somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শৈশব কথন `````

০৪ ঠা মে, ২০১৪ সকাল ১০:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শৈশব। একটা শব্দ মাঝে মাঝে একটা বাক্যের চাইতে অনেক বেশি অর্থপূর্ণ।
এই একটা শব্দ থেকে কারো মধ্যে জন্ম নিতে পারে গভীর দুঃখবোধের আবার কারো ভেতরে বয়ে যেতে পারে গভীর আনন্দ। আমার শৈশবের শুরুটা এক গভীর দুঃখবোধ এর মাধ্যমে । আমার শৈশব আমাকে শিখিয়েছে পিতার নামের আগে সারাজীবন লিখে যেতে হবে " মৃত"। আমার শৈশব প্রথমেই আমাকে মনে করিয়ে দেয় ঠিক কিভাবে একজন সদ্য বিধবা নারী তার প্রয়াত স্বামীর রেখে যাওয়া দুটি নাবালক সন্তানকে অক্লান্ত পরিশ্রমে, ভালোবাসা দিয়ে তাদের জন্য একটি সুখী জীবনের নিশ্চয়তা দিতে চেয়েছেন। আমার মা আমার পরবর্তি শৈশবকে দুঃখ-কষ্টের ভেতর দিয়ে যেতে দেননি। আমার মায়ের যে ভাইটি, আমার মামা, আমাকে ভালবেসেছেন তার নিজের সন্তানের চাইতেও বেশি। আমার মামিকে আমি ছোট কালে "মা" ডাকতাম। আমার একটা আদুরে নাম ছিল। এখন এই নামে তারা আমাকে ডাকলে আমার লজ্জাবোধ হয়। শৈশবে আমি আমার মামার হাত ধরে রাস্তা পার হতাম। আমার মামা এখনো মনে করেন আমি রাস্তা পার হতে পারিনা।

১৯৯৮ এর বন্যায় আমরা যাত্রাবাড়ী থেকে সাইন্স-ল্যাবে চলে আসলাম। আমরা সেখানে উঠেছিলাম আমার মায়ের আরেক দুঃসম্পর্কের ভাইয়ের বাসায়। মামারা অনেক বড়লোক। তাদের নিজেদের চারতলা বাসা । তাদের বাসা এতো প্রকান্ড বড় ছিল যে সেখানে ক্রিকেট খেলা যাবে এমন। সেই সময় বন্যার কারণে আমাদের স্কুল বন্ধ। আমরা থাকতাম তৃতীয় তলার একটা রুমে, চতুর্থ তলায় আমাদের আসার কিছুদিন আগে এক লোক মারা গিয়েছে গলায় ফাঁস দিয়ে। সেই লোক নাকি ভুত হয়ে সেখানে রয়ে গেছে। আমরা দুই ভাই বোন প্রচণ্ড ভয়ে প্রথম প্রথম চার তলায় যেতাম না। পরে আমাদের কৌতূহল আমাদের ভয়কে ছাড়িয়ে সেখানে নিজের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। চতুর্থ তলায় আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের পত্তন হয়। সেই রাষ্ট্রের পত্তনই ছিল ভুতুড়ে। সেই রাষ্ট্রের দ্বিতীয় ভূত আমার বোন এবং তৃতীয় ভূতের নাম আমি নিজে “সাজ্জাদ”। যত স্বাধীনই আমরা হই না কেন আমাদের তবুও জানালার গ্রিলে চোখ গলিয়ে আকাশ দেখা। সেই সময়, আমি আর আমার বোন লুকোচুরি খেলতাম।

জানালার সীমাবদ্ধতা আমাদের গান লিখতে বলেছিল।

সেইসময়, আমি আর আমার বোন গান লিখছি সেই গানের আবার সুরও করেছি। আমার বোনের কন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত এখনো আমার অনেক সকালের শুরু হয়।

আমার লিখা প্রথম গানের কথাগুলো ছিল এমন_
" লুকাইয়া লুকাইয়া যাবে কোথায়?
আকাশের রঙ পাবে কোথায়?
পাখিরা সব উড়ে বেড়ায়..."

গত সন্ধ্যায় সেলিম স্যরের বাসায় না গেলে আমার এতো কথা মনে পড়তো না। হয়তোবা অনেক বছর পর হটাত কোন এক সন্ধ্যায় এই কথাগুলো ফিরে আসতো এবং তখনো আমি অবশ্যই ভাবতাম জীবন কত অসাধারণ উপাখ্যান অথবা হয়তো তখন আমি এমন ভাবনা চিন্তা এড়িয়ে যেতাম সুকৌশলে।

