" জনম জনম ধরে কসাই হতে চাই " ,
উৎসর্গঃ সকল কসাই কে (ডাঃ কে) ,
৭১ টা মিস্ড কল। হাতের তালু দিয়ে চোখ টা রগড়ে নিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনে আবারো চোখ রাখল সিয়াম,না, সে ভুল দেখেনি। ফোন করেছিলেন রাবেয়া ম্যাডাম ।
ও, একটু বলে নেই যে রাবেয়া ম্যাডাম ছিলেন সিয়ামের ইন্টারমিডিয়েট কলেজের বায়োলজির ম্যাডাম। খুবই ভালো পড়াতেন ম্যাডাম। প্রতিটা স্টুডেন্টের যত্ন নিতেন নিজ সন্তানের মত। ।
সিয়ামের মনে হল ম্যাডামের নিশ্চয়ই বড় কোনো সমস্যা হয়েছে। তা না হলে তো এতবার ফোন দেয়ার কথা না। আর মোবাইল টা সাইলেন্ট করে রাখার কারণে ও বুঝতে পারেনি যে এত গুলো কল এসেছিল। দ্রুত কল ব্যাক করল " ও "
ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করতেই ইথারে ভেসে এল ম্যাডামের কান্নাভেজা, বাকরুদ্ধ কন্ঠস্বর। , সিয়ামঃ প্লিজ ম্যাডাম কান্না থামিয়ে আগে বলুন কি হয়েছে?? ওপাশের কান্না আর থামে না,
সিয়ামঃ ম্যাডাম, প্লিজ কি হয়েছে বলুন,
ম্যাডামঃ দুপুরবেলা হঠাৎ করে আমার মা মাথা ঘুরে পরে যান । এরপর থেকে শরীরের ডানপাশ টা নড়াতে পারছেন না, কথা বলতে পারছেন না, অন্যদের কথা বুঝতেও পারছেন না ঠিকমত। ।।
সিয়ামঃ ম্যাডাম, আপনারা ওনাকে দ্রুত আমাদের মেডিকেল কলেজ হসপিটালে নিয়ে আসুন। ।
, সিয়াম দেশের একটি স্বনামধন্য মেডিকেল কলেজ,শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ৪র্থ বর্ষের ছাত্র। আর মাত্র একমাস পর তার MBBS ২য় পেশাগত পরিক্ষা শুরু হবে। তার বন্ধুরা ইতোমধ্যে পরীক্ষার প্রস্ততি অনেক খানি নিয়ে ফেলেছে অথচ তার অবস্থা তথৈবচ্। নানামুখী ঝামেলায় সে এখনো পড়া শুরুই করতে পারেনি। মনে মনে ভাবছিল যে আজ রাত থেকে পড়া শুরু করবে। তাই দুপুরে ক্লাশ থেকে ফিরে ঘুমিয়ে পরেছিল। আর তার মধ্যেই ম্যাডামের ফোন।। ,
সিয়াম ম্যাডাম কে ফোন দিয়ে এদিকে ইমার্জেন্সিতে খোঁজ নিয়েছে কোন স্যার আছেন। ইন্টার্নীর কোন্ ভাইয়া বা আপু আছেন। কোন ওয়ার্ডে বেড ফাঁকা আছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। , ,ইতোমধ্যে ম্যাডামের মাকে বহনকারী গাড়ি ইমার্জেন্সির গেটে চলে এসেছে। তখন বাজে সন্ধ্যা ৭ টা। ওয়ার্ড বয়/আয়ার জন্য অপেক্ষা না করে নিজেই স্ট্রেচার নিয়ে এসে রোগীর সাথে আসা লোকজনের সাথে মিলে রোগীকে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে আসল। এরপর ভর্তি করা,ডাক্তার দেখানো থেকে শুরু করে তাৎক্ষনিক কিছু টেষ্ট কারানো সহ প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র ও কিছু ইকুইপমেন্ট কিনে দিয়ে সে দিনের মত ম্যাডামের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হলে ফিরতে ফিরতে রাত ১২ বেজে গিয়েছিল। , টানা ৫ ঘন্টা হসপিটালের এ মাথা থেকে ও মাথা ও ফার্মাসিতে দৌড়াদৌড়ি করে এবং রোগী কে ওঠানামা করাতে গিয়ে সিয়ামের অবস্থা পুরা বিদ্ধস্ত। তারপর সে হলে এসে দেখে ডাইনিংয়ে খাবার শেষ । রাত ১২ টায় অবশ্য খাবার থাকার কথাও না। কি আর করা এই বিদ্ধস্ত শরীরটাকে সিয়াম কোনমতে শপে দিল বিছানার কোলে। মুহুর্তের মধ্যে সে হারিয়ে গেল গহীন ঘুমের অতলে।
