আলোকিত মানুষ চাই-অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
আমার একটা বুক ক্লাব খোলার স্বপ্ন।গুডরিডসের মতো।বই পড়ব,বই দেব,রিভিউ লিখব,তর্ক করব- দর্শন বিশ্বাসের হোক অথবা অবিশ্বাসের,প্রত্যেকটা মানুষ যেন জীবনে একবার হলেও অন্তত শুদ্ধ আর অশুদ্ধের পার্থক্য নিয়ে মাথা ঘামায়। সারাজীবন ধর্মগ্রন্থ বাদে আর কিছু ছুয়ে না দেখা বুড়ো মানুষটার যদি জীবনে একবারও ইচ্ছে হয় সে সোফিস ওয়ার্ল্ড পড়বে সে যেন পড়তে পারে।কিংবা যে মানুষটা হাতে চাপাতি নিয়ে বের হয়েছিল সাত নম্বর নাস্তিকটাকে হত্যা করতে সে যেন সুস্থ মস্তিষ্কে অন্তত একবার পড়ে দেখে নাস্তিকটা আসলে লিখল কি!শুরুটা সবসময় শুরু থেকে করতে হয়।তাই আমি চাই আমাদের নিয়েই ছোট্ট একটা বুক ক্লাব খুলি আমরা।আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করারা কোন কারণ নাই কারণ আলোকিত মানুষ যে খোঁজার চেষ্টা করা যেতেই পারে সেটা তো আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারই দেখিয়ে দিয়ে গেছেন।আমাদের দেশে একজন পলান সরকার থেকে হাজারজন পলান সরকার হবে।কে বলে আমাদের অনুপ্রেরণা নাই?
যখন স্কুলে পড়ি আমাদের একটা গ্রুপ ছিল- আমি এবং আমার বন্ধুরা-তরী,মিম্মি আর আরও কয়েকজন। বই দিলে কেউ বই ফেরত দেয় না কখনো (আমি নিজেও দেই না ) তাই বুদ্ধি বের হল তাহলে বই এক্সচেঞ্জ করি!যখনই আমি তরীকে দুইটা ড্যান ব্রাউন দেই ও আমাকে দুইটা ডার্ক পিট দেয়। তারপর একদিন হয়তো দেখা যায় স্কুল থেকে ফেরার পথে জেলরোডের রাস্তায় দুইটা মেয়ের কাঁধে ব্যাগ নিয়ে তুমুল ঝগড়া-বিষয় প্রায়োরি অব সাইওন আদৌ আছে কিনা!অথবা মাহবুব স্যারের বাসার পাশের ইটের দেয়ালে পা ঝুলিয়ে সদ্য বের করা কোন জ্ঞান জাহির করা। আমাদের ছোটবেলায় কেউ ভেন্ট্রিলোকুইস্ট কি না জানলে ভীষণ হাসাহাসি হত তাকে নিয়ে। এখনো হয় কি?
রাজউক কলেজের হাঁপ ধরানো পরিবেশেও কিছু বই পোকা পাওয়া যায় এখনো। রাজউকের একটা এসি লাইবেরি আছে কিন্তু সেখানে চাইলেই হারপার লি কিংবা অ্যালান পো খুঁজে পাওয়া যায়না।পাওয়া গেলেও হয়তোবা দুর্বোধ্য বাংলা অনুবাদ যেটা একবার পড়লে কেউ আর দ্বিতীয়বার কাফকাসমগ্র হাতে নিয়ে দেখবে না। তবু এখানে এসেও দু তিনজন বইপোকার সাথে সাথে বই আদান প্রদান চলল। নিয়ম সেই একই-তুই একটা দিবি তো আমি একটা দিব।মনে আছে প্রথমবার শী আর রিটার্ন অব শী পড়ার পর পুরো ফিজিক্স ক্লাস আমরা তর্ক করে কাটিয়ে দিলাম যে আমাদের কি আদৌ হেনরি রাইডার পড়া উচিত কিনা!এবং আপনি জেনে অবাক হবেন হয়তো এইভাবেই গত দুই বছরে আমরা মারিও পুজো,হেনরি রাইডার,জন গ্রিন,পাওলো কোয়েলহো থেকে শুরু করে বিখ্যাত এবং কুখ্যাত বই পড়ে শেষ করে ফেলেছি!কিন্তু আমাদের এই "আমরা"র সংখ্যাটাও হাতে গোণা।
পুঁজিবাদের সবচেয়ে বড় কুফল ছিল বৈষম্য। ধনীরা বানালো সম্পদের পাহাড় আর গরীবেরা তলাতে থাকল দারিদ্রের চাপে। লেখাটা এইজন্য লিখলাম কারন আমাদের স্বপ্নটা এখনই যদি সত্যি করা না যায় তাহলে পৃথিবীতে থার্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার হোক না হোক একটা মানসিক পুঁজিবাদ শুরু হয়ে যাবে।আমার বয়সী যেই ছেলেটা রিকশা চালায় সে ইয়স্তেন গার্ডার ছুয়ে দেখেনাই।সে হয়ত আরেকটা চার্লস ডিকেন্স হতে পারত কিন্তু তাকে কখনো বলাই হয় নাই রিকশা চালিয়েও বই লেখা যায়।একটা রিকশাওয়ালার মগজ যে একজন আইবিএ পড়া মেয়ের চেয়ে উন্নত হবেনা এটা আপনাকে কে বললো! আমাদের মত গুটিকয়েক মানুষ থাকবে যারা হয়তো পিডিএফএর জোরে আরও বই পড়তেই থাকবে,কেউ কেউ হয়তো আর পাবলিক লাইব্রেরি খুজে না পেয়ে আর অন্যদিকে পিডিএফ অ্যাক্সেস না থাকায় আরও বইবিমুখী হয়ে যাবে।আচ্ছা আমাকে কেউ বলবেন কি আপনি কি করে আশা করেন যে মানুষটা কোনদিন কুরআন শরীফ ছাড়া কোন ছুয়ে দেখননি তিনি আপনার অবিশ্বাসের দর্শন পড়েই বুঝে ফেলবেন কিংবা মেনে নেবেন?নাস্তিক ভাই,আগে আপনি তাকে ধর্মের বিবর্তন শেখান!ধর্মকে প্রশ্ন করায় মহাপাপ হয়ে যায় না সেটাই শেখান!আইএস ব্রেন ওয়াশ করতে পারলে আপনি কেন পারবেন না?পড়তে শেখান মানুষকে।নইলে আরও ৮০ জন মানুষের রক্ত দেখব আমরা-আর যারা মারবেন তারা জানবেও না ওই লোকটা আদৌ কি লিখত!
