রসুল লোকটি রওনক সিকদারের বহু দিনের পুরাতন ভৃত্য। তাকে অবশ্য ভৃত্য না বলে সিকদার বাড়ির লাঠিয়াল বাহিনীর প্রধান বলাই ভালো।
কারণ বংশ পরম্পরায় সে, তার পিতা, প্রপিতামহ সহ অন্যান্যরা সিকদার বাড়ির পারিবারিক বিভিন্ন রকম ঝুট ঝামেলা,আদায় পত্তর, নানান রকমের ত্যাড়া ব্যাকা লোকজনদের শায়েস্তার কাজ ও সেই সাথে নিরাপত্তার ব্যাপারটি ধারাবাহিক ভাবে সামলিয়ে এসেছে দক্ষতার সাথে সুনিপুণভাবে।
সিকদার পরিবারের মুখের কথাই অত্র এলাকার আইন ছিল এক সময় । অবশ্য সেই সুসময় আর নেই। সেই মান্য গণ্যর করার লোকজনও হারিয়ে গেছে কালের অতলে দিনে দিনে। এখন যারা আছে তারা সকলেই কম বেশি যার যার এলাকায় সেই রাজা আর তাই সংগত কারণে সময়ের ব্যবধানে রসুলের কাজের পরিধিও কমে এসেছে ক্রমশ।
বর্তমানে সিকদার বাড়িতে রসুলের তেমন কোন কাজ না থাকলেও বর্গা চাষিদের কাছ থেকে আদায় পত্র, ফলের বাগান দেখাশোনা, জোড়া দীঘির তদারকি এসব টুকটাক কাজ সে স্বেচ্ছায় করে আসছে।
চিরটাকাল সে যেমন বিশ্বস্ত তেমনি করিৎকর্মা। এক কথায় তার মত বিশ্বস্ত ও যথেষ্ট করিৎকর্মা অনুচর এ যুগে দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না।
তার সঙ্গী অন্যান্যরা ভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছে ক্রমে ক্রমে কিন্তু রসুল এই পরিবারটিকে ছেড়ে যেতে পারেনি আজ অবধি।
অদৃশ্য মায়ার টানে আটকে গেছে যেন সে।
রসুলের এই যে অতিরিক্ত মাত্রার প্রভু ভক্তি ও বিশ্বস্ততা এর জন্য রওনক সিকদার তাকে বরাবরই একটু বাড়তি স্নেহ করেন ।তিনি তাকে শুধু স্নেহই করেন না তাকে বিশ্বাস ও করেন একান্ত আপন জনের মত।
সেই সুত্র ধরে তাকে নানাবিধ সুযোগ সুবিধাও প্রদান করে থাকেন নিয়মিত।এতে রসুলের প্রভু ভক্তি বেড়ে যায় আরো। বর্তমান যুগে এমন অন্ধভক্ত মানুষ পাওয়া সত্যি দুষ্কর। বিশেষ করে সে যদি হয় রসুলের মত নিঃস্বার্থ।
কয়েকদিনে বা কয়েক বছরে নয়। রসুলদের পারিবারিক এই ভক্তি ও বিশ্বস্ততা,এই পদ বংশ পরম্পরায় চলে আসছে সেই ইংরেজ রাজত্বের কোম্পানি আমল থেকে। সিকদার বাড়িই তাদের রুজি রোজগারের, বেঁচে থাকার একমাত্র আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে সেই আমল থেকেই।
কিন্তু সব সময় যে সব কিছু ঠিক ঠাক চলে বা চলেছে তাও কিন্তু না।
রসুলের অমতে বউয়ের মদতে তার বড় ছেলে কলেজে ভর্তি হলো যখন তখন কিন্তু একটু নাখোশই হয়েছিলেন রওনক সিকদার। সেই ক্ষোভের কথা জানাতেও দ্বিধা করেনি রওনক সিকদার। রসুলও ভয়ে ভয়ে তার অপারগতার কথা জানিয়েছে কড়জোরে। কারণ ছেলেরা বুঝতে শিখেছে। যুগও পাল্টেছে। দাসত্ব করার মনোবৃত্তি থেকে মুক্তির পথ খুঁজে নিয়েছে শিক্ষাকে অবলম্বণ করে তারা সেখানে তার মতামতের কোন গুরুত্ব নেই।
সময়ের সাথে খুব দ্রুত নিজেকে পাল্টে ফেলা রওনক সিকদারের একটি অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তিনিও বুঝে গিয়েছিলেন রসুলদের পরবর্তী প্রজন্মকে তিনি আর হাতের মুঠোয় আনতে পারবেন না। তাই চুপচাপ মেনে নিয়েছেন সব।
বর্তমানে সিকদার বংশের আগের মত সেই দৌদন্ড প্রতাপ,একচ্ছত্র প্রভাব প্রতিপত্তি নেই আর।জমি জমাও কমে এসেছে অনেকটা বিভিন্ন
জটিলতায়,বড় বড় কয়েকটা বাওড় হারিয়েছেন সম্প্রতি তিনি। সরকারের সাথে মামলায় হেরেছেন গো হারা তাও বেশি দিন আগের কথা নয়। সেখানে নগদে অনেক লস।
