somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃআবৃত্তির গল্প

১৯ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১১:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


'ভাইয়া, ফুল ন্যাবেন?' -পিঠে হাত দিয়ে ছোট্ট একটা মেয়ে আমাকে ফুল দেখাচ্ছিল। বনানী কবরস্থানে এরকম মেয়ে হরহামেশাই দেখা যায়।

আমি একা। মা মারা গেছেন আরো ছয় বছর আগে।বাবা এখন পর। অন্য মহিলাকে বিয়ে করে বেশ সুখেই আছে।আমাকে দেখাশোনা করার মত ৭০০ কোটি মানুষের মধ্যে একজনও নেই।বনানী কবরস্থানে আমি প্রায়ই বসে থাকি। মন খারাপ লাগলে, এ কবরস্থানে এসে বসে থাকি।এখানে যে আমার মা শুয়ে আছে।

ফুলওয়ালা এ মেয়েটার চোখে কেমন যেন দুঃখের ছাপ। তার পিঠে হাত দিয়ে আমি বসতে বললাম।

-কী নাম?

-জোছনা।

-বাহ!! বেশ নাম তো...

মেয়েটা পোকলা দাতে হেসে দিলো।

-তুমি ফুল বিক্রি ছাড়া আর কি কর?

-কিসু না।

-পড়াশোনা করোনা?

-জ্বে না,আমার বাপে পিটাইবো।

-ও,তোমার বাবা কি করে?

-আমার বাপে সারাদিন পচাপানি খায়। এর লাইগ্যা আমার থেকে ট্যাকা নেয়।

-তোমার মা কিছু বলেনা?

-আমার মায় মইরা গেসে।নতুন মায় কিসু কয় না।

-তোমার কি এখানে থাকতে ইচ্ছে করে?

-না।

-আমার সাথে যাবা?

-হ যামু।

-আজ থেকে তুমি আমার বোন।

মেয়েটা বুঝতে পারছিল না। তবে কেন জানি হাসছিল।ধানমন্ডির এক কোনে আমার মেস। ঠিক মেস বলা যায় না। সাবলেটে একটা বাসা নিয়ে একাই থাকি। কিছু ছাত্র ছাত্রী পড়াই আর মাঝে মাঝে গল্প কবিতা লিখি। এগুলো দিয়েই আমার পেট চলে। মেয়েটার হাতের ফুলগুলো আমার হাতে নিয়ে নিই।

বাসায় আনার আগে ওকে নিউমার্কেট নিয়ে যাই। রাস্তার ধার থেকে সত্তর টাকা দিয়ে দুটো ফ্রক কিনে দিই তাকে। তার মুখটা সূর্য হয়ে গেলো সাথে সাথেই।

জোছনা কে নিয়ে ঢাকা কলেজের সামনে দিয়ে আসছি। জোছনা ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে।

-স্যার,আপনে আমারে কই নেন?

-কিরে?ভাইয়া থেকে স্যার?

মেয়েটা চুপ হয়ে গেলো। আমি তাকে বললাম,'শোন,আমি তোর আপন ভাই। আজ থেকে আমাকে ভাইয়া ডাকবি আর তোর নাম জোছনা না। তোর নাম আবৃত্তি। '

ও নামের অর্থ বোঝেনি। কিন্তু খুশি হয়েছিল। তাকে নিয়ে উঠলাম আমার ছোট্ট সংসারে। নিজেকে কেমন যেন ভাগ্যবান লাগছিল। যাযাবর জীবনের অবসান হবে হয়তো।

আবৃত্তির বয়েস বারো কি তের হবে। ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে দিই তাকে। ওয়ান থেকে ফাইভের পড়াগুলো প্রতিদিন রাতে অল্প অল্প করে শিখিয়ে দিই। মেয়েটার স্মৃতিশক্তি ধারালো।

আমাদের ভাই বোনের সংসার বেশ কিছুদিনের মধ্যেই জমে উঠলো। আমরা এখন কেউই দুঃখী না। ও আমাকে দাদা বলে ডাকে।

একদিন ঘরে চাল নেই। মাসের শেষের দিকে। আমারও পকেটে কোন টাকা পয়সা নেই। আবৃত্তি বুঝতে পারলো। চৌকির নিচ থেকে একটা মাটির ব্যাংক বের করে সে আমাকে টাকা দিলো।

এক বছর কেটে গেলো। আবৃত্তির চেহারাই বদলে গেলো। সেই সাথে আমার জীবনও। আবৃত্তিকে নিয়ে আমি আস্ত একটা উপন্যাস লিখে ফেলি। এক মাসেই সেই উপন্যাস তিন বার মুদ্রণ হয়। এক পরিচালক এটা নিয়ে সিনেমা বানানোর কথাও বলেছেন। হয়তোবা আমার জীবনটা বদলে যাবে।

হ্যা,কিছুদিনের মধ্যেই আমার জীবন কিছুটা বদলে গেল। রাজধানীর নামকরা স্কুলে আমার বোনকে ভর্তি করাই আমি। নিখুঁত মেধার জন্য আমার বোন সুনাম কুড়াচ্ছে। আবৃত্তিকে নিয়ে লিখা,'বোনটি' উপন্যাসের কারণে তখন আমাকে অনেক মানুষ চিনতে শুরু করলো।

আবৃত্তি এখন ক্লাস নাইনে। আমার ঘোলাটে চোখে স্পষ্ট দেখলাম একটা ব্যাচ। 'ডাঃ আবৃত্তি '। হ্যা এটা কল্পনা ছিল। আর সেই কল্পনাকে সত্য করার জন্য আমি আমার বোনকে সাইন্সে পড়াই।

