
মনের ভিতর নানা আশঙ্কা নিয়ে চন্দ্রাবতী দরজা খুলতে গেল। আসলে এলাকাটা খুব একটা নিরাপদ নয়। চোর ছ্যাঁচড়া আর বাজে লোকের আমদানি যথেষ্ট বেশি।
রওনক সিকদারের তাকে প্রস্তাব দিয়েছিল এই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র থাকার কিন্তু সে বাবার ভিটা ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছুক না। সেটাও সে জোর গলায় জানিয়েছিল। কারণ ছিল বৈকি। এত দিনের পুরানো এলাকা বললেই তো হুট হাট করে চলে যাওয়া যায় না।
এখন দেখছে তার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না। অন্তত এখান থেকে অনত্র চলে গেলে আনন্দ মোহন তার হদিস সহজে পেত না।
সে একলা মানুষ একা থাকে,রাত হলে তার বেশ একটু ভয় ভয়ই করে সংগতকারণে।যেহেতু সে খুব বেশি মানুষের সাথে মেশে না সেহেতু দিনে বা অন্য সময় তার কাছে তেমন কেউই আসে না আর সন্ধ্যার পরে তার কাছে কেউ আসার তো প্রশ্নই ওঠে না। এলাকায় তাঁর চরিত্র নিয়ে কোন বদনাম নেই। তবে কে এলো এখন আবার?এমনিতেই একটু আগে একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গেল।
আনন্দ মোহনের ফিরে আসাটা চন্দ্রাবতী কিছুতেই সহজভাবে মেনে নিতে পারছে না।লোভী লোকটি আবার কী কী ঝামেলা করে কে জানে সেই আশংকায় তাঁর নানা দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে।।
যদিও আপাতত তাকে বিদায় করা গেছে কোন রকমে কিন্তু ও যে আবার ফিরে আসবে না তার কোন গ্যারান্টি নেই। ইতর আর বেহায়া লোকের দ্বারা সবই সম্ভব।
চন্দ্রাবতীর বাবা গত হয়েছে বেশিদিন হয়নি মাত্র এক বছর এক মাস। এর মধ্যে সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বাবা কী জিনিস। বাবার অভাবটা কী। কত দিক যে সে কি দারুণ দক্ষতায় সামলাতো এখন সেসব ভাবলে সে অবাক হয়ে যায়।
যদিও বাবার সাথে তার সম্পর্কটা তেমন একটা মধুর ছিল না।কারণ আর কিছুই না আনন্দ মোহনের সাথে তার বিবাহ। এই নিয়ে যত অশান্তি।
তার বাবা নিজে পছন্দ করে দেখে শুনে এই জম এনে হাজির করেছে তার জীবনে। এজন্য চাপা একটা ক্ষোভ বরাবরই বয়ে গেছে তার বুকের ভিতর। বাবা কি একটু খোঁজ খবর নিতে পারতো না ঠিক ভাবে।
ভুল একটা তিনি করেছেন তবুও বাবা বাবাই, তার তুলনা কেউ হয় না। বাবা মা সবসময় বটবৃক্ষের মত। তাঁর ছায়ায় নিশ্চিতে দিন কাটানো যায়।
দরজা খোলার আগে চন্দ্রাবতী হাঁক দিল।
-এই কে?
কোন উত্তর নেই।
চন্দ্রাবতী আবার হাঁক দিলো,এই কে রে রাত দুপুরে ত্যক্ত করে?কথা বলে না কেন?
এবার উত্তর এলো,
-আমি বইন, দরওয়াজা খোলো।
চন্দ্রাবতী একটু আগে এনে রাখা বঠিটা দরজার আড়ালে রেখে আস্তে আস্তে দরজা খুলল তবে তার কাছে ভাব গতিক সুবিধার ঠেকছে না তাই সাহস করে জোড় পাল্লা মেলে ধরলো না সে। আগন্তুক যেই হোক তাকে ভিতরে ঢুকতে দেয়া যাবে না। যা দরকার বাইরে থেকে বলুক।
বাইরে প্রচন্ড অন্ধকার। অমাবশ্যার রাত। আস্তে আস্তে সাবধানে দরজা খুলে কাউকে না পেয়ে সে বেশ অবাক হলো।তাহলে কি সে ভুল শুনেছে?
শুধু সে কেন আনন্দ মোহনও তো শুনেছে কড়া নাড়ার আওয়াজ। কে যেন প্রশ্নের উত্তরও তো দিলো একটু আগে,তাহলে?
কে?
যে এসেছিল সে কী চলে গেল? কে সে? কি চায়?