মানুষ এখন অনেক অনেক সচেতন আর তাই নতুন করে জমি জমা বৃদ্ধির সম্ভাবনাও এখন আর নেই সংগত কারণে । পারিবারিক ব্যবসায়ই এখন যা ভরসা। ওই ঘটনার পর থেকে তিনি রসুলের ছেলেদের প্রসঙ্গে আর কোন কথাই বলেন নি কোনদিন। রসুলও নিজে থেকে সামনে আনে না বউ ছেলেদের কথা। তার দিনও ফুরিয়েছে যে। কি দরকার অশান্তি করার। যার যেমন ভালো লাগে সে তেমন থাক।
যাহোক বর্তমানে সেই রসুলের কাজ হচ্ছে চন্দ্রাবতীর দেখ ভাল করা। মূল উদ্দেশ্য অবশ্যই স্নেহলতার খোঁজ খবর রাখা।
চন্দ্রাবতী কোথায় যায় বা না যায়, কার সাথে কথা বলে বা মেশে সব খবর তার নখদর্পনে রাখে সে তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই দুরত্ব বজায় রাখে এবং গোপনীয়তা বজায় রাখে। আর সেটাই নির্দেশ দেওয়া আছে।
রওনক সিকদারের কাছে সব খবরই পৌঁছে যায় সময় মত। সিকদার সাহেবও খুশি তার কাজে।
সেই সাথে চন্দ্রাবতী যেহেতু এখনও যুবতী। তো তাকেও যেন কেউ ঝামেলায় না ফেলে সেটিও দেখ ভাল করতে নির্দেশ দিয়েছেন সিকদার সাহেব রসুলকে।
এ সমাজ একা একটি মেয়েকে কখনোই ভালো থাকতে দেয় না। পদে পদে স্বাপদেরা হানা দিতে চায় তার দুয়ারে । তাকে ছিড়ে খেতে চায় ,সুযোগ নিতে চায় নানা রকম। রওনক সিকদার তা ভালো করেই জানেন। তিনি এটা বুঝতে পেরেছেন চন্দ্রাবতী ভালো থাকলে স্নেহ লতা ভালো থাকবে। নতুবা নয়।
আজ সকাল থেকে রসুল আজমত মোল্লার গোডাউনের উপরে বসে জোরে হাত পাখা ঘুরাচ্ছে। দারুণ গরমের সময় এখন। ক্ষণে ক্ষণে পানি পিপাসা পাচ্ছে তাই।সূর্য মনে হয় মনের হর্ষে উত্তাপ ছড়াচ্ছে ঠিক দুপুরে। অসহ্য গরম।
আলসেমিতে হাই তুলতে তুলতে হঠাৎ সে দেখতে পায় সেই অচেনা লোকটি পেছনের দরজা দিয়ে আবার ও চন্দ্রাবতীর বাড়িতে ঢুকছে। রসুল নড়েচড়ে বসে। ব্যপারটা সুবিধের না। কি হচ্ছে কি ওখানে? এখনি নিচে নামতে হবে। সে তৎপর হয়ে ওঠে।
চন্দ্রাবতী যে কিছু একটা লুকাচ্ছে তা ভালো মত বুঝতে পেরেছে রসুল এ ক’দিনে এবং গতদিন এ ব্যাপারে সিকদার সাহেবের সাথেও তার কথাও হয়েছে।
সিকদার সাহেব তেমন কিছু বলেন নি। শুধু শুনেছেন আর গড়গড়া হাতে মাথা নাড়িয়েছেন।
তারপর উঠে একটু পায়চারী করে আবার সস্থানে বসে খানিক গড়গড়া টেনে নিয়ে চোখ বুজেছেন নিলিপ্ততার সাথে। ঘুমিয়েছেন কি কিছু ভাবছেন তা অবশ্য রসুল বুঝতে পারছিলো না সে সময়। এদিকে আবার পরবর্তী নির্দেশ না আসা অবধি সে সেখান থেকে উঠতেও পারছিলো না।
অনেকটা পরে সিকদার সাহেব যখন চোখ মেললেন।তখন তিনি নিচু স্বরে চন্দ্রাবতীর অতীত বর্তমানের সমস্ত খবর সংগ্রহ করার নির্দেশ দিলেন।
হুট করে অজানা একটি মেয়েকে বিশ্বাস করা ঠিক হলো কি না সময়ই বলে দেবে সে কথা। কারণ ভবিতব্যের উপর কারো হাত নেই। তবে এখন চন্দ্রাবতীর সম্পর্কে পুরো পুরি জানা অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে তার কাছে।
রসুলের কর্মতৎপরতা সব সময় ক্ষিপ্র গতির। সে তড়িৎ গতিতে খোঁজ লাগিয়ে আনন্দ মোহনের নাম জেনে নিয়েছে এবং এটাও জেনেছে যে লোকটি চন্দ্রাবতীর স্বামী।
সিকদার সাহেব যখন সব কিছু জানলেন তখন বেশ একটু চিন্তিতই হলেন।
চন্দ্রাবতীকে তিনি বিশ্বাস করেছিলেন। তবে কেন সে তার বিবাহিত জীবন সম্পর্কে কিছু তথ্য লুকাল। চন্দ্রাবতী তাকে জানিয়েছিল তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছে অথচ সেই চলে যাওয়া স্বামী ফিরে আসাতে কোন তথ্যই সে জানায়নি বরং গোপন করেছে কিন্তু কেন?
