somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বৃদ্ধ মা (The Aged Mother)

১৩ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৩:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



গল্পটি বিখ্যাত জাপানিস কবি মাতসুই বাসও (১৬৪৪-১৬৯৪) এর ছোট গল্প ”The Aged Mother” এর বঙ্গানুবাদ এর ছোট্ট প্রয়াস।


অনেক দিন আগে,এক পর্বতের পাদদেশে এক গরিব কৃষক ও তার বৃদ্ধা মা বাস করতো। তাদের এক টুকরো জমি ছিল যা তাদের খাবার যোগাত, আর তারা ছিলেন বিনয়ী, শান্ত এবং সুখী।

তারা যেখানে বাস করতো, তার নাম ছিল শাইনিং। প্রদেশটি একজন স্বেচ্ছাচারী নেতার দ্বারা শাসিত হতো, যে যোদ্ধা ছিলেন এবং দুর্বল স্বাস্থ্য ও শক্তির মানুষদের সহ্য করতে পারতো না। এই কারণে সে একটি নিষ্ঠুর ঘোষণা জারি করলো। সমগ্র প্রদেশকে অবিলম্বে সমস্ত বয়স্কদের মেরে ফেলার কঠোর আদেশ দেওয়া হলো। সেই দিনগুলো ছিল বর্বরতার, আর বৃদ্ধদের মরার জন্য দূরে কোথাও ফেলে আসার প্রথাও অস্বাভাবিক ছিল না। গরিব কৃষক তার বৃদ্ধা মাকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে ভালোবাসতেন, আর সেই আদেশ তার হৃদয়কে দুঃখে ভারাক্রান্ত করে তুলল। কিন্তু গভর্নরের (স্বেচ্ছাচারী নেতা) আদেশ অমান্য করার কথা কেউ দ্বিতীয়বার এর মতো ভাবত না। তাই গভীর ও হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে যুবকটি সেই সময়ের সবচেয়ে দয়ালু বলে বিবেচিত মৃত্যুর পদ্ধতির জন্য প্রস্তুত হলো।

সূর্য ডোবার মুহূর্তে, যখন তার দিনের কাজ শেষ হলো, সে কিছু বাদামি রঙের চাল নিলো যা ছিল দরিদ্রদের প্রধান খাদ্য এবং সেটিকে রান্না করে ও শুকিয়ে একটি কাপড়ে বাঁধল, যা সে ঠাণ্ডা, মিষ্টি জল ভরা একটি লাউ এর খোলসের সাথে তার গলায় ঝুলিয়ে নিল। তারপর সে তার অসহায় বৃদ্ধা মাকে পিঠে তুলে নিয়ে পাহাড়ের উপর দিয়ে তার কষ্টের যাত্রা শুরু করল। রাস্তাটি ছিল দীর্ঘ ও খাড়া; সংকীর্ণ রাস্তাটি ছিল শিকারী ও কাঠুরেদের দাড়া তৈরি আর অনেক পথ বিভিন্ন দিকে যাচ্ছিল। কিছু জায়গায় তারা পথ হারিয়ে ফেলেছিল, কিন্তু সে তাতে ভ্রূক্ষেপ করেনি। একটি পথ বা অন্যটি, তাতে কিছু যায় আসেনা, সে শুধু চলতে লাগল, অন্ধের মতো উপরের দিকে চড়তে লাগল। 'বৃদ্ধদের পরিত্যাগের' পর্বত হিসাবে পরিচিত ওবাতসুয়ামার উঁচু, অনাবৃত চূড়ার দিকে ছুটতে লাগলো।

