মধ্যরাতে চাপা অস্বস্তি নিয়ে মিলির ঘুম ভেঙে গেল।আতঙ্ক নিয়ে চোখ মেলল কিন্তু তেমন কিছু লাভ হলো না। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেল না সে।একটু থিতু হতে মিলি অনুভব করলো তার সারা শরীর ঘামে ভেজা।মনে হচ্ছে কে যেন একটু আগে তার গলা টিপে ধরেছিল।সেজন্যই হয়তো সে শ্বাস নিতে পারছিল না।মনে হচ্ছিল এখনই মরে যাবে।এখনই।
বুকের মধ্যে এখনও আনচান আনচান ব্যাথা করছে। মিলি ঢোক গেলার চেষ্টা করলো।গলা শুকনো কাঠ।খুব পানি পিপাসা পেয়েছে।অন্ধকারের মধ্যে সে এদিক ওদিক তাকালো,যদি একটু পানি পাওয়া যায় ।এখন খানিকটা চোখ সয়ে এসেছে কিন্তু কাছাকাছি কোথাও পানি নেই।পানি খাওয়ার একমাত্র উপায় একা একা উঠে কল তলায় যেতে হবে কিন্তু মিলির ভয় লাগছে।হাতটা যদি আবার এগিয়ে আসে তার দিকে।তখন?
সে থম মেরে বসে রইলো কিছুক্ষণ একটু থিতু হতে মন কেমন করতে লাগলো । মা'র কথা মনে পড়ছে মা'কে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। কতদিন মাকে দেখে না সে। কিন্তু সমস্যা হল এখন মধ্যরাত।মা'তো থাকে সেই দুর গায়ে।তাকে সকাল অবধি অপেক্ষা করতেই হবে।
কেমন একটা অভিমান এসে গলার কাছটায় দলা হলো। মিলি সিঁড়ি তলায় এই ঘন ঘোর অন্ধকারে বসে একা একা নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো।
কেঁদে কেটে মন একটু হালকা হলে সে ঠিক করলো ভোরের আলো ফুটলে মায়ের সাথে দেখা করতে যাবে।যদিও কড়া নিষেধ আছে তবুও সে যাবে।
তারপরও কি দেখা হবে মায়ের সাথে? না হবে না।মা নিজে থেকে না এলে আর কখনও দেখা হবে না।আচ্ছা মায়ের কি তার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে হয় না?
হবে কি করে! জীবন্মৃত মা যে তার জনম দুঃখীনি। বুকের মধ্যে চাপা ব্যাথাটা ক্রমশ বাড়ছে মিলি কি দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে! সে গলায় আলতো করে হাত বুলালো তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কি সব বলতে লাগলো।
তার সব অভিযোগ ওই ওপরওয়ালার কাছেই।তার যে আপন বলতে কেউ নেই।
একসময় ভোরের আলো ফুটল। একটা একটা করে পাখি জেগে উঠলো পূর্ব আকাশ রঙ ছড়ালো।মৃদু বাতাস আন্দোলিত হলো।
মিলির ভীষণ ইচ্ছে করে এই ভোরের বেলায় পায়ে শিশির লাগিয়ে মার হাত ধরে হাঁটতে। হাঁটতে হাঁটতে খোলা মাঠের শিশির জড়ানো ঘাসে পা ডুবাতে আর দুষ্টুমি করতে।
ইচ্ছে হয় তার ভীষণ ইচ্ছে হয়।তবে তার ইচ্ছেগুলো সব মরে গেছে আজকাল । প্রতিবন্দী মেয়ের আবার ইচ্ছে অনিচ্ছে কি? মায়ে তাড়ানো বাপে খেদানো বাচ্চাদের কোন সাধ আহ্লাদ থাকতে নেই।
ঘোষ বাড়ির বড় শিউলি ফুল গাছটা মিলির অত্যন্ত প্রিয়। তার তলায় চোখ বুজে দু'হাত বাড়িয়ে দাঁড়াতে মিলির অনেক দিনের সাধ, টুপটাপ ঝরে পড়া শিউলির আদর মাখতেও খুব সাধ।ঝরা শিউলি কোচ ভরে কুড়াতেও সাধ । মন চাইলেই কি আর সব সাধ পূরণ হয়? হয় না।
তার যে অনেক কাজ। হোক কাজ হোক অগুনিত দায়িত্ব। সব ফেলে আজ সে মায়ের কাছে যাবেই।
ভোরের আলো ফুটতে মিলি একাই পথ চলল। রোদ চড়ে যাবার আগে পৌঁছাতে হবে। তার কাছে ভ্যান ভাড়ার টাকা নেই তবে হাঁটা পথের শর্টকাট চেনা আছে। ধানি জমির আল পথ ধরে এগিয়ে যায় সে। শুনেছে মায়ের ভীষণ শরীর খারাপ হয়েছে। মিলি অবশ্য জানতো না।গতকাল ই রসুল কাকার কাছে শুনেছে। এখন কি করছে মা? জ্বর হলে কি মা তার কথা মনে করে কাঁদে? যেমন সে কাঁদে মা মা করে। এক জীবন মায়ের কাছ থেকে কত কিছুই জানার ছিল।কত ভালোবাসা নেবার ছিল।কিছুই তো হলো না। বিধাতা কেন সামান্য এটুকু ইচ্ছে পূরণে বাঁধ সাধলেন? কেন?
© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০২২ বিকাল ৫:১৩