হঠাৎ নড়াচড়ার আওয়াজ হলো। সেই সঙ্গে আগন্তুক কথা বলে উঠল।
-বইন আমি রে আমি। চমকাইস না।
লোকটির কথায় আশ্বস্ত হলো না চন্দ্রাবতী বরং ভীষণ রকম চমকে উঠলো সে ।
রসুল নাম লোকটির।চন্দ্রাবতী অবশ্য চেনে একে। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিলো সে।
লোকটির আসল পরিচয় হলো রওনক সিকদারের প্রতিনিধি সে। অসম্ভব কালো গায়ের রঙের জন্য তাকে এই আধারে ঠাওর করতে পারেনি চন্দ্রাবতী। বেজায় রাগ হলো তার । এই আপদ এখন কি চায় ? কিছু না বলে,দরজা লাগানোর উদ্যোগ নিতেই নড়েচড়ে কথা বলে ওঠে রসুল।
চন্দ্রাবতী বিরক্ত হয়ে বলে,
- তুমি এত রাতে?এখানে কি করছো? কি ব্যাপার?
- আমি তো কাছাকাছিই থাকি। যেতে যেতে কিছু আগে একটু হৈ চৈ এর আওয়াজ পেলাম মনে হলো তাই খোঁজ নিতে এলাম। কে এলো কি হলো?
- কই না কিছু হয়নি,সব ঠিক আছে। সমস্যা নেই কোন। তুমি এখন যাও।
-সমস্যা হলে অবশ্যই জানাতে ভুলবে না। বাবুর অর্ডার আছে।
-ঠিক আছে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমি ঠিক আছি।
-তাহলে যাই, আদাব বইন।
-আদাব।
চন্দ্রাবতী কোন রকমে দরজা লাগিয়ে ঝিম মেরে দাড়িয়ে রইলো।
শুধু ভাবতে লাগলো আনন্দ মোহন কেন ফিরে এলো তার জীবনে? লোকটি কি তাকে সারাজীবন জ্বালাবে? এর হাত থেকে তার কি কোন মুক্তি নেই? এখন সে কিভাবে আনন্দমোহনকে তার জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলবে? রসুল কি তাকে সত্যি সত্যি দেখেছে?
হঠাৎ স্নেহলতার কান্নার আওয়াজে চন্দ্রাবতী ঘরমুখো দৌড়ে গেল।
আনন্দ মোহন যে ধরনের লোক সে স্নেহলতাকে নিয়ে জল ঘোলা করবেই। ভয়টা সেখানে।এই সব নিয়ে রওনক সিকদার না আবার তাকে ভুল বোঝে। সে তো আনন্দ মোহনের কথা কিছুই জানায়নি তাকে।এটা বড় ভুল হয়ে গেছে।তার জীবনের এই অংশটুকু ইচ্ছাকৃত ভাবে লুকিয়ে ছিল সে। হঠাৎ আনন্দ মোহনের আগমন তাকে কীভাবে উপস্থাপন করবে রওনক সিকদারের কাছে এসব নিয়ে উথাল পাতাল ভাবতে লাগলো। এরকম হাড় হারামিকে কারো সামনে পরিচয় দেওয়াটাও যে লজ্জার এবং অস্বস্তিকর। কি করে বোঝাবে সে সমাজকে?
এদিকে গলির মোড়ে ঘাপটি মেরে ছিলো আনন্দ মোহন,সে কোন কিছুকে সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নয়,তাকে জানতে হবে কে এসে কড়া নাড়ে চন্দ্রাবতীর দুয়ারে ?
কি চায় সে? পার্টি কতটা টাকা পয়সার দিক থেকে মালদার। সেটাও জানতে হবে তাকে। ভাঙাতে হবে যে। নতুন শিকারের আশার তার বেজায় আনন্দ হচ্ছে। তা তা থৈ থৈ করে নাচতে ইচ্ছে করছে। হঠাৎ করে চন্দ্রাবতীর উপরে তার গভীর প্রেম অনুভব হচ্ছে।
চন্দ্রাবতী দরজা বন্ধ করা মাত্র, ঘোর অন্ধকারে চুপিচুপি রসুলের পিছু নিল আনন্দ মোহন।
তাকে অনেক কিছু জানতে হবে যে। যদিও দূরত্বের কারণে রসুল আর চন্দ্রাবতীর মধ্যে কথপোকথন সে কিছুই শুনতে পায়নি। সেজন্য বিষয়টা তার কাছে পরিষ্কার নয়। ওর সাথে চন্দ্রাবতীর সম্পর্ক কী। তবুও তার মন বলছে দারুণ কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য।
আনন্দ মোহন অনুসরণ করতে করতে ভাবলো চন্দ্রাবতীর কাছে যে মেয়েটি সে কার মেয়ে এটা আগে খোঁজ নিতে হবে? কে তার বাপ তাও জানতে হবে? দুপক্ষকে যদি ভাঙানো যায় তো কেল্লা ফতে।তবে এখনো এ যেন এক অলীক রহস্য তার কাছে।
সে কোন হিসাবই মেলাতে পারছে না সে,কিসের এত লুকোচুরি চন্দ্রাবতীর? তাকে এই লুকোচুরি ভেদ করতেই হবে। একজনের আদরের মধ্য মণি নাড়ীছেড়া ধন অন্যের কাছে মানুষ হবে।এর পিছনে কে?
