প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া জন্য মহী রায়চৌধুরীদের পরিত্যক্ত বাড়ির ঘন গাছগাছালিতে ভরা ঝোপ জঙ্গলের ভিতর ঢুকলো।হঠাৎ ক্ষীণস্বরে গোঙানির আওয়াজ কানে এলো তার।অল্প সময়ে শব্দের উৎসস্থল নির্ণয় করা গেলেও ঘন পাতার আড়ালে ব্যপারটা ঠিক কি হচ্ছে খুব একটা ঠাওর করতে পারলো না ভোরের আবছা অন্ধকারের কারণে।কিছু পাতা সরিয়ে ভালো করে চাইতেই দেখলো, কি যেন একটা নড়াচড়া করছে আর সেই সাথে করুণ সুরে কাতরাচ্ছে।কাতরানি অবশ্য অল্পক্ষণের মধ্যে থেমে গেল। দেহটি নিথর হওয়া আগে একবার ঝটপট করেই চিরকালের মত নিশ্চল হয়ে গেল।মহী নিজের অজান্তে বলে উঠলো,
-হায় আল্লাহ একি অবস্থা ?
জায়গাটা নিরিবিলি আর ঘন ঝোপঝাড়ে আচ্ছাদিত বলে ভোরের এই সময়টা সে প্রায় প্রতিদিন প্রাকৃতিক কাজ সারতে এদিকটায় আসে।হাতের পানির বদনাটা রেখে আরো ভালো করে উঁকি মারতেই মহী থমকে গেলো এবং সাথে সাথে চিনতে পারলো মৃত দেহটিকে দেখে।
-কি আশ্চর্য এতো পাতুরি! পাতুরি কি করে এখানে এলো? আর ওর এই অবস্থাই বা কি করে হলো? কে করেছে ওর এই সর্বনাশ?
প্রথম অবস্থায় মহী ভাবলো গগন বিদারী এক চিৎকার দেবে। কিন্তু কেন জানি তার নিজের কণ্ঠ নিজের সাথেই বেইমানী করলো।সে দুই একবার গলায় হাত বুলালো,সমস্যা কি বোঝার জন্য ।না সেখান দিয়ে কোন শব্দ ই বের হলো না। তার কেন জানি মনে হলো মৃত পাতুরির ভূত তার উপর আছর হয়েছে।অপঘাতে মৃত্যু সংক্রান্ত অনেক গাল গল্প চালু আছে তাদের এলাকায়। দুনিয়ায় আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে তার আতঙ্ক বেড়ে গেলো।
এক সময় কি না কি ভেবে সে উদভ্রান্তের মতো দৌড় লাগালো গাঁয়ের দিকে। মুখ দিয়ে গোঙরানি মতো আওয়াজ করে হাত নাড়তে লাগলো পথ চলতি লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টায়।
আশ্চর্য লোকজন তাকে সেভাবে খেয়ালই করছে না।
যদিও ভোর, ধান কাটার সীজন বলে দলবেঁধে লোকজনের আনাগোনা চলছেই।তারা মহীর দিকে তাকাচ্ছে বটে কিন্তু সাড়া দেবার প্রয়োজন বোধ করছে না।বরং মহীর কার্যক্রমে অনেকেই বিরক্ত ।পাশের মসজিদ থেকে হোসেন আলী বেরিয়ে এলো নামাজ পড়ে,উৎসুক হয়ে কিছুটা শুনে বিরক্ত হয়ে ধমকে উঠলো
-কি কও মিয়া ? ঠিক কইরা কও এমন করতাছো কেন?কি? ওইদিকে কি দেখাও? কি হইছে? কি বল কিছু ই তো বুঝি না।
জামাল মহীর ছোটবেলার বন্ধু সে জটলার মধ্য থেকে মহীকে সরিয়ে নিয়ে রাস্তার পাশের চায়ের দোকানের বেঞ্চে নিয়ে বসালো।মহীর আচরণে সেও কিছুটা বিভ্রান্ত কি বুঝলো কে জানে! প্রথমে মহীর মাথায় একটু পানি দিলো।চোখ মুখ ধুইয়ে দিলো যত্ন করে ।
কিছুটা ধাতস্থ হয়ে মহী অস্ফুস্ট স্বরে বলল,
-লাশ! লাশ!! লাশ!!!
-লাশ? সমস্বরে ধ্বণিত হলো । উপস্থিত সকলেই এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। আরও কিছু মানুষ আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এলো।
-কি কও মিয়া? আবার কি মাথা গরম হইছে নি তোমার?
জামাল বলল,
-লাশ কোনহানে দেখছোস রে মহী ?
-উত্তর পাড়ার রায়চৌধুরীগো জঙ্গলে।
খুন খারাবির ঘটনা এ গ্রামে কেন এ তল্লাটে কেউ কোনদিন শোনে নি।নিপাট নিরীহ কৃষিজীবি মানুষের বাস এলাকাটিতে।কি আশ্চর্য ,এখানে কে কাকে খুন করবে?সে রকম তো কিছু শোনা যায় নি কোনদিন? খুব তাড়াতাড়ি ছোটখাটো একটা দল চলল উত্তর পাড়ার জঙ্গলের দিকে।যদিও মহীকে তারা খুব একটা বিশ্বাস করছে না।মহীকে তারা আধ পাগলা বলেই জানে।মাঝেমাঝে বেশি গরম পড়লে মহীর মাথার ব্যামো চাঙান দেয় তবু লাশ বলে কথা..
