আপনার স্বাভাবিক ভাবে বাচ্চা আসার সম্ভাবনা খুব কম । আপনার দুটি ফেলপিয়ান টিউব ই বন্ধ পাওয়া গেছে ল্যাপারোস্কোপীতে ।
আমার স্ত্রী রুনাকে এই কথা বললেন ডাক্তার আপা । তাঁর সাথে আরও অনেক জুনিয়র ডাক্তার । সবাই ডান দিক থেকে রুনার বেডের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ।
প্রচুর সিম্পেথি দিয়ে ডাক্তার রা এই কথা বলার পর ও আমার স্ত্রীর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পানি পড়ে গেল । আমারও হয়ত পড়ত কিন্তু আমি আগেই ডাক্তারের কাছ থেকে শুনে ফেলেছি । আমাদের দুঃখেই কিনা এই জুনের এই সকালে ঝরঝর করে বৃষ্টি ঝরে যাচ্ছে । চারিদিক অন্ধকার বিষন্ন । লাইটের আলো গুলো সে অন্ধকার দূর করতে পারছেনা । নিঃসন্দেহে এটা একটা ভয়াবহ দুঃসংবাদ ।
এই ক বছরে একটা বাচ্চার জন্য চিকিৎসার পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে আমি প্রায় হাফ ডাক্তার হয়ে গেছি । বনাজী , কবিরাজি ,হেকিমি ,কলকাতা হারবাল ,প্যারিস হারবাল , পানি পড়া , তাবিজ কবজ , হোমিওপ্যাথি সব শেষ দিয়ে এলোপ্যাথিতে আসছি । বেশ কয়েকমাস ওষুধ খাওয়া হয়েছে । রুনা খেয়েছে , আমি ও খেয়েছি । শেষে ডাক্তার বললেন ল্যাপারোস্কোপি করাতে হবে । আবার মনের জোর জোগাড় করে আমরা ঢাকা এলাম ।
সে ল্যাপারোস্কোপী নামের এই অপারেশনের ধাক্কা কাটিয়ে উঠার জন্য ডাক্তার রা অপেক্ষা করছিলেন । আজকে তাকে তার বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে কাউন্সেলিং করা হবে আমি জানতাম । আমাকে এখানে থাকতে বলেছিলেন । আমাকে আগেই জানিয়ে দিয়েছেন এর রেজাল্ট , যেন আমি রুনা কে ভরসা দিতে পারি ।
তার দুটি ফেলোপিয়ান টিউবই ব্লক । কোন ওষুধ খেয়ে এই ব্লক ছুটানো সম্ভব না । ব্লক ছুটানোর অপারেশন করে ও লাভ হবেনা । টিউব ওপেন থাকাটা বাচ্চা হওয়ার জন্য খুব দরকার ।
রুনা আমার দিকে তাকাতে ভুলে গেল । তার এই দুঃখের সমব্যথী আমিও যে একজন সে ভুলেই গেছে । খুব সম্ভবত সে পুরো পৃথিবীতে খুব লোনলি ফিল করছে । সে বিছানায় বসে ছিল । আমি তার একটু পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম । এত ডাক্তার কে উপেক্ষা করে আমি তার কাঁধে হাত রাখলাম । যদি সে একটু ভরসা পায় । রুনা একটু কেঁপে উঠল আমার হাতের ছোঁয়ায় । আমরা পরষ্পর পরষ্পরের কাছ থেকে যেন প্রানশক্তি শুষে নিই সামান্য ছোঁয়ায় , ভাগাভাগি করি বেদনা ।
আমি কিছুতেই রুনা কে এই দুঃসংবাদ টা দিতে পারতাম না ।ডাক্তার কিভাবে এই ভয়াবহ দুঃসংবাদ টা দেন আমার তা দেখার ইচ্ছা ছিল । তারা দেখলাম দুঃসংবাদ দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি তারা আমাদের আশা ও দিলেন । বললেন , টিউব ব্লকের চিকিৎসা টেস্টটিউব পদ্ধতিতে বাচ্চা নেওয়া । আগে সিংগাপুর ভারত এ যে চিকিৎসা ছিল , তা আমাদের দেশে ও পাওয়া যাচ্ছে । সুতরাং সে অপশন এখনো খোলা আছে । খুব নিরাশার কিছু নাই । যদিও চিকিৎসা একটু ব্যয়বহুল ।
আরও কিছুক্ষণ ডাক্তার রা ছিলেন । টেস্টটিউব না নিতে পারলে দত্তক বা পালক বাচ্চার কথা বললেন । রুনা কোন কথা না বলে কেঁদেই গেল আর কেঁদেই গেল ।