কে টাকা ঢালছে।কেন টাকা ঢালছে? এ রহস্য ভেদ করতেই হবে তাকে। মাথায় দ্রুত ভাবনার ছক কষে সে। নিশ্চয়ই কোন বড় বাড়ির বড় কোন কেচ্ছা। এর পিছনে বড় কোন মালদার পার্টি অবশ্যই অবশ্যই আছে।
ভাবতে ভাবতে একটু পিছিয়ে পড়ে প্রায় হারিয়ে ফেলেছিল রসুলকে। দ্রুত চিতার গতিতে নিজেকে সামলে নিলো সে।
হয়তো আজই এই রসুলের সূত্র ধরে বড় কোন সুবিধা আদায় করা যেতেও পারে ভাগ্য তার সুপ্রসন্ন হলে। বড় বড় ঘরে বড় বড় কেচ্ছা থাকে,সেগুলো তারা সহজে প্রকাশ করতে চায় না। তার জন্য তারা লক্ষ টাকা ওড়াতেও রাজী থাকে।
এক্ষেত্রে একবার যদি শিকার গেথে ফেলতে পারে তো কেল্লা ফতে। সারাজীবন আয়েস করে কাটানো যাবে। সে নিশ্চিত চন্দ্রাবতী বড় কোন মালদার পার্টিকে হাত করেছে। এখন তাকে শুধু সেই পার্টির কাছে পৌঁছাতে হবে। পৌছাতেই হবে। যে কোন মূল্যে।
কয়েকদিন তক্কে তক্কে থেকে,নানা তৎপরতায় আনন্দ মোহন ডা.আলোকের হাসপাতাল পর্যন্ত পৌছে গেল।এবং নানা ডালপালা বেয়ে চন্দ্রাবতীর কোলে থাকা শিশুটির মাকে সে খুঁজে বের করে ফেলল। কিন্তু তার আশার গুড়ে বালি পড়লো যেন। আতঙ্কে,অবিশ্বাসে তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল।
হায়! হায়!! হায়!!!
কয়েকদিন পরে এক সকালে আনন্দ মোহন যখন চন্দ্রাবতীর উঠানে এসে দাড়ালো তখন তাঁর বিধস্ত অবস্থা দেখে চন্দ্রাবতী নিজেই তাকে চিনতে পারলো না প্রথমে ।
নারী চরিত্র স্বভাবতই মায়ায় ভরা।যতই সে বাহিরে কঠোর হোক না কেন।
বেশ কিছুটা সময় ইতস্তত করার পরে যখন সে আনন্দ মোহনকে চিনতে পারলো এবং তার অবস্থা শোচনীয় বুঝলো ,ঝটপট সে ঠিকই দৌড়ে এসে জানতে চাইলো
- কি হয়েছে তোমার? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
আনন্দ মোহন কথা কয়ে উঠলো,
-চন্দ চল আমরা এ শহর ছেড়ে পালাই। বিপদ আসছে। বিপদ। বহুদূর যেতে হবে গুছিয়ে নে।
-বিপদ? কিসের বিপদ? কি বলো তুমি? হা ভগবান!
আর কোন কথা নেই। লোকটি হয়েছে গলার কাঁটা। না পারছে গিলতে না পারছে উগরাতে।এখন আর এত উত্তেজনা তার আর ভালো লাগে না চন্দ্রাবতী। সহ্য হয় না।
হাজার প্রশ্নেও সারাটা সকাল দুপুর গোঁজ হয়ে রইলো আনন্দ মোহন।আর কোন কথা কইলো না।
কোন রকম রান্নাটুকু সেরে।স্নেহলতাকে দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে। দুপুরের কিছু পরে গোসল সেরে বাইরে বের হয়ে চন্দ্রাবতী দেখতে পেল ঘরের ভেতর দোলনায় স্নেহলতা নেই। নেই তো নেই।
কী আশ্চর্য মেয়েটি উবে গেল নাকি? তার বুকের ভিতরে ছ্যাত করে উঠলো। মাথাটা বনবনিয়ে ঘুরে উঠলো। মাথা ঘুরে সে পড়েই যাচ্ছিল কোন রকমে দেয়াল ধরে পতন ঠেকাল।
নেই তো নেই। কোথায় গেল মেয়েটা। ওই টুকু মেয়ে এখনো উবুড় হতেই পারেনা। ওর পক্ষে তো....... কোথায় হারালো..... সে?কোথায়?
চলবে
© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৪:২১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



