৩রা সেপ্টম্বর ২০১৫
আমার পাঠানো ম্যাসেজ গুলো আজকাল আনসিন হয়েই পরে থাকে। ম্যাসেঞ্জারে হয়ত আমার নামটা দেখে, তুমি আর ম্যাসেজ গুলোই পড় না। কিন্তু তবুও রোজ আমি তোমাকে শুভ সকাল, ও শুভ রাত্রির ম্যাসেজ পাঠাই। ভাল থেক লিখে পাঠাই। জানি তুমি হয়ত ভাল আছ। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি ভাল নেই।
৭ই সেপ্টম্বর ২০১৫
সব সময় শুধু তোমার কথাই মনে পরে। জানো যখন জানলা দিয়ে বাইরে আকাশে পূর্ণিমার চাঁদটা দেখি, তখন মনে পরে যায়, সেদিনের কথা। তোমার সাথে দুষ্টুমি করে কাটানো সেই সব সময়ের কথা। আমি দুষ্টুমি করলে, তুমি রাগ করে আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিতে। জানত রাগলে না তোমাকে বাচ্চা মেয়েদের মতোন দেখায়। কেমন তুমি গাল ফুলিয়ে বসে থাকতে। আমি যখন হাত দিয়ে জোরে তোমার গাল টেনে দিতাম, তুমি ব্যাথায় চিৎকার করে উঠতে। আর আমি তোমার হাতে মার খাওয়ার ভয়ে ওখান থেকে দৌড় দিতাম। তুমি আমাকে মারবে বলে, আমার পিছন পিছন দৌড়াতে। জানত নীলা, খুব মনে পরে সেই দিন গুলোর কথা। এখন তো তুমি আমার উপর রাগ করা ভুলেই গেছ।
৩০শে সেপ্টম্বর ২০১৫
আজকাল আর কিছুই ভাল লাগে না। সব কেমন ছন্ন ছাড়া। আজ মাসখানেক হয়ে গেছে বাড়ি ছেড়ে আমি নতুন এক ঠিকানায় এসেছি। জায়গাটা খুব একটা ভাল না। কিন্তু আমার জন্য স্পেশাল রুমের ব্যবস্থা হয়েছে। সেখানে আমি একাই থাকব। আমার দেখভাল করার জন্য এখানে অনেক লোক। কিন্তু আমাদের এই আবাসনে বিভিন্ন ধরনের লোক থাকে। সবাই কেমন যেন উদ্ভট। আজকে আর কিচ্ছু ভাল লাগছে না।
১৫ই অক্টোবর ২০১৫
জানো নীলা, সেইদিনটা আজকে খুব মনে পরছিল। যেদিন তুমি প্রথম লাল রঙের একটা শাড়ী পরে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল। মাথায় লাল রঙের টিপ, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। উফ, সত্যি বলছি দারুন দেখাচ্ছিল তোমায়। আমি সেদিন পাঞ্জাবিতে ছিলাম। নীল রঙের। নীল তোমার খুব পছন্দ ছিল না? নীলার পছন্দ নীল রঙ। আর আমার পছন্দ নীলা কে। শুধু নীলা কে....
৫ই নভেম্বর ২০১৫
দিন দিন কেমন একটা হয়ে যাচ্ছি। লিখতে আর ভাল লাগে না। শরীর ভাল থাকে না। খাওয়া দাওয়া ঠিক মত করি না। নীলা, আমি না খেয়ে থাকলে, তুমি আমাকে কি বকাবকি করতে মনে আছে? আমাদের এই নতুন ঠিকানায় জানো তো, একজন দিদি আছে। সে আমাকে খুব শাসন করে। খাবার খাওয়ার জন্য জোড়াজুরি করে। আমি না খেলে, আমার উপর খুব রেগে যায়। কিন্তু আমার তো খাবার খেতে ইচ্ছা করে না। আমার শুধু ইচ্ছা করে, তোমার কাছে যেতে। তোমার কি এখনো আমার কথা মনে আছে? নাকি ভুলে গেছ আমায়? আমার বিশ্বাস হয় না তুমি আমাকে ভুলে গেছ। নিশ্চই তোমার আমার কথা মনে আছে! তাই না নীলা?
