্ড হয়েছে? নির্ভয়ার ধর্ষকেরা গোটা ভারতবর্ষব্যাপী ধিকৃত হয়েছে। ধর্ষকরা জেলহাজতের ভেতর আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। মানুষের ঘৃণা ও ধিক্কারে শেষ পর্যন্ত ধর্ষকরা নিজেরাই নিজেদেরকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিল। আমরা আয়েশার ক্ষেত্রে কি দেখলাম? ধর্ষক বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। ইউপি সদস্য ধর্ষককে সাহায্য করেছে। ধর্ষিতার পালিত বাবার গরু চুরি করেছে ধর্ষক। আয়েশার বাবা কোথাও গিয়ে বিচার পাননি। একজন বাবার দায়িত্ব তার সন্তানের সব দায় বহন করা। তা করতে না পারলে আর বাবা কিসের? এই বোধে তাড়িত হয়ে আয়েশা ও তার বাবার একসাথে মৃত্যু- আত্মহত্যা অথবা হত্যা। পুলিশ কনস্টেবল হালিমা বেগমের সুইসাইড নোট হয়ত এখনও পুলিশের হাতেই আছে। ধর্ষক এসআই এর বিচার কবে হবে কে জানে। খুব সাম্প্রতিকসময়েই আমাদের লজ্জাস্কর অবস্থাকে হাতে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেল তনু ও রিশা। প্রায়দিনই ধর্ষণ হয়। সাথে যোগ হয় যথেচ্ছা নির্যাতন। বিকৃত আঘাতে কেঁদে কেঁদে কণ্যাসন্তানগুলো মরে যায়, অথবা রক্তস্বল্পতা নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরায়। দু’দিন আগেই জোরাইনে স্কুলপড়ুয়া ছাত্রী ধর্ষিত হয়েছে। প্রশ্ন হল, ধর্ষকরা যায় কোথায়? পালায় কোথায়? আমরা কেন তাদের প্রশ্রয় দেই। এই উৎকণ্ঠার আগুনে বিষফোঁড়া বিচারহীনতা। আমরা কোথায় চাইব ধর্ষণের বিচার। শুধু বাড়ির মেয়েদের সন্ধ্যার আগে ঘরে ফিরতে বললেই কি তারা নিরাপদ হয়ে যায়? এত এত সহিংসতার ঘটনা, এত এত বিচারহীনতার ঘটনা- আমরা কেন পারিনা ধর্ষণবিরোধী একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে। ধর্ষণবিরোধী অভিযানটুকু শুধু অস্ত্রের নয়, এর অনেকটাই নৈতিক। যে বিভৎস পরিস্থিতে আমরা প্রতিটা দিন এগিয়ে যাচ্ছি- এতে করে আমাদের কোন পরিবারটা নিরাপদ? এই নিরাপত্তাটুকু দিতে না পারলে কি করে বাল্যবিবাহ কমবে, জন্মহার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার কমবে? দেশের অনেক স্থানের অনেক শিক্ষার্থী বখাটের ভয়ে স্কুলে যেতে পারে না। সমাজভয়, সম্মান- ভেবে ভেবে জীবনশেষ! বিচার গ্রহণের কেই নেই। কিন্তু যখন আমার পরিবারের কেউ ভিক্টিম? যখন আপনি বা আপনার কাছের মানুষ ভিক্টিম? কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন? কার কাছে বিচার দেবেন? আজকে ধর্ষিতাকে দেখে হাসছেন, কাল যদি আপনার বোন ধর্ষিতা হয়, তখনও হাসবেন? পুলিশ কনস্টেবল হালিমা বেগমকে দেখে তার সহকর্মীরা নাকি হাসাহাসি করত, তিনি ধর্ষিতা হয়েছিলেন বলে। অপমান সইতে পারেননি। আত্মহত্যা করেছেন। আমার নিজেকে খুব অসহায় লাগে, আমি হাহাকারে ডুবি। আমরা আন্দোলন গড়ে তুলি, কিন্তু প্রভাবশালীরা শাস্তি পায় না। কোন সকালটা তাহলে নিরাপদ? কোন সন্ধ্যেটা তাহলে নিরাপদ? রেষারেষি থাকলেই হত্যা, ধর্ষণ- আর ক্ষমতা থাকলে বিচারহীনতা! সামাজিক ন্যায়দন্ডের কতটুকু আর বাকি? এমন দেশতো আমরা চাইনি। এই কলঙ্কগুলো দিনদিন অসহনীয় হয়ে উঠছে। আর তা না উঠকু… নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো/ যেখানে পড়বে সেখায় দেখবে আলো/ ব্যথা মোর উঠবে জ্বলে উর্ধ্বপানে…। সেই সময়টার জন্য অপেক্ষা। ধর্ষিতার রক্তে ছাওয়া দেশ আমরা কেউ চাইনা। আমরা এই সমাজে একজনও ধর্ষক দেখতে চাই না।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মে, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৩৬