ছোটবেলা যখন ঢাকার মোহাম্মদপুরের শের শাহ শুরি রোডে থাকতাম তখন শবেবরাত এর দিনটা এখনকার মত এমন ছিল না। বেশ উৎসব মূখর পরিবেশ ছিল তখন।
শবে বরাতের বেশ কদিন আগে থাকতেই আম্মা বাজার থেকে হালুয়া তৈরির উপকরণ সংগ্রহ করতে শুরু করতেন বাসার কাজের সাহায্যকারী ইসমাইল ভাইয়াকে দিয়ে ।
এখানকার মতো তখনও শবে বরাত বা রোজা আসার আগ থেকে জিনিসপত্রের দাম বাড়া শুরু হতো।
চিনি, ছোলার ডাল, ঘি, সুজি, ময়দা,গুঁড়ো দুধ, পোলাওয়ের চাল, কিসমিস, বাদাম আর গ্রাম থেকে আসা চালের গুঁড়া সংগ্রহ শেষে সেগুলো কৌটায় গুছিয়ে তোলা হতো।
শহরের আটা ভাঙানো মিল থেকে যদিও চাল গুঁড়া করা যেত কিন্তু সেই গুঁড়াতে রুটি ভালো হতো না।কেন জানি ফেটে যেতো। ঢেঁকি ছাটা চালের গুড়ায় নাকি রুটিটা ভালো হয়। আমি অত সত না বুঝলেও মা বলতেন তাই জানি আর কি।
তো প্রথমে ছোলার ডাল কেনার পর ঝেড়ে বেছে রোদে দেওয়া হতো। সুজি ও বেছে খুঁটে পরিষ্কার করা হতো কারণ অনেক সময় সুজির ভিতর ছোট ছোট পোকা হয় সেই কারণে সম্ভবত।
ময়দা টুকনি দিয়ে ভালো করে টুকে নেওয়া হতো ময়দার হালুয়ার জন্য। এগুলো সব আম্মা নিজ হাতেই করতেন। আমি বসে বসে দেখতাম।কারণ খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সবসময় ই আমার কাছে প্রিয়।
যাহোক তারপর শবেবরাতের আগের রাতে আম্মা ডাল ভিজিয়ে রাখতেন এবং উঠতেন প্রায় মধ্য রাতে।প্রেশার কুকারে এমন ভাবে সিদ্ধ করা হতো ছোলার ডাল তাতে শিল পাটায় আর বাটা লাগতো না। এরপর শুরু হতো নানা পদের হালুয়া তৈরির কাজ।
ছোলার ডালের বরফি,সুজির কয়েক পদ হালুয়া, ডিমেরও কয়েক পদ হালুয়া সহ আরও নানা রকম হালুয়া।
সকালের কিছু পর থেকে অনেক মানুষ আসতো হালুয়া রুটি নিতে।এই রুটি বিলানো দায়িত্ব ছিল আমার।
ভিতর বাহির করতাম আমি সানন্দেই।
একেক জনের হাতে বেশ বড় সড় হালুয়া রুটির প্যাকেট দেখে অবাক হতাম। এত রুটি ওরা কি করতো তা রহস্য হিসাবে ছিল অনেক দিন পর্যন্ত । একদিন শবেবরাতের পরের দিন এক বন্ধুর বাসায় গেছি। ছাদে উঠে খেলা করছি এমন সময় পাশের বস্তিতে চোখ পড়তে দেখি হাজার হাজার রুটি। সব রুটি তাদের ছোট ছোট টিনের ছাদে সারি বেঁধে বিছানো।আসলে এগুলো দীর্ঘ দিন সংরক্ষণের জন্য রোদে শুকাবার পদ্ধতি । পরে শুনেছি অনেকে এই শুকনো রুটি পাপড় হিসাবে ভেজে খেতো।
যাহোক শবেবরাতের বিকালবেলাটাও আমার ভীষণ ব্যস্ততায় কাটতো। সারা পাড়ায় ট্রেতে করে নানা পদের হালুয়া আর রুটি বিলাতে বের হতাম।অন্যরাও আমাদের বাসায় দিয়ে যেত সমানতালে। সেই সময় অবশ্য আমার বাড়ির আশেপাশের বন্ধুরা ততক্ষণে পটকা বাজি ফোটানো শুরু করে দিয়েছে। পটকা বাজি শবেবরাতের বেশ কদিন আগে থেকেই ফোটানোর চল ছিল। শবেবরাতের রাতে আমরা তারাবাজি জ্বালাতাম। পটকা বাজি আমাদের বাড়িতে নিষিদ্ধ ছিল। অন্যান্যরা মুররা ( এক প্রকার চলমান বাজি যা বেশ ক্ষতিকর,কখনও কখনও আগুন লেগে যেত বা কারো লুঙ্গিতে ঢুকে পা, কাপড় পুড়িয়ে দিতো) ও নানারকম বাজি ফুটাতো।আমরা ওসব থেকে দুরে থাকতাম।
সন্ধ্যায় বড়রা কেউ কেউ গোসল করতেন। তারপর মাগরিবের নামাজ আদায় পর্ব। নামাজের পরে মাংস আর রুটি খেতাম খুব মজা করে। তারপর মিলতো একটু স্বাধীনতা তবে কড়া নির্দেশও দেওয়া থাকতো সেই সাথে। কোন বাজে রিপোর্ট আসলে তার খবর হয়ে যেত। আমরা বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন মসজিদে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তাম। নানা গল্প আর মজাও করতাম। এদিকে ওদিকে ঘোরাঘুরি করতাম যা অন্য দিন ছিল কল্পনার অতীত।তবে রাত বারোটার আগে বাসায় ফিরতে হতোই।
বাসায় ফিরে দেখতাম আম্মা নামাজে আমি তাঁর নামাজের পাটির পাশে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে একসময় ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যেতাম।
যখন চোখ মেলতাম তখন দেখতাম সকাল হয়ে গেছে। বাড়ির প্রায় সকলে তখনও ঘুমিয়ে। জানালা দিয়ে বাইরে দেখতাম। ফাঁকা রাস্তা দেখে অন্য রকম অনুভূতি কাজ করতো।
© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০২২ সকাল ১০:২৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