আজিজ মাষ্টার তার কোচিং সেন্টারে এই পথ দিয়েই যাচ্ছিলো।সে হঠাৎ থেমে দাড়ায়।এতোগুলো লোকের জটলা দেখে সেও খানিক উৎসাহী হয়। কি হয়েছে জানতে সেও এদের পিছু নেয়।
আলো অনেকটা ফুটে গেছে,মাঠের কাজে বের হওয়া বেশ কিছু লোক কাজ বাদ দিয়ে অতি উৎসাহী হয়ে দলটিকে আরো ভারি করে ফেলল তাড়াতাড়িই ।
কিন্তু ঘটনার জায়গার কাছাকাছি আসতেই সবাই কেন জানি আর এগুতে চাইলো না। সম্ভবত অন্য রকম এক ধরনের ভয় কাজ করছে সবার মধ্যে ।
মৃতদেহ জঙ্গল এসবে এখনও অভ্যাস্থ নয় গ্রামবাসীরা।তবে জামাল এগিয়ে গেল মহীর দেখানো পথে তারপর সেও আর্ত কন্ঠে চিৎকার করে উঠলো,
- হায় আল্লাহ এতো পাতুরি। এরে কেডায় এই অবস্থা করছে।
পাতুরির নাম শুনে আজিজ মাষ্টার এগিয়ে গিয়ে দৃশ্যটি দেখে এবং পিছু হটে আসে। আসলে হত্যাকান্ডটি সেই ঘটিয়েছে। কাজটা করতে অবশ্য তার বেশি সময় লাগে নি।
আজ ভোর রাতে ঘুম থেকে উঠে কোচিং সেন্টারে যাবে বলে টয়লেট ও অন্যান্য কাজ সেরে নেবার উদ্দেশ্যে বারান্দায় পা দিয়েছে ঠিক তখনই জানালা দিয়ে দেখে পাতুরি আরাম করে ঘুমিয়ে আছে।মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না।যেই ভাবা সেই কাজ। সোজা সজোরে এক বাড়ি কষিয়ে দিল পাতুরির মাথা বরাবর।অনেক দিনের রাগ মুহুর্তে পানি হলো বটে।কিন্তু চুন্নি চোরা এখানে এলো কি করে কে জানে? কি পরিস্থিতিতে সে এই কাজ করতে সে বাধ্য হয়েছে সে কথা কাকে বলবে কেমন করে?তার চেয়ে দোষ স্বীকার না করে ঝামেলা এড়িয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। দেরি হয়ে যাচ্ছে অনেক কাজ করতে হবে আজিজ মাষ্টার পাতুরির কথা আর না ভেবে নিজের কাজে হাঁটা দিল।
(২)
রমজান ব্যপারীর বাড়িতে মড়া কান্না লেগে গেছে। সাত সকালে পাতুরির অকাল মৃত্যুর খবর এসে পৌঁছে গেছে নিমেষে ।সোহেলীর অনেক সাধের ছিল পাতুরি দিয়ারও অনেক আদরের ,সেই এইটুকু কাল থেকে তিল তিল করে পেলে পুষে বড় করেছে পাতুরিকে দুই বোন মিলে।কত ঘটনা কত স্মৃতি নিজের হাতে পেলে পুষে বড় করার কারণে মায়াটা বেশি হওয়াই স্বাভাবিক ।কোন হারামজাদা করলো এমন ক্ষতি কাজ আল্লাহ জানে? তার বুক কি একটুও কাঁপলো না? এমন নির্দয় কি করে হয় মানুষ? সোহেলী বিলাপ করে কাঁদে আর বলে
- আল্লাহ তুমি হের মাথায় ঠাঠা ফেইলো। আমার পাতুরিরে যেমন মাথা ফাটাইয়া মারছে ওর মাথাও ফাটাইয়া দাও আল্লাহ।
জয়নব বিবি বারান্দার চৌকিতে শুয়ে শুয়ে সব দেখতে পারছেন।এসব রং তামাশা দেখলে তার রাগে গা পিত্তি জ্বলে যায়।
স্বভাবতই পুতনিদের এসব আজাইড়া কাজ দেখে সে রাগে গজ গজ করছে। তার এইসব আদিখ্যেতা একদম ই পছন্দ নয়। ছেলে ছেলের বউ এর ভয়ে পুতনিকে খুব একটা ঘাটায় না সে।তবুও আজ কিছু একটা না বলে পারলো না আর।
- অভ্যাস ভালো হলে কেউ কি আর এমন কইরে মাইরা ফালাইতো।আল্লাহর মাইর দুনিয়ায় বাইড়। দিন নাই রাত নাই মাইনষের বাড়ি হান্দাইয়া মাছ দুধ মাংস চুরি কইরা খাইলে এমনই হয়। অভিশাপ দিলে কি হইবো? লাগাবো না। ঠাঠা পড়ন কি মুখের কথা।যা হইছে ঠিক হইছে আপদ বিদায় হইছে।
সোহেলী চিড়বিড়িয়ে ঝামটা মেরে ওঠে
-খবরদার বুড়ি তুমি আমার পাতুরিরে লইয়া একটাও কথা কইবা না।আইলে কইলাম মুখ টিইপ্যা ধরুমনে।
- উ...মাইয়ার তেজ দেখ। একটা বিলাইয়ের লাইগা বেডির পরান ফাটে।এদিকে আমি বুইড়া মানুষ, কত অসুখ বিসুখ হয় কই আমার তো কেন খোঁজই রাখোস না।বেইমানের ঘরে বেইমান কোনহানকার।আমার চাইতে তর কাছে বিলাইডা বড় হইলো?
কি করে বোঝায় সোহেলী এই নির্বোধ বুড়িকে বিড়ালটা সোহেলীর জান ছিল। আহারে!
© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০২২ বিকাল ৪:৪১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



