- এই ছেলে , লেডিস উঠতে দিচ্ছ না কেন ?
- দেখতাছেন না , লেডিস সিট নাই । বইবোডা কই ?
- সিট নাই তারপরও তো ২০ টা মানুষ দাড় করিয়ে নিচ্ছো । এই অফিস ছুটির টাইমে বাস পাওয়া কঠিন । তারপরও যদি তোমরা মেয়েদের এইসময়ে বাসে না উঠতে দাও তারা বাসায় যাবে কিভাবে ? উনাকে উঠতে দাও । গেট থেকে সরে দাড়াও বলছি ।
কন্ডাক্টার সরে দাঁড়ালে রেহানা বাসে উঠলো । লোকটিকে রেহানার ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছা করছে । এই শহরে অল্পতেই কাউকে সরাসরি ধন্যবাদ দেয়াটা সন্দেহের চোখে দেখা হয় । অথচ এই ভদ্রলোক সত্যিকার অর্থেই রেহানার উপকার করেছে । প্রায় এক ঘণ্টার মতো সে কারওয়ান বাজার বাস স্টপেজে দাড়িয়ে । একটা বাসেও সে উঠতে পারেনি । মানুষে ভর্তি জিপ করা বাস সাঁই সাঁই করে চোখের সামনে দিয়ে উড়ে যায় । লেডিস সিট ফাঁকা থাকলেও বাসগুলো মেয়েদের তুলতে চায় না । একজন মেয়ে নাকি তিনজন যাত্রীর ভাড়া নষ্ট করে । রেহানার কয়েকজন মেয়ে কলিগ ছেলেদের মতো হুড়াহুড়ি করে উঠতে পারলেও রেহানা পারে না । এই শহরে রেহানার মতো ‘ কি হতে কি হয়ে যায় ‘ ভয়ে থাকা নিন্ম মধ্যবিত্ত চাকুরীজীবী মেয়েরা অনেক কিছুই পারে না । যেমন পারে না কন্ডাক্টারকে ধমক দিয়ে বাসে উঠতে । ফলে বাসে উঠার প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়া মানুষরা সঠিক সময়ে বাসায় চলে যায় আর রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাড়িয়ে থাকতে হয় রেহানাদের । কেউ করুনাবশত তাদের তুলে নিলে তারা যেতে পারে । আজ যেমন করুনা করেছে ত্রিশ ঊর্ধ্ব ফিটফাট এই ভদ্রলোকটি ।
( খ )
বাসটিতে প্রচুর ভীড় । মহিলা সিটও খালি নেই । রেহানা উপরের রড ধরে কোনমতে দাড়িয়ে আছে । চারিদিকে ঘামের বিশ্রি গন্ধ । গা গুলিয়ে উঠে । চাকুরীর সুবাদে দেড় বছর যাবত এই ঢাকাতে । এতদিনে এইসবে অভ্যাস হয়ে যাওয়ার কথা । কিন্তু হয় না । প্রতিদিন এই বাসের জন্য অপেক্ষা , চাপাচাপি , জ্যাম , ঘামের গন্ধ , দাড়িয়ে দাড়িয়ে ঝুলতে থাকা এইসবে সে কোনমতেই অভ্যস্ত হতে পারে না । কষ্ট হয় । কেন যে মানুষকে ঢাকায় পোস্টিং দেয় !
- হ্যালো , আপনি আমার সিটে বসুন । আমি দাঁড়াচ্ছি ।
সেই লোকটি তার সিট ছেড়ে দিচ্ছে । মাঝে মাঝে এমন হয় । বাসে কয়েকজন মেয়েদের জন্য সিট ছেড়ে দেয় । কিন্তু আজ রেহানা বসতে চাচ্ছে না । এমনিতেই লোকটি তাকে বাসে উঠতে সাহায্য করেছে । লজ্জায় সরাসরি ধন্যবাদ পর্যন্ত জানানো হয়নি । এখন আবার নিজের সিট ছেড়ে দিচ্ছে !
- না না ঠিক আছে । আমি দাড়িয়ে যেতে পারবো ।
- আরে বসুন । একজন লেডিস দাড়িয়ে যাবে আর আমি তার পাশে বসে থাকবো এতোটা অভদ্র আমি নই । আপনি বসুন । প্লীজ ।
রেহানা সিটে বসলো । নেভি ব্লু শার্ট ইন করা দরমাল প্যান্টের ভদ্রলোকটি একটি বেসরকারী কোম্পানিতে জব করে । গলায় আইডি কার্ড ঝোলানো । কানে সাদা হেডফোন । গানের তালে তালে কিছুক্ষন পর পর উনার মাথা দুলছে । তার জন্য লোকটি দাড়িয়ে যাচ্ছে । রেহানার লজ্জা করছে । ইশ সি এন জি গুলো ভাড়া যদি একটু কম করে নিতো , তবে প্রতিদিন সে সিএনজি'তে যাতায়াত করতো । এই বাসের ঝামেলা আর ভালো লাগে না । রেহানার বাম পাশের সিটে এক বৃদ্ধ জানালার কাঁচে মাথা রেখে ঝিমোচ্ছে । কাঁচ না ভেঙ্গে গেলেই হয় ।
এখন রেহানার একমাত্র লক্ষ্য বিছানা । কখন সে বাসায় যাবে আর কখন বিছানায় গা এলিয়ে দিবে ? ইশ বাসটা যদি উড়াল দিয়ে তার বাসায় চলে যেত ! ক্লান্তি রেহানার দু চোখে ভর করেছে । সে চোখ বন্ধ করলো ।
(গ)
রেহানা জেগে উঠেছে । তার খুব অস্বস্তি হচ্ছে । সে তার ডান কাঁধে শক্ত কিছুর স্পর্শ পাচ্ছে । পিছনে কন্ডাক্টার কোন এক যাত্রীর সাথে ১ টাকা নিয়ে কথা কাটাকাটি করছে । ১ টাকা ছেড়ে দিতে কেউ রাজি না ।
রেহানা চেষ্টা করছে তার অস্বস্তির কারনটা ইগনোর করতে । কিন্তু সে পারছে না ।
আড়ং এর সিগন্যালে গাড়ি আঁটকে আছে । বিশাল বড় গাড়ির বহর অপেক্ষা করছে সবুজ বাতির । কখন জ্বলবে কে জানে ।
রেহানার কান্না পাচ্ছে । সে জানে এটা কান্না করবার মতো বিষয় না । এমন ঘটনা বাসে যাতায়াত করা অধিকাংশ মেয়েদের সাথে প্রতিনিয়ত হয় । অথচ এই নোংরা স্পর্শ রেহানাকে যেন গরম লোহার শিক দিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে । সে আর সহ্য করতে পারলো না । সিট থেকে দাড়িয়ে কন্ডাক্টারের হাতে টাকা গুঁজে সে বাস থেকে নেমে দাঁড়ালো ।
( ঘ )
তার বাসা এখনো অনেক দূর । বিকালের এই শান্ত রোদে রেহানা ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে । মনে মনে একজনকে সে “ কুত্তার বাচ্চা “ বললো । গালিটা বাসের সেই ত্রিশ ঊর্ধ্ব ফিটফাট ভদ্রলোকটিকে উদ্দেশ্য করে ।
![]()
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই এপ্রিল, ২০১৬ বিকাল ৪:৪৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




