পাকিস্তান আমলের সঙ্গে তুলনা করলে তো বটেই, এমনকি গত পঁচিশ বছরের সঙ্গে তুলনা করলেও বলা যায়, আমাদের সাংবাদিকতার মান অনেক উন্নত হয়েছে। বিশেষ করে গত এক দশকের বিরাট অবদান হচ্ছে : টিভি সাংবাদিকতা।
মুদ্রণ ও বৈদু্যতিক মিডিয়া মিলিয়ে আমাদের সাংবাদিকতা পেশা এখন বেশ সমৃদ্ধ। খুব সূক্ষ্মভাবে পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল পর্যালোচনা করলে অবশ্য অনেক ত্রুটিবিচু্যতি বা দুর্বলতা ধরা পড়বে।
সাংবাদিকতা পেশার প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো : তাকে সব বিষয় সম্পর্কে কিছু কিছু জানতে হয়। কোন বিষয়ে তাকে পণ্ডিত না হলেও চলে। তবে সব বিষয় সম্পর্কে তার প্রাথমিক ধারণা থাকতে হবে। একজন মনীষী বহু বছর আগে বলে গেছেন : 'সাংবাদিক হচ্ছেন 'জ্যাক অব অল ট্রেড মাস্টার অব নান'। এই ধারণা এখন অবিকল আর কার্যকর বলে মনে হয় না। গত পঞ্চাশ বছরে বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকতা পেশার ধরন আমূল পাল্টে গেছে। গণমাধ্যম ভুবনের সর্বশেষ ধারণা হলো : সংবাদপত্র এখন আর টিভি ও অন লাইন সাংবাদিকতার সঙ্গে পেরে উঠছে না। তাছাড়া সংবাদপত্র প্রকাশ করাও এখন অনেক ব্যয়বহুল ব্যাপার হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞাপনদাতারা এখন সংবাদপত্রের চাইতে টিভির প্রতি আকৃষ্ট বেশি। এই আশঙ্কা কতটা সত্য তা আরও এক দশক পর ভালভাবে জানা যাবে। তবে সংবাদপত্রের ভবিষ্যতের স্বার্থেই এখন সাংবাদিকতায় 'বিশেষজ্ঞতা' সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।
একটা সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন বা টিভি চ্যানেলে নানা বয়সের ও নানা মানের সাংবাদিক কাজ করেন। তাদের একটা প্রস্তুতিকাল থাকে, যা প্রায় সবার জন্য প্রয়োজন। তারপর তারা অভিজ্ঞতা অর্জন করে। সংবাদপত্র বা টিভির নিয়ম অনুযায়ী তারা নানা বিটের সংবাদ সংগ্রহ করেন। সহকারী সম্পাদকরা নানা বিষয়ে সম্পাদকীয় বা উত্তর সম্পাদকীয় লেখেন। একটা সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলের এটাই সাধারণ চিত্র। এর ব্যতিক্রমও থাকতে পারে। কোন কোন পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল তার নীতি অনুযায়ী সাংবাদিকদের দায়িত্ব বণ্টন করে। এ ব্যাপারে কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই।
আমার মনে হয় এখন সময় এসেছে সিনিয়র সাংবাদিকদের বিশেষজ্ঞতা অর্জনের। প্রত্যেক সিনিয়র সাংবাদিক যদি অন্তত একটি বিষয় নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেন, ঐ বিষয়ের গভীরে যান, ঐ জগতের অন্যান্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গে সর্বদা মত বিনিময় করেন, ঐ বিষয়ে আশপাশের দেশে কি হচ্ছে, ঐসব দেশের নীতি কি ইত্যাদি সম্পর্কে যদি আপডেট থাকতে পারেন তাহলে তার পক্ষে বিশেষজ্ঞতা অর্জন করা কঠিন কাজ হবে না। এই 'বিশেষজ্ঞতা' আর বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞতা এক মানের হবে না। কেউ প্রত্যাশা করে না সাংবাদিক তার বিশেষজ্ঞতা দিয়ে পিএইচ ডি ডিগ্রী অর্জনের জন্য গবেষণা করবেন। কোন সাংবাদিক ইচ্ছে করলে তা করতেও পারেন। কিন্তু কোন ডিগ্রী এ ক্ষেত্রে জরুরি নয়। সাংবাদিক বিশেষজ্ঞতা অর্জন করবেন তার সাংবাদিকতার স্বার্থে, লেখালেখির স্বার্থে, তথ্য সংগ্রহের স্বার্থে। অপর পক্ষ যেন তাকে ভুল তথ্য বা ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বোকা বানাতে না পারে।