২০শে নভেম্বর ২০১৫
এলো তো এলে, এত কম সময়ের জন্য এলে কেন নীলা? বল? আমাকে কষ্ট দিয়ে এত শান্তি পাও কেন তুমি? কি দোষ আমার যে দূর থেকেই চলে গেলে। কত ডাকলাম তোমায়, একবার কর্নপাত ও করলে না? কষ্টই যখন দেবে, তখন আসার কি দরকার ছিল? বল, কি দরকার ছিল? তুমি আজও আমাকে বুঝলে না নীলা, আজও বুঝলে না।
-ম্যাডাম
কেরানী সানির ডাক হুশ ফিরল বিনার। এতক্ষন তিনি বুঁদ হয়ে অভির লেখা ডায়রিটা পড়ছিলেন। পড়তে পড়তে কখন যে চোখের কোনায় জল চলে এসেছে, নিজেই বুঝতে পারেননি। সানির ডাকে তিনি সম্বিত ফিরে পেলেন,
- হুম! কি হয়েছে সানি? (বিনা)
- ম্যাডাম, পুলিশ বডিটা নিয়ে চলে গেছে। কালকের মধ্যেই পোস্টমর্টেম রিপোর্ট চলে আসবে।
- আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি এখন যাও।
সানি চলে যেতেই, তিনি পৃষ্ঠা ওল্টাতে ওল্টাতে ডায়রির লিখিত শেষ পাতায় এসে পৌছালানে। তারিখ ১০ই ডিসেম্বর হলেও, এই পাতাতেই নিজের শেষ লেখাটা লিখে ছিল অভি। ডায়রির খাপ ছাড়া খাপ ছাড়া পাতায়, শুধুই নীলা কে হারানোর যন্ত্রণা ফুটে উঠেছে। শেষ পাতাতেও সেরকমই এক যন্ত্রণার আভাস পাওয়া গেল।
১০ই ডিসেম্বর ২০১৫
সবাই বলে আমি নাকি পাগল। সত্যি আমি পাগল। তোমার প্রেমে পাগল। কিন্তু নার্স দিদি বলে, আমি তোমার প্রেমে পরেই নাকি পাগল হয়েছি। ওরা তো জানে না। আমি তোমাকে কত ভালবাসি। আর ওরা এটাও জানে না, তুমি আমাকে কতটা ভালবাস। আমার সেলের ভেতর থেকে যখন পূর্নিমার চাঁদটা দেখা যায়, আমি শুধু তোমার কথাই ভাবি। কখন তুমি আমার কাছে আসবে। আজকে আবার পূর্নিমা, তুমি আজকে আসবে তো নীলা? কি আসবে তো?
লেখা গুলো পড়ে, বিনার চোখ থেকে দুফোটা জল গড়িয়ে পরল। মনে পরে গেল সেদিন কার কথা যেদিন অভিকে প্রথম দিন অ্যাসাইলামে নিয়ে আসা হয়। ২৬, ২৭ বছরের একটা তরতাজা যুবক, পাগল হয়ে মেন্টাল অ্যাসাইলামে এসেছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, নিজের প্রেমিকা কে খুন করার। আদালত কোন মানসিক বিকার গ্রস্থ রুগির বিচার করে না। তাই তাকে সুস্থ করার জন্য বিনাদের অ্যাসাইলামে পাঠানো হয়েছে। এখন থেকে অভি বিনাদের অ্যাসাইলামেই থাকবে। বিনার উপর দায়িত্ব পরে অভির দেখা শোনা করার। সব সময় চুপচাপ থাকা অভি, কারোর সাথেই খুব একটা বেশি মিশত না। হঠাৎ একদিন অভি বিনার কাছে কিছু কাগজ আর কলম চায়। তার কাছে জিঞ্জেস করায় বলে
-হুম হু বলব না! আগে কাজগ কলম এনে দাও না হলে বলব না।
অভির কথা রাখার জন্য বিনা তাকে কাজগ কলম এনে দেয়। তাকে আবার জিঞ্জেস করে,
-এই নাও কাগজ তো পেলাম না, তাই তোমার এই দিদির তরফ থেকে এই ডায়রি আর কলম। এবার বল এগুলো দিয়ে কি করবে?
