সোশ্যাল মিডিয়ায় মেয়েরা খালি নিজেদের নাম এঞ্জেল জরিনা-সখিনা-কারিনা রাখে এমনটা না। এর বাইরেও কিছু নাম আছে- বেশ কমন। এমন একটা হইলো গিয়া 'নেফারতিতি'। ভাবলাম এই নেফারতিতিরে নিয়া একটু পড়াশুনা কইরা ফেলি। আর পইড়া যা ইম্পরট্যান্ট মনে হইলো তা ভাবলাম লেইখা ফালাই। এতে লাভ দুইটা।
- যাদের কাছে সার্চাসার্চি (পড়ুন খোঁজাখুঁজি) করার মতো প্রচুর সময় নাই তারা একসাথে বেশ কিছু ইনফরমেশন পাইলেন।
- আর আমার যখন ইনফোগুলান দরকার হবে তখন আমি নিজেই নিজের একটা লেখা পাইয়া যাবো।
তো চলেন শুরু কইরা দিই-
এক্কেবারে সহজ করে বললে, নেফারতিতি ছিলো মিশরের রাণী।
এখন কথা হচ্ছে, মিশরের রাণী তো আর একজন ছিলেন না- এত্ত এত্ত রাণীর মধ্যে নেফারতিতি ক্যান বিখ্যাত ছিলেন? বিখ্যাত হওয়ার কারণ অনেকগুলা। তবে প্রধান কারণটা হচ্ছে নেফারতিতির দৈহিক সৌন্দর্য। আর মিশরীয় ভাষায় 'নেফারতিতি' শব্দের অর্থই হচ্ছে 'সুন্দরীর আগমন'।
তো আমাদের এই নেফারতিতি মোটামুটি খ্রিষ্টপূর্ব ১৩০০ অব্দের মাঝামাঝি সময়ে তার স্বামী আখেনাতেন এর সাথে মিশর শাসন করতেন; যেই সময়টারে মোটামুটি মিশরের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ হিসেবে ধরা যায়। আখেনাতেন ক্যাডা সেইটা নিয়ে আরেকদিন লেখবো। তবে এতটুকু তথ্য দেয়া যায় যে, সে ছিলো রাজা তুতেনখামুন এর পিতা। আর আখেনাতেন এর পূর্ব নাম হচ্ছে আমেনহতেপ ৪। রাজা হওয়ার পর সে আখেনাতেন নাম ধারণ করে।
গুগলে 'নেফারতিতি' লিখে সার্চ দিলে আমরা আবক্ষ একটা মূর্তি দেখতে পাই যেটা পাওয়া গেসে ১৯১২ সালে। মিশরের বিখ্যাত প্রতীকগুলোর মধ্যে এই মূর্তি অন্যতম।
একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে, আজকালকার আপুরা সৌন্দর্যবর্ধক (পড়ুন মেকআপ) কিনে নিয়ে আসেন দোকান থেকে। কিন্তু নেফারতিতি একজন রাণী হয়েও নিজের মেকআপ নিজেই বানাইতেন।
তো নেফারতিতির জন্ম নিয়া বেশ কিছু তত্ব বিখ্যাত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটা বলি-
১. এক্ষেত্রে ধারণা করা হয়, নেফারতিতির জন্ম আখমিমে। প্রাচীন গ্রীকরা জায়গাটারে খামুস, কেমিস কিংবা পানাপোলিস বলতো। জায়গাটা অবস্থিত নাইলের পূর্ব তীরে।
২. এই তত্ত্বানুসারে, নেফারতিতি ছিলো উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীর মেয়ে। নেফারতিতির বাবার নাম ছিলো 'Ay'। অনেকে মনে করেন 'Ay' পরবর্তীকালে মিশরের রাজাও হয়েছিলো। নেফারতিতির মা যেহেতু ছোটবেলায় মারা গিয়েছিলো তাই 'Ay' এর স্ত্রী-ই নেফারতিতির দেখাশোনা করতেন।
৩. এই তত্ত্বে নেফারতিতিকে অন্য কোন দেশের মনে করা হয়। ধারণা করা হয়, সিরিয়া বা এই রকম কোনো দেশ থেকেই নেফারতিতি মিশরে এসেছেন।
যেহেতু অনেক অনেক তত্ত্ব নেফারতিতির জন্ম নিয়েই প্রচলিত আছে কাজেই একেবারে সঠিক তথ্য খুঁজে বের করা বেশ কঠিন।
অনেক অনেক জ্ঞানগর্ভ অালোচনা করে ফেললাম। এবার একটা মজার তথ্য দেই। নেফারতিতির আবক্ষ মূর্তিটা হিটলারের কাছে সযতনে রাখা ছিলো। হিটলার মূর্তিটারে এতই পছন্দ করতো যে সে বলতো 'এই মূর্তি আমি কখনো ছেড়ে দিবো না'।
হিটলারের মতো লোকও ইট-কাঠ-পাথরের নেফারতিতিতে মজে ছিলো। ভাগ্যিস, সে রক্ত-মাংসের নেফারতিতি দেখে নাই।