আমাদের দেশের সাংবাদিকতার বর্তমান অবস্থা কি ? সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা, ম্যাগাজিন, টিভি, অন লাইন ও বেতার কোন ক্ষেত্রে ক'জন 'বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক' কর্মরত রয়েছেন? কে কোন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ? পাঠক, বিশেষ করে আমি সাংবাদিক সমাজকে অনুরোধ করব নিজে নিজে একটা তালিকা তৈরি করতে। আপনার দীর্ঘদিনের সংবাদপত্র পাঠ ও টিভির নিউজ দেখার অভিজ্ঞতার আলোকে একবার চিন্তা করে দেখুন তো, ক'জন সাংবাদিক (ও কলামিস্ট) কি কি বিষয়ে নিজেদের বিশেষজ্ঞ বলে দাবি করতে পারেন? তালিকা করা হয়তো কঠিন নয়। কঠিন হলো : যাদের নাম এই তালিকায় স্থান পেয়েছে তাদের বিশেষজ্ঞতার প্রমাণ দেয়া। তাদের কেউ কি ঐ বিষয়ে অনেক প্রবন্ধ বা রিপোর্ট লিখেছেন? বই লিখেছেন? কোন মিডিয়া কি আলোচ্য বিষয়ে তাদের মতামত বা মন্তব্য প্রকাশ/ প্রচার করে? তাদেরকে কি কোন জাতীয় বা আন্তর্জাতিক সেমিনারে প্রবন্ধ পাঠ বা আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে? এখন এই শর্তাবলির আলোকে আপনার তালিকা আপনি নিজেই যাচাই করে দেখুন।
আমার নিজের ধারণা, আমাদের সংবাদপত্র বা টিভি জগতে সেরকম কোন বিশেষজ্ঞ নেই। তবু আমি দু'জন সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করতে আগ্রহী। একজন 'বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার জগলুল আহমেদ চৌধুরী (বিষয় : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি ও সরকার), দ্বিতীয় : চ্যানেল আই-এর বার্তা বিভাগের পরিচালক শাইখ সিরাজ (বিষয় : বাংলাদেশের কৃষি)। আমি যে শর্তাবলির কথা বলেছি তা হয়তো এঁরা দু'জনই পুরোপুরি পূরণ করতে পারেননি। তবে এঁদের দু'জন দুটি বিশেষ এলাকা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নিবেদিত। দুটি বিষয় নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন সাংবাদিকতা করতে করতে তাদের মধ্যে বিষয় সম্পর্কে একটা অথরিটি এসেছে। সাংবাদিকতা পেশায় এটা কম মূল্যবান নয়।
আমার এই মন্তব্য বা পর্যবেক্ষণ অসম্পূর্ণ হতে পারে। কোন সহৃদয় পাঠক যদি আরও কিছু নাম এই তালিকায় যুক্ত করতে পারেন আমি খুব খুশি হব। আমি চাই এই তালিকা দীর্ঘ হোক।
আরও কয়েকজন সাংবাদিক এই স্বীকৃতি অর্জনের পথে রয়েছেন। তারাও নির্দিষ্ট কিছু বিষয় নিয়ে বহুদিন লেখালেখি করছেন। তবে এখনও সমাজের স্বীকৃতি অর্জন করতে পারেননি। আমি আশা করি কয়েক বছরের মধ্যে তারা তাদের বিষয়ে বিশেষজ্ঞতা অর্জন করতে সক্ষম হবেন।
শুধু ভাল রিপোর্ট, এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট, অনুসন্ধানী রিপোর্ট লিখলেই ঐ বিষয়ে 'বিশেষজ্ঞ' হওয়া যায় না। তাঁকে মতামতধমর্ী লেখা লিখতে হবে নিয়মিত। ঐ বিষয়ে সরকারের নীতির মূল্যায়ন করতে হবে। কি নীতি হলে দেশের জন্য ভাল হতো, কেন ভাল হতো তা যুক্তি সহকারে লিখতে হবে।
বাংলাদেশ যেহেতু দরিদ্র ও অনুন্নত দেশ সেহেতু এই দেশে লেখালেখির বিষয় প্রচুর। অনেক সাংবাদিক শুধু রাজনীতিকেই, আরও স্পষ্ট করে বললে, দুই বড় দল নিয়েই সাংবাদিকতা করেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুই দল ও দুই নেত্রী খুব গুরুত্বপূর্ণ, সন্দেহ নেই। কিন্তু সাংবাদিকতার জন্য তার বাইরেও বহু বিষয় রয়েছে। বিশেষজ্ঞতা অর্জনের জন্য রয়েছে আরও নানা বিষয়। আমি এখানে কয়েকটি বিষয় প্রস্তাব করতে পারি। যেমন : (দেশীয়) শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানি, পরিবেশ, কৃষি, দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুদ্র ঋণ, গার্মেন্টস, কূটনীতি, এনজিও, নারী , শিশু, উপজাতি, সামরিক বাহিনী, নির্বাচন, জাতীয় সংসদ, সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা ও বিচারক, স্থানীয় সরকার ইত্যাদি। (আন্তর্জাতিক) সার্ক, বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাস, জাতিসংঘে