প্রারম্ভিক জীবন
*************
১৯৭১ সাল। ১৬ ডিসেম্বর। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয় বাংলাদেশ। বিশ্বের বুকে রচিত হয় এক নতুন ইতিহাস। নতুন এক মানচিত্র। আর এই জয় ছিনিয়ে আনতে জীবন বাজি রেখেছিলে বেশ কয়েকজন নারী। তাদের মধ্যে একজন হলেন তারামন বেগম।
তারামন বেগম[ যিনি তারামন বিবি নামে অধিক পরিচিত]১৯৫৭ সালে কুড়িগ্রাম জেলার চর রাজিবপুর উপজেলার শংকর মাধবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।তার বাবার নাম আবদুস সোহবান এবং মায়ের নাম কুলসুম বিবি।তবে তার জন্মতারিখ জানা যায়নি।
তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর নারী মুক্তিযোদ্ধা।
স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করে।১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তার বীরত্বভূষণ নম্বর ৩৯৪। গেজেটে নাম মোছাম্মৎ তারামন বেগম।
মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা
***************
অসীম সাহসিকতার এক প্রতীক এই বীর নারী। মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজ গ্রাম কুড়িগ্রাম জেলার শংকর মাধবপুরে ছিলেন। তখন ১১ নং সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের। মুহিব হাবিলদার নামে এক মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। তখন ১৪ বছর বয়সী এক কিশোরী ছিলেন তিনি।
তারামন বিবির ভাষ্য, তখন সন্ধ্যা। রান্নার জন্য কচুরমুখি তুলছিলেন। এ সময় পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন এক মুক্তিযোদ্ধা। তার নাম মুহিব হাবিলদার। তিনি তাকে তার সঙ্গে ক্যাম্পে নিয়ে যেতে চাইলেন,রান্নার কাজের জন্য।
প্রথমে তারামনের মা কুলসুম বেওয়া এতে রাজি হন নি৷ পরে মুহিব হাবিলদার তারামনকে ধর্ম মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করেন৷ এরপরই তারামনকে দশঘরিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে রান্নার কাজে পাঠাতে রাজি হন তাঁর মা৷
ক্যাম্পে মূলত রান্নার কাজই করতেন তিনি। আর মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রগুলো মুছে পরিষ্কার করতেন। রান্নার ফাঁকে মুহিব হাবিলদার তাকে অস্ত্র চালানো শেখাতেন।
প্রথমদিকে তারামন বিবিকে রাইফেল চালানো শেখানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ছোট হওয়ায় বুকে ব্যথা পেতেন তিনি।পরে স্টেনগান চালানো শেখেন এবং সহকর্মীদের কাছ থেকে অন্যান্য অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নিয়ে তাদের সাথে অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ।এছাড়া তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর খবর সংগ্রহ করতেন।
ক্যাম্পে তিনিই ছিলেন সবার ছোট। তাই সবাই তাকে আদর করতেন।
১৯৭১ সালে একদিনের সরাসরি যুদ্ধের ঘটনা৷সময় ছিলো ঠিক মধ্য দুপুর৷ সবাই খেতে বসেছে ৷
তারামনকে পাকিস্তানি সেনাদের কেউ আসছে কি না তা দেখার জন্য বলা হলো৷ তারামন সুপারি গাছে উঠে দূরবীন দিয়ে চারিদিকে লক্ষ্য রাখছিলেন৷ হঠাৎ দেখলেন, পাক বাহিনীর একটি গানবোট তাদের দিকে আসছে৷ সবার খাওয়া বন্ধ৷ দ্রুত প্রস্তুতি নিয়ে অ্যাকশনের অপেক্ষা করতে লাগলেন সবাই৷
তারামন তাঁর সহযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধে অংশ নেন৷ দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে৷ সেদিন তারা শত্রুদের পরাস্ত করতে সক্ষম হন৷
এরপর তারামন অনেক যুদ্ধে পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অংশ নেন৷ অনেক বার তাদের ক্যাম্প পাকবাহিনী আক্রমণ করেছে,তবে ভাগ্যের জোরে তিনি প্রতিবার বেঁচে যান৷
শুধু সম্মুখ যুদ্ধই নয়৷ নানা কৌশলে শত্রু পক্ষের তৎপরতা এবং অবস্থান জানতে গুপ্তচর সেজে সোজা চলে গেছেন পাক বাহিনীর শিবিরে৷ কখনও সারা শরীরে কাদা মাটি, চক, কালি এমনকি মানুষের বিষ্ঠা পর্যন্ত লাগিয়ে পাগল সেজেছেন তারামন৷ চুল এলো করে বোবা সেজে পাক সেনাদের সামনে দীর্ঘ হাসি কিংবা কান্নার অভিনয় করেছেন৷
কখনও প্রতিবন্ধী কিংবা পঙ্গুর মতো করে চলা ফেরা করে শত্রুসেনাদের খোঁজ নিয়ে এসেছেন নদী সাঁতরে গিয়ে৷ আবার কলা গাছের ভেলা নিয়ে কখনও পাড়ি দিয়েছেন ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী৷ আর জান-মানের কথা না ভেবেই এসব দুঃসাহসী কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন একমাত্র দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য ৷
যুদ্ধ শেষে মায়ের কাছে ফিরে আসেন তারামন।
স্বাধীনতা পরবর্তী
****************
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার মুক্তিযুদ্ধে তারামন বিবিকে তার সাহসীকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য “বীর প্রতীক” উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তাকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি।
১৯৯৫ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক বিমল কান্তি দে প্রথম তার সন্ধান পান। এ কাজে বিমল কান্তিকে সহায়তা করেন কুড়িগ্রামের রাজীবপুর কলেজের অধ্যাপক আবদুস সবুর ফারুকী।
এরপর নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা কয়েকটি সংগঠন তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে। সেই সময় তাকে নিয়ে পত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি হয়। অবশেষে ১৯৯৫ সালের ১৯শে ডিসেম্বর তৎকালীন সরকার এক অনাড়ম্বর পরিবেশে আনুষ্ঠানিকভাবে তারামন বিবিকে বীরত্বের পুরস্কার তার হাতে তুলে দেন।
তারামন বিবিকে নিয়ে আনিসুল হকের লেখা ‘বীর প্রতীকের খোঁজে’ নামক একটি বই রয়েছে। আনিসুল হক রচিত ‘করিমন বেওয়া’ নামক একটি বাংলা নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন তারামন বিবি।
ব্যক্তিগত জীবন
***************
তারামন বিবির স্বামীর নাম আবদুল মজিদ। এই দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।
শেষ জীবন
***********
২০১৮ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি কুড়িগ্রামের রাজিবপুরে স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন।
দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসের সংক্রমণ, শ্বাসকষ্ট আর ডায়েবেটিসে ভুগছিলেন তারামন বিবি। বিজয়ের মাসের প্রথম প্রহরে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন রণাঙ্গনের এই মুক্তিযোদ্ধা। কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলার শংকর মাধবপুর গ্রামে নিজের বাড়িতে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর। শনিবার (১ ডিসেম্বর ২০১৮) দুপুরে রাজিবপুর উপজেলার কাচারীপাড়া তালতলা কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে দাফন করা হয়।
তথ্য সূত্রঃ
https://www.dw.com/bn/
https://lifestories.xyz/taramon-bibi-birprotik/
ও অন্যান্য
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০২০ বিকাল ৪:২৩