তো এখন এই স্বপ্নটাকে পূরণ করতে কি চাই জানেন?দুইটা বই!হ্যা মাত্র দুইটা বই আরও হাজারটা বইয়ের দরজা খুলে দেবে। যেমন ওই রিকশাচালক ছেলেটা যদি আমাকে তার শরত রচনা সমগ্রটা দিয়ে দেয় তাহলে আমিও তাকে আমার জুলভার্ন সমগ্র দিয়ে দেব।ও জুলভার্ন পড়ুক,আমি নাহয় শরত পড়ি।তারপর কোন একদিন রেলগেটের সিগন্যালে বসে থাকতে থাকতে যখন আমি বিরক্ত হয়ে যাব তখন নাহয় দুইজনে মিলে হাসাহাসি করব,কামানে করে চাঁদে মানুষ পাঠানোর আইডিয়াটা কি হাস্যকরই না ছিল!সেই বুড়ো লোকটা আমাকে কুরআন শরীফ পড়তে দিলে আমিও নাহয় তাকে সোফিস ওয়ার্ল্ড পড়তে দিব।এই পদ্ধতিটা খুব হাস্যকর শোনাতে পারে কিন্তু এটাই লাইব্রেরির জন্মসূত্র!এটার গল্প আমি আরেকদিন শোনাবো নাহয়।
কিছু মানুষ দরকার আমার।বন্ধুরা অনেকেই অনেকরকম সংগঠন করে,অ্যাডমিশনের পর আমাকে যদি কেউ ডাকিস একসাথে নাহয় তোদের সংগঠনের একটা বুক ক্লাব খুলব?কিচ্ছু লাগবে না,শুধু কয়েক্টা মানুষ লাগবে আর প্রত্যেকের দুইটা করে বই। ব্রেইন ওয়াশ নেগেটিভ দিকে হতে পারলে কেন পজিটিভ ব্রেন ওয়াশ সম্ভব না?বাংলাদেশে অনেক অন্ধ মানুষ থাকবে কিন্তু আমি নিশ্চিত আমার সেই বন্ধুগুলর মধ্যে একটাও অন্ধ মানুষ থাকবে না।আমার বন্ধুগুলো হয়তো তখনো আমাকে মালাউন বলে গালি দেবে কিন্তু কখনোই চাপাতি নিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে যাবে না। ভন্ডামি আর ধর্মের পার্থক্যটা বুঝতে শিখবে,ভিন্নমত মানেই খারাপ নয় জানবে,এককালে গলার জোরে পৃথিবীর ঘোরাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কিন্তু সেই অট্টহাসির মাঝেও যে ক্ষীণ আওয়াজটা ছিল আমরা এখন সেটাকেই বিশ্বাস করি-সেটাই ঠিক।পথশিশুদের নিয়ে লাইব্রেরী হবে এবার একটা।একটা বাচ্চা বর্ণপরিচয় মোটামুটি জানলেই তাকে আস্তে আস্তে বই দুনিয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া যায় খুব সহজে।আর একবার নেশা ঢুকিয়ে দিতে পারলেই হল। বইয়ের নেশা বড় নেশা।দশজন দশটা করে বই পড়লেও তো লাভ।উগ্রতার চর্চা ছড়াতে পারলে মুক্তবুদ্ধির চর্চা কেন ছড়াবে না?
আমার তো সাধ হয় কোন এক বিকেলে হয়তো আমি আর কেউ রিকশা করে বাদাম খেতে খেতে ঘুরব আর থার্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার হলে সেটা সাইবার ওয়্যার হবে কিনা সেটা মিয়ে তর্ক করব তখন পাশ থেকে ওই বাদাম বিক্রেতা ছেলেটাই আমাকে বলবে,আপু থার্ড ওয়ার্ল্ডওয়ার আমরা হতে দেব না,মনে নাই যুদ্ধ নয় শান্তি?!
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:৫৭