বাংলাদেশ, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ইত্যাদি। একজন সাংবাদিক যদি এর একটি বিষয় নিয়ে সারা জীবন লেগে থাকেন ও ঐ বিষয়ে লেখালেখি (বা টিভি রিপোর্টিং) করতে থাকেন তাহলে দশ পনেরো বছরের মধ্যেই তিনি ঐ বিষয়ে বিশেষজ্ঞতা অর্জন করতে পারবেন। আমাদের অনেক সাংবাদিক নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে লেখালেখি করেন। কিন্তু নিয়মিত নয়। এবং যথাসময়েও লেখেন না। ঠিক সময়ে ঠিক লেখাটি লেখা বেশি জরুরি। নিয়মিত না লিখলে অনিয়মিত লেখাগুলো তেমন গুরুত্ব লাভ করে না।
লেখালেখি সম্পর্কে আমার যে সামান্য অভিজ্ঞতা রয়েছে তার ভিত্তিতে আমি বলতে পারি, লেখালেখি একটি পরিশ্রমী কাজ। মাথা খাটানোর কাজও বটে। অনেক সাংবাদিকের আগ্রহ বা স্বপ্ন থাকা সত্ত্বেও পরিশ্রমটুকু করতে চান না। পরিশ্রম ছাড়া কোন কাজেই বা সাফল্য এসেছে? একমাত্র দুনর্ীতিই ব্যতিক্রম। 'মন্ত্রীর' স্বাক্ষর দিয়েই কোটি টাকার কমিশন পাওয়া যায়। এত সহজে প্রাপ্তি আর কোন কাজে আসে না।
আমাদের সাংবাদিকদের মধ্যে প্রতিভাবান ও মেধাবী সাংবাদিকের সংখ্যা কম নয়। তারা চাইলে ও তাদের প্রতিষ্ঠান সহযোগিতা করলে অনেক সাংবাদিক পাঁচ দশ বছরে 'বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক' হয়ে উঠতে পারবেন। যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করে সেই প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে টিভি সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে। যেখানে কাজ করতে হলে একটা টীম দরকার। গাড়ি দরকার। প্রযুক্তি ও অর্থ সহায়তা দরকার। কর্তৃপক্ষ যদি এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে না পারে তাহলে টিভি রিপোর্টারের পক্ষে 'বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক" হওয়া কখনও সম্ভব হবে না।
সবশেষে আমি বলব : 'বিশেষজ্ঞ' শব্দটির অপব্যাখ্যা হবার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশে 'গণতন্ত্র' শব্দটিরও অপব্যাখ্যা হয়ে থাকে। কাজেই 'বিশেষজ্ঞের' হতে বাধা কোথায়? আমি তাঁকেই বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক বলব, যিনি ঐ বিষয়ে অনেক তথ্য জানেন, অনেক তথ্য, রিপোর্ট, গবেষণা, বই তাঁর পড়া ও তাঁর সংগ্রহে রয়েছে, তিনি ঐ বিষয়ের সর্বশেষ তথ্য জানেন, সরকারের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত জানেন, আইনের কপি তাঁর সংগ্রহে রয়েছে, 'শোনা কথায়' তিনি কিছু লেখেন না, তিনি কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষ দ্বারা প্রভাবিত হন না, তিনি বিষয়টা পর্যালোচনা করে লিখতে পারেন, এই বিষয়ে তাঁর বহু কলাম/ প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে, বই প্রকাশিত হয়েছে, প্রফেশনাল সভা সেমিনারে আলোচ্য বিষয়ে তাঁকে বক্তৃতা করতে ডাকা হয় ইত্যাদি। 'বিশেষজ্ঞ' শব্দটার একটা আন্তর্জাতিক পরিচয় আছে। কাজেই দেশীয় মাপকাঠিতে আধা 'বিশেষজ্ঞ' বলার সুযোগ নেই। আমরা যাকে 'বিশেষজ্ঞ' বলব আন্তর্জাতিক ফোরামও তাকে বিশেষজ্ঞ বলে মেনে নেবে। এটা জাতীয় প্রেসক্লাব বা সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচন নয় যে, আমার ফোরাম সদস্যরা ভোট দিলেই আমি 'নেতা' হয়ে গেলাম। 'বিশেষজ্ঞ' 'ভোট' দিয়ে নির্বাচন করা যায় না। ভোট দিয়ে নেতা নির্বাচন করা যায়।
আমাদের সাংবাদিকতা এখন বেশ সমৃদ্ধ। বৈচিত্র্যময়। এখন সময় এসেছে বিশেষজ্ঞ সাংবাদিকতার। আমাদের তৈরি করতে হবে নানা বিষয়ে 'বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক।' সব সাংবাদিকেরই নানা বিষয়ে জ্ঞান বা ধারণা থাকবে। কিন্তু কেউ যদি একটা বিষয়ে 'বিশেষজ্ঞ' হতে পারেন এরচেয়ে বড় সাফল্য আর কিছু হতে পারে না।