আমার ছোট বোনের মৃত্যুর পর মা শারীরিক ও মানসিকভাবে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।তবে বেশীদিন যন্ত্রনা সহ্য করতে হয়নি, কিছুদিন পর হুট করে তিনিও মারা যান।
বাড়ীতে আমি আর বাবা থাকি, আর কাজের একজন লোক আছে যে একাই গৃহস্থলীর সব কাজ করে থাকে।বাবা ব্যস্ত ব্যবসা নিয়ে, খুব কমই তাঁর সাথে কথা হয়।আমরা দু’জনই চাপা স্বভাবের, এ কারণে অতোটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি।খাবার টেবিলে টুকটাক যা কথা-বার্তা হয়ে থাকে।আমার ব্যাপারে বাবাকে কখনো চিন্তা করতে দেখিনি। প্রতি মাসের শুরুতে আমাকে হাতখরচ দেয়া হয় যা দিয়ে আমার দিব্যি চলে যায়।
আমার জন্ম হয় দূর্বল হৃৎপিন্ড নিয়ে, প্রায়ই বুকে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করি।ডাক্তার পরীক্ষা করে বলেছিলেন খুব দ্রুতই অপারেশন করাতে হবে।আমি তা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাইনি, বাবাকে জানানোর প্রয়োজন ও বোধ করিনি।
আমি আমার মতো করে থাকি।ভার্সিটি তে যাই, এক কোণায় বসে ক্লাস করি।কারো সাথে মিশতে পারিনা বলে আমার কোন বন্ধু হয়নি, ক্লাসমেটরাও আমার সাথে কথা বলার আগ্রহ দেখায় না। বাসায় এসে চুপচাপ বসে থাকি।বই পড়ে, টিভি দেখে সময় কাঁটাই। রাত একটু গভীর হলে আমি হাঁটতে বের হই।নানা চিন্তা করতে করতে হাঁটতে থাকি- এ সময়টা আমার খুব প্রিয়।
আজ আকাশটা মেঘলা, বৃষ্টি পড়ার সম্ভাবনা আছে।নির্জন একটা জায়গা বেছে নিয়ে আমি হাঁটা শুরু করি। একটু এগুতেই দেখি রাস্তার এক পাশে একটা কুকুর নেতিয়ে মরে পড়ে আছে, বিশ্রী দূর্গন্ধ এলাকা জুড়ে।
সেদিন দুপুরেও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল, কিছুক্ষন আগে বৃষ্টি থেমেছে।ঘুমানোর জন্য আদর্শ আবহাওয়া।খাওয়া-দাওয়ার পর আয়েশে বিছানায় এলিয়ে পড়ি।বিকট চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গে আমার, হুড়মুড় করে বিছানা থেকে উঠি-ধাতস্থ হতে সময় লাগে।বাইরে এসে দেখি মা চিৎকার করে কাঁদছেন, পুরা উঠোন রক্তাক্ত।এক কোণে আমার বোনের ছোট্ট দেহটি থেঁতলে পড়ে আছে।মার চোখ ফাঁকি দিয়ে বোন ছাদে ওঠে।বৃষ্টির কারণে শ্যাওলা জমা ছাদ পিচ্ছিল হয়ে ছিল।এর মধ্যে হাঁটতে গিয়েই এ বিপত্তি।
আমার মধ্যে কোন অনুভূতি কাজ করছিলোনা, আমি বোধশক্তিহীন হয়ে বোনের নিথর দেহটিকে কোলে তুলে নিয়ে আমার ঘরের খাটে এনে রাখি।কিছুক্ষন বাদে বাবা আসলেন, তিনি একদিকে বসে বোনের মৃতদেহের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলেন।বাবাকে কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি, কিন্তু আমি জানি আমার মত তাঁর চোখ দিয়েও এক ফোঁটা পানি গড়ায়নি সেদিন।
টিপ টিপ করে বৃষ্টি পরা শুরু হলো।
ছোট বোনের মৃত্যুর ধকল মা সহ্য করতে পারেননি, তাঁর ব্রেইন স্ট্রোক হয়।হাঁটাচলার শক্তি হারিয়ে তিনি পুরোপুরি শয্যাশায়ী হয়ে গিয়েছিলেন।তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁকে খাওয়ানো, পরিষ্কার করানো- এ কাজগুলো আমাকেই করতে হতো, কি বীভৎসই না ছিল সে দিনগুলো।মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কি প্রবল বিতৃষ্ণা নিয়েই না তিনি বেঁচে ছিলেন ! তাঁর মৃত্যুর পর আমি আর বাবা কিছুটা হলেও কি স্বস্তি বোধ করিনি ?
আমার বুকের ব্যথাটা বাড়তে থাকে, নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে।আমি পথের ধারে মরে পড়ে থাকা কুকুরটার মতো নেতিয়ে পড়ি।
আমার জগৎ ধূসর অন্ধকারে ছেঁয়ে যাচ্ছে।
বৃষ্টির বেগ ক্রমশ বাড়ছে॥
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৪ বিকাল ৫:১৬