বৃদ্ধা মায়ের চোখ এতটাও ঝাপসা ছিল না যে, তিনি এক পথ থেকে অন্য পথে যুবকের বেপরোয়া ছোটাছুটি লক্ষ্য করতে পারেননি, আর তার স্নেহময় হৃদয় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। তার ছেলে পাহাড়ের বহু পথ চিনত না এবং তার ফিরে আসা বিপদজনক হতে পারত, তাই তিনি হাত বাড়িয়ে ঝোপ থেকে ডালপালা ভেঙে নিলেন এবং তারা যখন পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি প্রতি কয়েক পদক্ষেপে নীরবে এক মুঠো ডালপালা ফেলে যেতে লাগলেন। যাতে তারা উপরে ওঠার সময়, তাদের পিছনের সংকীর্ণ পথটি ঘন ঘন ব্যবধানে ছোট ছোট ডালপালার স্তূপ দিয়ে চিহ্নিত হয়ে যায়। অবশেষে চূড়ায় পৌঁছানো গেল। ক্লান্ত এবং মর্মাহত যুবকটি আলতো করে তার মাকে নামাল এবং মায়ের প্রতি তার শেষ কর্তব্য হিসাবে একটি আরামদায়ক স্থান তৈরি করল। ঝরে পড়া পাইন পাতা জড়ো করে সে একটি নরম কুশন তৈরি করল এবং আলতো করে তার বৃদ্ধা মাকে তার উপর বসিয়ে দিল। সে তার মোটা কোটটি, ঝুঁকে থাকা মায়ের কাঁধের চারপাশে আরও শক্ত করে জড়িয়ে দিল এবং অশ্রুসিক্ত চোখ ও ব্যথিত হৃদয়ে বিদায় জানাল।

কাঁপতে থাকা মায়ের কণ্ঠস্বর নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় পূর্ণ ছিল, যখন তিনি তার শেষ উপদেশ দিলেন। "তোমার চোখ যেন বন্ধ না হয়, আমার ছেলে।" তিনি বললেন। "পাহাড়ের রাস্তা বিপদে ভরা। সাবধানে দেখো এবং যে পথে ডালপালার স্তূপ রয়েছে তা অনুসরণ করো। সেগুলো তোমাকে নিচের পরিচিত পথে পথ দেখাতে সাহায্য করবে।" ছেলের বিস্মিত চোখ পথের দিকে ফিরে তাকাল, তারপর ভালোবাসা দ্বারা আঁচড়ানো ও নোংরা হওয়া সেই অসহায়, বৃদ্ধ মায়ের কুঁচকানো হাতগুলির দিকে তাকাল। তার হৃদয় ভেঙে গেল এবং সে মাটিতে মাথা নত করে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠল: "ওহ, আমার করুণাময় মা, আপনার দয়া আমার হৃদয়কে বিদীর্ণ করে! আমি আপনাকে ছেড়ে যাব না। একসাথে আমরা ডালপালার পথ অনুসরণ করব, এবং একসাথে আমরা মরব!"

সে আবারও তার বোঝা কাঁধে নিল (এখন সেটা কত হালকা মনে হচ্ছিল) এবং উপত্যকার ছোট কুঁড়েঘরের দিকে ছায়া এবং চাঁদের আলোর মধ্য দিয়ে দ্রুত নেমে গেল। রান্নাঘরের মেঝের নীচে খাবারের জন্য একটি দেয়াল ঘেরা ছোট ঘর ছিল, যা কিছুটা ঢাকা এবং আড়াল করা ছিল। সেখানে সে তার মাকে লুকিয়ে রাখল, তাকে প্রয়োজনীয় সবকিছু সরবরাহ করত। ক্রমাগত দেখত এবং কিছুটা ভয় পেত যে, সে ধরা পড়ে যায় কিনা। সময় কেটে গেল এবং সে নিরাপদ বোধ করতে শুরু করেছিল আর তখনি আবারও অন্যায় শাসক তার ক্ষমতা জাহির করার জন্য, একটি অযৌক্তিক আদেশ নিয়ে দূত পাঠালেন প্রদেশের সবাইকে। তার দাবি ছিল যে তার প্রজারা যেন তাকে ছাই দিয়ে তৈরি একটি দড়ি উপহার দেয়।