যাহোক, অচেনা একটা লোক যে এই বাড়িতে হুটহাট করে ঢুকে পড়ছে । যদিও সে চন্দ্রাবতীর স্বামী তবুও তার আচরণ অপরাধীর মত।
কিছু তো একটা রহস্য আছেই। কী রহস্য?
রসুল হঠাৎ দেখল যে স্নেহলতাকে আনন্দ মোহন কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে। প্রাথমিক অবস্থায় বিস্মিত হলেও রসুল দ্রুত তার পিছু নিল । রসুলের মন বলছে স্নেহলতা বিপদে পড়তে যাচ্ছে। আর এসময় কোথায় চন্দ্রাবতী? তাকে তো দেখা যাচ্ছে না।
কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আনন্দ মোহন স্নেহলতাকে? তাকে যে কোন মূল্যে আটকাতে হবে।
এদিকে চন্দ্রাবতী সোজা বড় ঘরে উকি দিল এবং নিশ্চিত হল স্নেহ লতাকে কেউ সরিয়েছে। হঠাৎ করে তার হাত পা অবশ হয়ে এলো তার মাথা ঘুরতে লাগলো। কি করবে সে এখন? কি উত্তর দেবে সে রওনক সিকদারকে।
রওনক সিকদার কি তাকে পুলিশে দেবেন। তাকে কি সারা জীবন দায়িত্ব অবহেলার জন্য জেলের ঘানি টানতে হবে?
কি করা উচিত আর কি করা উচিত নয় তার মাথায় আর কোন কাজ করছে না। সে ঘোর লাগা মানুষের মত হাঁটতে লাগলো। তার ঘরের দুয়ার হাট হয়ে খোলা রইলো সেদিকে খেয়াল করলো না।
উল্টোপথে অনেক জোরে হাঁটছে আনন্দমোহন। রসুলও তার পিছু । বেশ খানিকবাদে আনন্দ মোহন বুঝলো কেউ তার পিছু নিয়েছে। সে একটা গলি পথ ধরলো সুযোগ বুঝে। খানিক চলল চোর পুলিশের খেলা। প্রচন্ড রোদে অনেকটা ঘুরে হঠাৎ রসুল খেই হারিয়ে ফেলল। আনন্দ মোহন পগার পার।
বেশ কিছুটা বাদে ঘুম ভেঙে স্নেহলতা কেঁদে উঠতেই আনন্দমোহন যেন বিপদ বুঝতে পারলো। সে একটা ময়লা আবর্জনার স্তুপে স্নেহলতাকে ছুড়ে ফেলে দিল। এবং নিজে ছুট লাগালো দিক বিদিক।ততক্ষণে স্নেহলতাকে ঘিরে ধরেছে দুটি কুকুর। তার শরীর মাখামাখি দুগন্ধযুক্ত বিষ্ঠাতে। কুকুরে যে বিষ্ঠা বড্ড প্রিয়। তারা স্নেহলতার পরণের কাপড় ধরে টানাটানি করতে লাগলো। আতঙ্কে নিষ্ঠুরতায় স্নেহলতা তীব্র স্বরে কাঁদতে লাগলো। কে তাতে বাঁচাবে? কেউ কি আছে?
এদিকে ঘোর লাগা অবস্থায় চন্দ্রাবতী গিয়ে উঠলো ডা. আলোকের হাসপাতালে। তার আলুথালু বেশ দেখে ডা আলোক চমকে উঠলেন। তিনি প্রথমেই জানতে চাইলেন
-স্নেহলতা কোথায়?
চন্দ্রাবতী কিছু বলার আগেই অজ্ঞান হয়ে গেল।
চলবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জানুয়ারি, ২০২৩ রাত ৯:০৬