পরের দিন সকাল ৮ টা। সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হসপিটালের মেডিসিন ইউনিট ৪ এর ৩ নং ওয়ার্ডের ৭ নং বেড। সিয়াম দাড়িয়ে আছে ম্যাডামের মা কে নেওয়ার জন্য । বিভিন্ন টেস্ট করতে হবে। ইসিজি,ইকো, এক্সরে,সিটিস্ক্যান সহ আরো কিছু টেষ্ট। আয়ার কোন খবরই নাই।নাই সিস্টারদেরও কোন মাথা ব্যাথা। অগ্যতা সিয়াম নিজেই খুঁজে খুঁজে একটা স্ট্রেচার নিয়ে এল। অনেক কষ্টে রোগীকে স্ট্রেচারে নিয়ে ওয়ার্ড থেকে বের হল টেষ্টের জন্য। সিয়াম সকাল থেকেই চেষ্টা করছিল যে টেষ্টগুলো ফ্রি করানো যায় কিনা, যেহেতু সে মেডিকেল স্টুডেন্ট, সেই রেফারেন্সে। কিন্তু সে এখন জানতে পারল যে মেডিসিন ইউনিট ৪ এর স্যার আজ ছুটিতে আছেন। এরপর সিয়াম অনেক কষ্ট করে অন্য একজন অধ্যাপকের কাছ থেকে টেষ্ট গুলো ফ্রি করিয়ে আনে। কষ্টের কারণ হল পেশেন্ট ভর্তি ছিলেন পেয়িং বেডে। এরপর সেদিন সে আর সবগুলো টেষ্ট করাতে পারল না অলরেডি সাড়ে ১২টা বাজে বলে। পরদিন সিয়াম বাকি টেষ্টগুলো করালো। এরপর রেজাল্ট আসলো অ্যাকিউট ইস্কেমিক স্ট্রোক। এরপর মেডিসিন ইউনিট থেকে পাঠানো হল ফিজিক্যাল মেডিসিন ইউনিটে। ৬/৭ দিন থাকার পর পেশেন্ট ইমপ্রুভ করল।এই ৬/৭ দিন বলতে গেলে প্রায় অধিকাংশ সময় সিয়াম পেশেন্টের জন্য ব্যয় করল। এদিকে যতই দিন যাচ্ছে ততই এগিয়ে আসছে সিয়ামের পেশাগত পরীক্ষা ।
আজ ম্যাডামের মাকে রিলিজ দেয়া হয়েছে । কলেজ হসপিটালের অ্যাম্বুলেন্সে করে সিয়াম ম্যাডামের মাকে তাদের বাসায় রেখে আসতে গিয়েছে। ম্যাডামের বাসা থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় ঘটে গেল এক অভুতপূর্ব ঘটনা যার জন্য সিয়াম প্রস্তুত ছিল না ।
সিয়াম যখন বিদায় নিয়ে আসতে যাবে ঠিক তখন ম্যাডামের মা,৮০ বছরের বৃদ্ধা, যিনি এখনো ঠিকমত কাউকে চিনতে পারেন না ,কথা বলতে পারেন না সেই তিনি টানা ১০ মিনিট ধরে গোটা গা য়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিয়েছেন । তারপর ও তিনি সিয়ামের হাত ছাড়তে চান না ।
ম্যাডামের বাসা থেকে বের হয়ে সিয়াম পিচঢালা উত্তপ্ত পথে হাটছে আর ভাবছে যে ,"এই কসাইয়ের জীবনটা একেবারে খারাপ না । এই রকম বয়স্ক মানুষদের ,যাদের দোয়া কবুল না করে ফেরত পাঠাতে আল্লাও লজ্জাবোধ করেন ,তাদের কাছ থেকে এই রকম অকৃত্রিম ভালবাসা আর দোয়া পাবার জন্য আমি বারবার , জনম জনম ধরে কসাই হতে রাজি আছি ।"
পুনশ্চ ১ :পাঠকরা হয়ত বলতে পারেন যে সিয়াম এত কিছু করেছে তার ম্যাডামের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে। , পাঠক এটা বলতেই পারেন । , তবে , এই টাইমের ভিতরেই সিয়াম একদিন স্কয়ার হসপিটালে গিয়ে একজন ধনী পেশেন্টকে রক্ত দিয়ে এসেছিল, যাকে সে চেনে না ,এমন কি নামটা পর্যন্ত জানা হয় নাই। উল্টা আরো যাওয়া আসা করতে সিয়ামের ১০০ টাকা খরচ হয়েছে ।
পুনশ্চ ২: উপরের গল্পটা সকল কসাইয়ের (মেডিকেল সস্টুডেন্ট /ডাক্তারের) জীবনের অতীব সাধারণ ঘটনা। , , পুনশ্চ ৩: পাগলে কিনা কয় আর ছাগলে কিনা খায়। , আমরা কসাইরা (ডাক্তার রা) পাগল ছাগলদের কথায় কিছু মনে করি না ।।।