বিনার প্রশ্ন শুনে অভির মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে বিনাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকে, তারপর কানে কানে বলে,
-এখন বলব না। যেদিন আমি এখান থেকে চলে যাব। সেদিন তোমাকে এই সব কিছু দিয়ে যাব। তখন দেখবে, আমি এগুলো দিয়ে কি করতাম। উম। (বাচ্চাদের মতো হেসে ওঠে অভি)
-আচ্ছা বেশ, সেদিনই না হয় দেখব। তুমি কি লেখ এগুলো দিয়ে।
বিনা অভির অতীতের সব ঘটনার কথাই জানত। পুলিশ থেকে অভির কেস ফাইল পাঠানো হয়েছিল। নীলা নামের একটি মেয়েকে ভালবাসত অভি। মেয়েটিও অভিকে ভালবাসত। একদিন দুজনে একসাথে ঘুরতে বেরিয়েছিল। লং ড্রাইভে শহর ছেড়ে দুইজন অনেক দূরে ফাঁকা একটা জায়গায় চলে যায়। দুজনের সান্নিধ্যে ভালই সময় কাটছিল। কিন্তু হঠাৎই সেখানে জনা তিন চারেক দুষ্কৃতি, আগ্নেয় অস্ত্র নিয়ে হাজির হয়। অভি ও নীলার কাছে যা ছিল, সব কিছু তার কেড়ে নেয়। কিন্তু তাতেও তাদের আশ মেটে না। তার হাত বাড়ায় নীলার শরীরে দিকে। দুষ্কৃতিদের বাঁধা দেওয়ার জন্য ঝাপিয়ে পরে অভি। দুষ্কৃতি দলের পান্ডার সাথে হাতাহাতির সময়, অভির হাতে চাপ লেগে, রিভলবার থেকে গুলি বেরিয়ে যায়। আর সেই গুলি ছুটে গিয়ে লাগে, নীলার শরীরে। রক্তে রাঙা হয়ে ওঠে নীলার শরীর। নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না অভির। কি করল সে এটা? নিজের হাতে নিজের ভালবাসার মানুষটিকে শেষ করে ফেলল? সেদিন নীলার পরনে ছিল, অভির দেওয়া সেই লাল রঙের শাড়িটা। আর অভির পরনে, নীলার পছন্দের, নীল রঙের পাঞ্জাবি। দুটোই লাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে। অভির কোলে মাথা রেখেই, নিজের শেষ নিঃশ্বাস ছাড়ে নীলা। অভিও হয়ত জীবন কে ছেড়ে দিয়েছিল সেদিন, শুধু শরীরটাকেই বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল। কারন অতিরিক্ত মানষিক আঘাত পেয়ে পাগল হয়ে যায় অভি। বিরহের যন্ত্রণা তার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হয়নি। তারপর আদালতের রায়ে মেন্টাল অ্যাসাইলাম। আর সেখানে এসেই, তার ডায়রি লেখা। যেটা পড়ে সে বুঝতে পারে, নীলা কে কতটা ভালবাসত অভি। মানসিক আঘত ওকে পাথর করে দিয়েছিল। বিনা ছাড়া আর কারো সাথেই কথা বলত না। বেশির ভাগ সময়ই অ্যাসাইলামের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকত। মাঝে সাঝে ইচ্ছা হলে, ডায়রি নিয়ে বসে বসে লিখত। যদিও মাঝে সাঝে। তাই তো তার ডায়রির পাতার বেশির ভাগটাই ফাঁকা। মাঝে সাঝে ইতি উতি, ভালবাসার ইঙ্গিত। সেই অভিও আজ আত্মহত্যা করেছে। নিজের সেলেই। রাতের দিকে। যখন খুব একটা কড়া পাহাড়া থাকে না তখন। যেই জনলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকত, সেখানকার রডেই একটা কাপড় বেঁধে নিজেকে ঝুলিয়ে দিয়েছে সে। চলে গেছে তার নীলার কাছে। পৃথিবীতে তাদের যে ভালবাসা এক হতে পারেনি, মৃত্যুর পরে হয়ত সেই ভালবাসাই তাদের কে এক করে দেবে। ভাবতে ভাবতেই অভির ডায়রিটার দিকে চোখ পরে বিনার। চঞ্চচল বাতাসে, ডায়রির পাতা গুলো উড়ছে। তার একটা পাতায়, নীল কালির কিছু লেখা চোখে পরছে। ডায়রিটা হতে তুলে নিল বিনা। পাতাটা উল্টে নিয়ে পড়তে শুরু করল। দেখল একটা কবিতা লেখা, অভির লেখা কবিতা
“আমি ভালবাসতে জানি না!
তাই তো বিরহ আমার সঙ্গী।
আমি আপন করতে জানি না!
তাই তো একাকিত্ব আমার সঙ্গী।
আমার সঙ্গী কোন মানবী নয়;
সে তো কেবলই অনুভূতি।
অনুভূতি গুলো শব্দ হয়ে;
খাতার পাতাতে বন্দি।
আমি বন্দি হয়ে রয়েছি;
কিন্তু আমার স্থান জেলে নয়।
সন্ধি করেছি মনের সাথে;
তাই তো বিরহ আমার সঙ্গী....................................”
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১:৫৫