আমাদের ব্যাগ গোছানোর সময় হয়ে গেছে । আমরা চট্টগ্রাম থেকে এসেছি । ঢাকায় চিকিৎসা করাতে । এখন বাড়ি যেতে হবে । মা ডেফিনেটলি এই কথা জানতে পারলে খুব মন খারাপ করবেন । আমরা যত না অস্থির হয়েছিলাম , মা নাতি নাতনির মুখ দেখার জন্য তার চেয়ে বেশি অস্থির । রুনা মায়ের সই এর মেয়ে । ছোট থাকতেই এক সই এর ছেলের সাথে আরেক সই এর মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন । পুতুল খেলার মত । সেটা বাল্য বিবাহ ছিল ।
কর্ণফুলীর ছোট ছোট ঢেউ বঙ্গোপসাগরের নোনা জলে মিশে যেতে যেতে অনেকগুলো বছর গড়িয়ে গেছে । আমার খেলার সাথী রুনা দেখতে দেখতে রমণী হয়ে উঠে ছে । লম্বা শ্যাম বর্ণ সুশ্রী । রুনার ২৫ হয়েছে । আমার ৩২ ।
আমিও দেখতে সুন্দর হ্যান্ডসাম ,এটার্কটিভ ,অবশ্য এটা আমার কথা, না রুনার কথা । অফিসে যাবার সময় প্রতিদিন আমার চুল আঁচড়ে দিত আর আমার কানের লতির নিচে তার কাজলের ফোটা দিয়ে দিত যেন কারো নজর না লাগে । হাহাহা ।
কিন্তু এত বছরের সংসার জীবনে নতুন কোন সুখবরের সাম্পান আমাদের বন্দরে ভিড়েনি । মা আশা ছেড়ে দিয়ে , রুনার প্রতি , সই এর মায়া ভুলে আমার জন্য পাত্রী দেখা শুরু করলেন । শেষে বদ্দা বললেন ( বড় ভাই ), ঢাকা যাও , শেষ চেষ্টা করে এস ।
এখানে এসে এক বাচ্চা বাচ্চা ধরনের ডাক্তার এর কাছে প্রথম আলাপ হল ।উনি আমাদের দুজনের হিস্ট্রি নিলেন । উনি আমদের কথা শুনে বুঝে ফেললেন আমরা চট্টগ্রামের , অবশ্য আমরা অবশ্যই শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেছি ।তবুও বুঝলেন ।
এই ডাক্তারের ভাব গাম্ভীর্য কম , আবার কমও না; কেমন জানি ।
স্কার্ফ পরে । হাসলে চেহারা পালটে যায় , এবং উনি হাসতে পছন্দ করেন । কেন জানি মনে হল উনি আজ একজন জুনিয়র ডাক্তার , কিন্তু বুড়ো প্রফেসর হয়ে গেলেও উনি হাসতে হাসতে কথা বলবেন । ওনার কথা শুনে রোগী অর্ধেক ভাল হয়ে যাবে । মর্নিং সোজ দা ডে ।
হিস্ট্রি নেয়া শেষে সিনিয়রের কাছে পাঠিয়ে দিলেন । কিন্তু এলোপ্যাথির ডাক্তার দের সমস্যা হল এরা কমিশন খাওয়ার জন্য নানা রকম পরীক্ষা করায় । আমরাও জিম্মি । কি আর করা পরীক্ষা করাতে বাধ্য । শুধু আমার স্ত্রীর পরীক্ষা নয় , আমার ও নানা রকম পরীক্ষা করালাম । বিভিন্ন ধরনের আমার টেস্ট , রুনার টেস্ট করাতে করাতে যে দুদিন সময় গেল , তার মধ্যেই রুনা এই ডাক্তার আপার সাথে পুরো বন্ধুত্ব করে ফেলল । আমি ডাক্তারকে বলতে শুনলাম ,
দেখেন চট্টগ্রামের মানুষগুলোকে আমার এত আপন মনে হয় ।
আমার ছেলে বেলা কর্ণফুলীর পাড়ে কেটেছে । আপনারা ঠিক যেখান থেকে এসেছেন । আব্বার পোস্টিং ছিল সেখানে ।
আমার বাবা মা ছোট বেলায় ঘুরতে যেতেন পতেঙ্গা বিচে ।এমন বেরসিক বাবা মা কি আর বলব । নিজেরা বিচের ব্লকগুলোর উপর বসে থাকতেন টোনা-টুনির মত ।
আর তাদের ৪ টি ছানাপোনার উপর আদেশ জারি করাছিল সমুদ্রের পানিতে নামা যাবে না , জোয়ারে ভেসে যাওয়ার ভয়ে মনে হয় ।
কিন্তু আমাদের মন পড়ে থাকত আছড়ে পড়া ঢেউ এ । কি এক অদৃশ্য দড়ি লাগানো ছিল , আমরা অবাধ্য হয়ে পানিতে নামতে পারিনি ।
বড় হয়ে কতবার সমুদ্রে গেছি কিন্তু ছোটবেলার সেই দুঃখ আমাদের কোন ভাইবোনের মন থেকে আর যায়না । হাহাহা ।