চলেন আবার কাহিনীতে ফিরে যাই। তৎকালীন মিশরে অনেক দেবতার পূজা প্রচলিত ছিলো। আখেনাতেন শুধুমাত্র সূর্যদেবতার পূজা চালু করলো যার নাম ছিলো 'অাতেন'। আর এই সূর্যদেবতার প্রতি সম্মান জানাতে গিয়া নেফারতিতি নিজের নাম পাল্টাইলেন। নিজের নাম রাখলেন 'নেফারনেফারুয়াতেন নেফারতিতি' যার অর্থ হচ্ছে 'সুন্দরীরা হচ্ছে আতেনেরই সৌন্দর্য, সুন্দরীর আগমন'।
ব্যক্তিগত জীবন নিয়া যদি আলোচনা করতে চাই তাহলে বলতে হবে আখেনাতেন এর সাথে নেফারতিতির সম্পর্ক ছিলো হালের 'রোমিও জুলিয়েট' দের মতো। এরা প্রকাশ্য চুম্বনেও অংশ নিতো। আখেনাতেন আর নেফারতিতির ছয় জন কন্যা সন্তান ছিলো।
অনেকে মনে করেন, নেফারতিতি আর আখেনাতেনের একটা পুত্র সন্তান ছিলো।
আবার অনেকে মনে করেন, তাদের কোনো পুত্র সন্তান ছিলো না। কিন্তু আখেনাতেনের পুত্র সন্তানের শখ ছিলো। তাই সে অারো অনেক নারীর সাথেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এর মধ্যে আখেনাতেনের বোনও ছিলো। তার গর্ভেই আখেনাতেন তুতেন খামুনের জন্ম দেন। পরবর্তীকালে এই তুতেন খামুনের সাথেই নেফারতিতি আর আখেনাতেনের মেয়ে আঁখেসেনামুন এর বিয়ে হয়। আঁখেসেনামুন সম্পর্কে তুতেন খামুনের হাফ সিস্টার ছিলো।
(হাফ সিস্টার-হাফ ব্রাদার ধারণাটা হচ্ছে যাদের হয় পিতা কিংবা মাতা এক থাকে। পিতা - মাতা উভয়ই এক হয় না। আলাদা হয়।)
নেফারতিতিকে রাজার স্ত্রী অর্থে রাণী বলা হয় না কিংবা বলা যাবেও না। প্রাচীন ইতিহাসে সবচাইতে প্রভাবশালী নারী শাসক হিসেবে নেফারতিতিকে বিবেচনা করা হয়। নেফারতিতিকে ফারাওদের মুকুট পড়তে দেখা গেছে। আবার সে শত্রুদের সাথেও ময়দানে সমান তালে যুদ্ধ করে গেছে।
এতো কিছুর পরেও, পরবর্তীকালের মিশরের ইতিহাসে নেফারতিতির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। এই রহস্যময়তাই তাকে এতো বিখ্যাত করে তুলেছে।
তার হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার অনেকগুলো কারণ বের করেছেন ঐতিহাসিকেরা।
প্রথমত, অনেকে মনে করেন- এই সময়টাতে নেফারতিতি মারা গিয়েছেন।অনেকে মৃত্যুর কারণ হিসেবে প্লেগ রোগকে দায়ী করছেন।
দ্বিতীয়ত, অনেক ইতিহাসবেত্তা মনে করেন- নেফারতিতি নিজেই ফারাওর পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত হন যার ফলে তিনি পুরুষালি পোষাক পরিধান করতেন। তাই পরবর্তী মিশরের ইতিহাসে তাঁর কোনো অস্তিত্ব নেই।
তৃতীয়ত, অনেকে আবার মনে করেন- স্মেঙ্খকার নাম ধারণ করে আখেনাতেন এর মৃত্যুর পর তিনিই মিশর শাসন করেন।
চর্তুর্থত, আখেনাতেন এর মৃত্যুর পর আখেনাতেন প্রদত্ত একেশ্বরবাদের বিলুপ্তি ঘটে। মানুষের মধ্যে আমেন-রা এর ভক্তি ফিরে আসে। ধারণা করা হয়, এই সময়টাতে নেফারতিতিকে নির্বাসনে পাঠানো হয়।
আগেই বলেছিলাম নেফারতিতি ক্যানো এতো বিখ্যাত তা বলবো-
দৈহিক সৌন্দর্য, ক্ষমতাধর নারী, রহস্যময়তা- এ সব কিছুই নেফারতিতিকে করছে বিখ্যাত, করেছে অনন্য। আর তাইতো প্রতি বছরই নেফারতিতির মূর্তি দেখতে সারা পৃথিবী থেকে প্রায় পাঁচ লাখ দর্শনাথী বার্লিনের নুয়েস ম্যুজিয়ামে পাড়ি জমান শুধুমাত্র ইট-কাঠ-পাথরের নেফারতিতিকে একনজরে দেখার জন্য।
(কোনো তথ্য বিভ্রাট থাকলে জানানোর অনুরোধ রইলো।)
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ৭:২৫