-দাদা

-হুম বল

-তুই খুব ভাল

-তুই আরো ভালো।

নতুন বই হাতে নিয়ে আমার বোন আমাকে এসব কথা বলছিল। সে যখন খুব খুশি হয় তখন সে এমন করে। আবৃত্তি জানে তাকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। আমার পড়াশোনা শেষে ছোটখাটো চাকরী করি। আর আমার বোন স্কুল করে,আমার জন্য রান্না করে। আমি বাসায় যাওয়ার আগ পর্যন্ত সে খায় না। হয়তোবা ওভাবেই খাওয়ার অপেক্ষায় ঘুমিয়ে পড়ে।

মাঝে মাঝে ভাবি, আমি হয়তোবা পৃথিবীর সুখী দের একজন। আবৃত্তির মতো একটা বোন পেয়েছি আমি। এ মেয়েটা না আসলে হয়তোবা আমার জীবন এলোমেলো হয়ে যেত। হয়তোবা আমি ওভাভেই মেসের কোনে পড়ে থাকতাম।

তিন বছরের মতো হয়ে গেলো সে আমার কাছে।এখন তার মনে নেই সে এক সময় ফুল বিক্রি করতো। এখন তার মনে নেই সে যাযাবর ছিল। আমারো এখন মনে হয়না আমি এ পৃথিবীতে একা।

একদিন সে বলছিল-

-দাদা,আমি একটা জিনিস চাইবো, দিবি?

-কি?

-একটা ভাবী।

-এখন না।

-দিবি কেন? আমি তো তোর পালক বোন।

আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। এ মেয়ে এটা কেন বললো? কথাটা বলেই সে তার ঘরে চলে গেলো। আমি আস্তে করে তার ঘরে গেলাম।তার চুলে হাত বুলিয়ে বললাম-

-কিরে?

-কিছুনা।

-তুই এটা কেন চাইলি?

-দাদা,সবাই স্কুলে মায়ের সাথে যায়। তুই তো আমাকে মা দিতে পারবি না। একটা ভাবি দে।

তার কথায় হেসে উঠলাম আমি। মেয়েটার কথায় একটু দুঃখ ও আছে। সেটা উজ্জ হয়ে গেলো।

এস এস সি পাশ করে ফেলেছে আমার বোন। আমার সবচেয়ে খুশির দিন। আমার চেষ্টায় আজ একটা মেয়ে জীবন চিনতে শিখেছে।

তার হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে আমি কেদে দিই। আমার চোখের কোনের পানি আমার বোনটা নিজ হাতে মুছে দেয়। বড় হতে হতে আমার বোনটা অনেক বদলে গেছে।আবৃত্তির ভেতর এখন আর জোছনার ছাপ নেই,আছে চাদের আলোর ছাপ। শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে সে।

আমার নিজের কষ্ট হলেও আমার বোনকে আমি অন্য দশটা মেয়ের মতো চলতে দিতাম।দামী জামা,জুতো,নেইল পালিশ কিনে দিতাম আমি। সে শুধুই অবাক হয়ে থাকতো আমার এসব দেখে।

আমার আর্থিক অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। লিখালিখির খাতিরে চাকরীর পাশাপাশি একটি পত্রিকায় সাংবাদিকতা ও করি। তবে আমার বোনকে সময় দেয়া হতো কম। সেও আমার স্বপ্ন পূরণে ব্যাস্ত। আমি তাকে বলেছিলাম,'আবৃত্তি নামের আগে ডাক্তার দেখা চাই। '

আবৃত্তি মিষ্টি হেসেছিল। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,'দাদা,তুই দেখিস,তোর বোনটা একদিন ডাক্তার হবেই। '

পাচ বছর পরঃ

একটা চায়ের দোকানে বসে আছি। হুট করে পিছন থেকে কে যেন আমার পিঠে হাত দিলো।

'ভাইয়া,ফুল ন্যাবেন ফুল?'-আমি তাকালাম। একটা মেয়ে আমাকে এভাবে বলছে। আজ থেকে চৌদ্দ বছর আগে আমাকে এটা বলেছিল আবৃত্তি। আমি কিছুই ভেবে পাচ্ছিনা। চায়ের দোকানে কেন ফুল বিক্রি করতে আসবে? আমি চারদিকে তাকালাম।

সাদা একটা গাড়ি থেকে নামলো আবৃত্তি। আমার পা ছুয়ে আমাকে সালাম করলো। পাশেই দাড়িয়ে আছে তার স্বামী। আমার বোন আজ মেডিকেল শেষ করে ফেলেছে। আমি আজ থেকে ডাক্তারের ভাই।

আবৃত্তি যখন থার্ড ইয়ারে, তখনই আমি তার বিয়ে দিই। এখন সে খুব সুখে আছে। আমার চোখের পানি আনমনেই মাটিতে পড়ে। আমার বোনটাও কেদে দেয় হুহু করে।

জিগেস করলাম,ফুল ওয়ালা মেয়েটাকে কে পাঠিয়েছে?'হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে সে বললো,'এটা তার কাজ। '

আমি পেরেছি একটি পথশিশুকে ডাক্তার বানাতে। আমি সফল। আমার জীবনে কোন দুঃখ নেই। আমি আজ সুখী।

না, সে পথশিশু নয়। সে আমার বোন। ডাঃআবৃত্তি......

০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×