গতকাল সন্ধ্যায় স্যরের বাসায় না গেলে আমাদের স্যরের শৈশব কি অদ্ভুত দুরন্ত ছিল তা জানা হতোনা কোনদিন । স্যরের শৈশবের একটা কিংবা অনেকগুলো অজানা, নিতান্ত নিজস্ব গল্প আছে , সায়েদেরো আছে, তুহিনের আছে, সারা নামের মেয়েটা যাকে নিয়ে আমাদের তুহিন স্বপ্ন দেখে, খুঁজতে গেলে দেখা যাবে তারও একটা দুরন্ত শৈশব আছে।

শৈশবে সেলিম স্যর স্কুল ফাকি দিতেন, পুকুরে সাতার কাটতেন, মাছ ধরতেন, গাছে চরতেন। শৈশবে তুহিন ঘর পালিয়ে নেপালে চলে গেছে, সৌম্য-ভদ্র সায়েদ স্কুল ফাকি দিচ্ছে।

স্যর বললেন, তিনিও ঘর পালিয়ে উনিশ দিন বাইরে ছিলেন। পুরো সন্ধ্যায় আমি দৃশ্যপটগুলো কল্পনা করছিলাম। কি অসাধারণ! সবার কথা শুনতে শুনতে আমিও আমার শৈশবের কথা ভাবছি। বাসায় ফিরে এই লেখা লিখতে বসেছি। কেনো লিখছি আমি জানিনা। খারাপ কিংবা ভালো দিক ভেবে আর যাইহোক লেখালেখি হয়না। বানানের ভুল চিন্তা করলে, বাক্যর প্যাটার্ন নিয়ে বেশি মাথা ঘামালে আর যাই হোক সাহিত্য হয়না।

ভাবতে ভাবতে যখন লিখা শুরু করেছি তখন আমি দেখলাম ১৯৯৪ এ আমার বাবার মৃত্যুর প্রভাব কাটিয়ে, ১৯৯৮ এর বন্যায় ভাসতে ভাসতে আমার শৈশব কিভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউক্যালিপটাস গাছগুলোর কাছে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে । আমার এই একটা গর্বের জায়গা আছে। আমার শৈশব বাকি সব অংশ কেটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

তবু আমি যখন নীলক্ষেতে আমাদের বাসা থেকে এলাকার মাঠে ক্রিকেট খেলতে যাওয়ার জন্য মায়ের কাছে বকা খাচ্ছি বাউণ্ডুলে তুহিন তখন হয়তো ঘর পালিয়ে নেপাল চলে গেছে।

আমি ভাবছি। শৈশব, কৈশোর, যৌবন এভাবে সব কিছু মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। তবু আমরা জীবনকে বুঝি না। আমাদের প্রেমিকারা আমাদের ভালোবাসেনা। সম্ভবত সবার নয়। সম্ভবত আমার নিজের প্রেমিকা।

স্যর তার শৈশবের গল্প গুলো একটার পর একটা আমাদের কাছে বলতে শুরু করলেন। কোন এক বৃষ্টির দিনে স্যর বরশী দিয়ে মাছ ধরছেন, হটাত স্যর দেখলেন সেই মাছে আবার একটা একটা করে কোথায় জানি গায়েব হয়ে যাচ্ছে। স্যরের ভয়ের চোখে এর ব্যাখ্যা খুঁজতে খুঁজতে দেখলেন আসলে এক বিশাল শাপ মাছ গুলোকে এক এক করে সব খেয়ে ফেলছে।

স্যর বললেন, যতো দিন যাচ্ছে আমাদের শৈশব ততো বেশি বাক্স বন্ধী হয়ে যাচ্ছে।

শুধুই কি আমাদের শৈশব! আমাদের যৌবন, আমাদের প্রেম, আমাদের ভালোবাসা সবকিছুই এক অত্যাধুনিক বোকা বাক্সে বন্ধী হয়ে যাচ্ছে।

তবু স্যারের মেয়ে ঈশিত্ব তার দুরন্ত শৈশব পার করছে। সে তার বাবার হাত কোলবালিশ বানিয়ে ঘুমায়। এই যান্ত্রিক সভ্যতায় ঈশিত্ব তার বাবার দেখাদেখি তাকে নকল করে হলেও বই পড়ে। ঈশিত্ব কি জানে সে কেনো এত সৌভাগ্যবান? কারণ তার বাবার নাম "সেলিম হোসেন" আমার স্যার , আমাদের স্যার

আমি ভাবছি। আমার ভাবনা চিন্তা গুলো ওলট-পালট হয়ে বিক্ষিপ্ত উড়ে যাচ্ছে। আমার শৈশবের সাথে আমাদের সবার শৈশব মিলে মিশে এক অদ্ভুত রহস্যের সৃষ্টি করেছিলো গতকাল। সেই রহস্যের নাম জানেন আপনারা? এই রহস্যের নাম “জীবন”। একটা শব্দ! মাঝে মাঝে একটা বাক্যের চাইতে অনেক বেশি অর্থপূর্ণ। অনেক বেশি ব্যাপক।
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×