প্রদেশটি সবাই ভয়ে কেঁপে উঠল। আদেশ মানতেই হবে, কিন্তু কে ছাই দিয়ে দড়ি তৈরি করতে পারে? সেদিন রাতে, গভীর উদ্বেগে, ছেলেটি তার লুকানো মাকে ফিসফিস করে খবরটি বলল। "অপেক্ষা করো!" তিনি বললেন। " আমাকে ভাবার সময় দাও" মা আবারও বলল। দ্বিতীয় দিনে তিনি তাকে কী করতে হবে তা বললেন। "পেঁচানো খড় দিয়ে দড়ি তৈরি করো," তিনি বললেন। "তারপর সেটিকে সমতল পাথরের সারির উপর লম্বা করে শুইয়ে দাও এবং বাতাসহীন রাতে সেটি পোড়াও।" সে লোকজনকে জড়ো করল এবং মা যেমন বলেছিলেন ঠিক তেমনই করল এবং আগুন যখন নিভে গেল, তখন পাথরের উপর, প্রতিটি প্যাঁচ এবং তন্তু পুরোপুরি দেখা যাচ্ছিল এবং অবশেষে ছাই দিয়ে তৈরি একটি দড়ি পড়ে রইল।

গভর্নর (স্বেচ্ছাচারী শাসক) যুবকটির বুদ্ধিতে খুশি হলেন এবং অনেক প্রশংসা করলেন। কিন্তু তিনি জানতে চাইলেন যে সে এই জ্ঞান কোথায় পেল। "হায়! হায়!" কৃষক কেঁদে উঠল, "সত্য বলতেই হবে!" এবং গভীর ভাবে মাথা নত করে সে তার গল্পটি বলল। গভর্নর শুনলেন এবং তারপর নীরবে কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। অবশেষে তিনি মাথা তুললেন। "এই প্রদেশে (শাইনিং) যুবকের শক্তির চেয়েও বেশি কিছু প্রয়োজন," তিনি গুরুত্ব সহকারে বললেন। "আহ্, আমি কেন সেই সুপরিচিত উক্তিটি ভুলে গিয়েছিলাম, 'অভিজ্ঞতা নিয়ে আসে জ্ঞান!'" সেই মুহূর্তেই নিষ্ঠুর আইনটি বিলুপ্ত করা হলো এবং প্রথাটি এত সুদূর অতীতে চলে গেল যে কেবল কিংবদন্তিদের মুখেই শুধু অবশিষ্ট রইল।

সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৩:৪০
৮টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

১৫ই আগস্টের ধারাবাহিকতা ৭ই নভেম্বর ১৯৭৫

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:০১


খালেদ মোশাররফের মৃত্যু, চার নেতার হত্যা ও সেনাবাহিনীর বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত করে খালেদ মোশাররফ সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নেন। উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের সরিয়ে সেনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের শাহেদ জামাল- ৮৫

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৫৮



আজ শনিবার, ২৩শে কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, হেমন্ত-কাল।
শাহেদ জামাল রমনা পার্কে বসে আছে। তার হাতে দৈনিক পত্রিকা। সে অনেকদিন পর রমনা পার্কে এসেছে। আজকের সকালটা অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৩১

আজিজিয়ায় আমাদের হোটেলে আমি ও আমার ছেলে ছাড়াও অপর যে তিনজন হাজ্জ্বী মিলে আমরা পাঁচ শয্যার কক্ষটি ভাগাভাগি করে নিয়েছিলাম, তাদের সম্বন্ধে কিছু কথা আগের পর্বেও বলেছিলাম। তার অতিরিক্ত ওদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ওরা এখনও ৭১-এর চেতনা ফেরি করে পার পেতে চায়

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৩

ওরা এখনও ৭১-এর চেতনা ফেরি করে পার পেতে চায়

ষোলো বছর ধরে যারা অবৈধভাবে ক্ষমতায় ছিল, তারা দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজের প্রতিটি স্তরকে কলুষিত করেছে। গুম-খুনের রাজনীতি, দমন-পীড়নের শাসন, এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদন: বাংলাদেশের জেন-জি বিপ্লব কি ব্যর্থ হচ্ছে ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৪৫


( লেখাটি ফাইনান্সিয়াল টাইমসের "Is Bangladesh’s Gen Z revolution falling apart?" শীর্ষক নিবন্ধ থেকে অনুপ্রাণিত)

এক বছর আগের গল্প মনে আছে? যখন বাংলাদেশে একটি যুগান্তকারী বিপ্লব হয়েছিল। শেখ হাসিনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×