রুনা ও তার যত দুঃখ গাঁথা সব গড় গড় করে আপাকে বলে দিল । শাশুড়ির পাত্রী দেখার কথা সহ । খুব সম্ভবত এটাও বলে দিতে পারে যে আমি যে আমার মায়ের কথার তেমন একটা প্রতিবাদ করিনি । কোন এক বিচিত্র কারণে মেয়েদের পেটে কোন কথা থাকেনা । এই আপা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলেন । কিন্তু আজ এই কউন্সেলিং পর্বে ছিলেন না ।
আমাদের ট্রেনের টিকেট কাটা শেষ । আজ রাতে ট্রেন । অবশেষে আমি বিদায় নিতে গেলাম ডাক্তারদের রুমে । ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানানো দরকার । ইভনিং ডিউটিতে আপা ছিলেন । আমি আমার ভিজিটিং কার্ড দিলাম ।
যদি কখনো চট্টগ্রাম বা কক্সবাজার যান আমাকে একটু জানালেই হবে । আমার বন্ধুর হোটেল আছে , কোন সমস্যা হবেনা । আমি নিজে এসে রিসিভ করব । আর আমার গরীবালয়েও দাওয়াত রইল ।
কথা শেষ । আমি প্রায় উঠে চলে যাচ্ছিলাম , তখনই বললেন , মাহমুদ সাহেব ,একটু বসেন , দুটো কথা বলি । আসলে রুনার এত মন খারাপ আমি তার সামনে যেতে পারছিনা । আপনি কি জানেন সে কেন কাঁদছে ? এটা শুধু সন্তান হবেনা শুধু এই জন্য না । আরও কিছুর জন্য ।বলেন তো কি জন্য ?
>>আমার আম্মার বকার ভয়ে
> হুম আপনার আম্মা অলরেডি আপনার জন্য পাত্রী দেখে রেখেছে । রুনা তার ভালবাসার ঘর হারানোর বেদনায় ও কাঁদছে ।
সে আপনাকে অনেক পছন্দ করে আপনিও এটা জানেন । আজ তার টিউব বন্ধ এলো ।
আপনিও তাকে তাড়িয়ে দিয়ে মায়ের কথা মেনে নিয়ে আরেকটা বিয়ে করে ফেলবেন , কিন্তু আপনি কি জানেন আপনি তার এই টিউব ব্লকের জন্য রেসপন্সিবল ।
আমি দেখলাম বাচ্চা বাচ্চা টাইপের ডাক্তার হঠাৎ করে অনেক বড় হয়ে গেলেন । আমি অসহায় বোধ করতে লাগলাম ।
এটা ঠিক যে শেষ পর্যন্ত আম্মার কথা আমি মেনে নিতাম , যতই রুনাকে ভালবাসিনা কেন ।
কিন্তু আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠল কারণ আমি যেন জেনে গেছি এই ডাক্তার আমাকে কি বলবে । ডাক্তারদের কাছে কিছু গোপন থাকেনা । আজ কি আমার ধরা পড়ার দিন ? উনি কথা বলা শুরু করলেন ।
মনে হল মিছরির ছুরি এসে বুকে বিঁধে যাচ্ছে । বিশাল উত্তাল সমুদ্রের পাড়ের চোরা বালিতে আমি ক্রমশ ডুবে যাচ্ছি ।
>> আপনার আর আপনার স্ত্রীর সব ধরনের টেস্ট আমরা করেছি । আপনাদের দুজনের শরীরে এন্টি ক্ল্যামাইডিয়াল এনটিবডি অনেক বেশি পাওয়া গেছে ।
আর আপনি যেহেতু বন্দরে চাকরি করেন আপনি বাহিরের মেয়েদের সাথে মিশে যৌন বাহিত এই জীবাণু এনে রুনাকে দিয়েছেন ।
সেই জীবানু সাইলেন্ট লি রুনার টিউব ব্লক করেছে । বাচ্চা না হওয়াটা একটা সামাজিক সমস্যা । আপনার অন্যায় আর স্বেচ্ছাচারী জীবনের দায় নিতে হচ্ছে রুনাকে ।
আমি যেন বজ্রাহত হলাম । যেন আমার আমল নামা পেয়ে গেলাম বাম হাতে । কারণ আপা যা বলেছে তার সবই অক্ষরে অক্ষরে সত্যি । বন্ধুদের সাথে ওই সব মেয়েদের কাছে আমার যাওয়া হয়েছে আর যাওয়া হয় ও । গোপনে আমি আমার চিকিৎসা ও করিয়েছিলাম কয়েকবার । আজ হঠাত আমি কেমন যেন অসহায় বোধ করতে থাকি ।
কোন এক আশংকায় আমি কেঁপে উঠে বলি ,
>>আপনি কি রুনাকে এসব জানিয়ে দিবেন ?রুনা আমকে ফেরেশতার মত জানে ।
>> জানিনা, আমি কি করব ।
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুন, ২০১৩ রাত ১১:৪০