অপূর্ব আর আমি মোহাম্মদপুর বয়েজ হাইস্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণিতে একই দিনে ভর্তি হয়েছিলাম।
প্রথম দিন ক্লাসে বসেছিলামও পাশাপাশি। সেই সূত্রে কি-না জানি না তবে আমাদের বন্ধুত্ব হতে সময় লাগেনি।
অপূর্ব বেশ লাজুক আর অন্তর্মুখী স্বভাবের ছেলে ছিল। কথাবার্তায় মেয়েলী ভাব প্রবল হলেও চমৎকার একটি মানবিক মন ছিল ওর। মেয়েদের কিছু নিজস্ব আচরণ আছে সেগুলো ওরমধ্যে প্রবলভাবে বিদ্যমান ছিল। তবে ওর চমৎকারিত্ব ছিল ওর মিষ্টি হাসি।খুব হাসিখুশি ছিল সে।আর খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারতো।পড়াশোনায় আহামরি না হলেও রিড়িং পড়তো খুব সুন্দর করে।
স্কুলে ভর্তি হবার কিছু দিনের মধ্যে ও বিশেষ কিছু ছেলের নজরে পড়ে যায়। তারা ওকে হাফ লেডিস,হিজড়া ইত্যাদি নামে বিশেষায়িত করে মজা নিতো। কখনও কখনও গায়ে হাত দিতো।
স্যারদের কাছে নালিশের ফল খারাপ হতে পারে সেই আশংকায় ও সেই পথ মাড়াতে চাইতো না কারণ ওর অতীত অভিজ্ঞতা সেরম সুবিধার ছিল না কিন্তু ক্রমশ ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যেতে লাগলো।
এসব নিয়ে ওর অনুভূতি কেমন ছিল জানা ছিল না তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার ভীষণ খারাপ লাগতো।মানুষের ভাষা এত নোংরা হবে কেন?আচরণ এত কুৎসিত হবে কেন?
কোন এক অজানা কারণে অপূর্ব প্রতিবাদ না করলেও আমি প্রায় প্রতিবাদ করতাম। এর জন্য কখনও কখনও আমাকেও নানাভাবে অপদস্ত হতে হতো।নোংরা কথা শুনতে হতো।
আমি একদিন ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম
- ওরা যে তোর সাথে এমন করে তোর খারাপ লাগে না?
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বিষন্ন চিত্তে অপূর্ব উত্তর দিয়েছিল
- খুব খারাপ লাগে ।মাঝে মাঝে মরে যেতে ইচ্ছে করে কিন্তু আমি জানি আমি ওদের সাথে পারবো না। আগের স্কুল থেকে তো এই জন্য চলে এসেছি।আব্বা বলেছে এবার কোন ঝামেলা হলে আমার পড়াশোনা বন্ধ করে দেবেন। কি করবো বল? আমি যে কোন মূল্যে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই। আমি বড় হতে চাই।
আমি ওকে কিছু উপদেশ দিলাম বললাম
- তুই এভাবে কোমর দুলিয়ে হাঁটবি না। আমি যেভাবে হাঁটি এমন করে হাঁটবি।কথা বলার সময় হাত এভাবে বাকাবি না....
- চেষ্টা করি তো। আব্বু আম্মুর কাছে কত বকা খাই এজন্য । কি করে এসব শুধরাবো বুঝতে পারি না।
-আর কথা বলার স্টাইল চেঞ্জ করবি। আর রাগ হলে মেয়েদের মত করে মুখ বাঁকাবি না।
- আচ্ছা । আমার সব কথা ও চুপচাপ মেনে নিতো।
কিন্তু প্রকৃতি গতভাবে যার স্বভাব এমন সে কিভাবে অতি সহজে দোষ কাটাবে।আমরা এমন একটা সমাজে বাস করি যেখানে বৈপরীত্য মেনে নেওয়া হয় না।
তবে ও সেটা বুঝতো ওর চেষ্টা ছিল চোখে পড়বার মত। চেষ্টার অন্ত না থাকলেও পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল। সংকট আরও প্রকট হলো যখন আমরা ক্লাস সেভেন থেকে এইটে উঠলাম।আমাদের ক্লাসের সামনে ওর জন্য নাইন টেনের কিছু ফাজিল টাইপের ছেলেরা ভীড় করতে।
উৎপাত বাড়লো দিনে দিনে।
একদিন টিফিন পিরিয়ডে হঠাৎ একটা বাজে ঘটনার মুখোমুখি হলাম। আমরা তিন চারজন মিলে লুকোচুরি খেলছিলাম।এক পর্যায়ে অপূর্ব তিনতলার সিঁড়ি ঘরে লুকিয়েছিল। আমরা বুঝিনি কারণ এরম ঘটনা এর আগে কখনও ঘটেনি। ক্লাস টেনের কয়েকজন ছেলে সেখানে বসে নোংরা বই এ নোংরা ছবি দেখছিল। ওরা সুযোগ বুঝে ওকে জাপটে ধরে জোর করে চুমু খেলো এবং শরীরের বিশেষ অঙ্গ স্পর্শ করল বিশ্রীভাবে।
কিছুক্ষণ বাদে যখন ও চিৎকার দেবার সুযোগ পেলো তখন আমরা পৌঁছাতে পৌঁছাতে ছেলেগুলো কেটে পড়লো। যাবার আগে বলে গেল যদি এ ব্যাপারে কেউ কিছু জানতে পারে তবে ওরা অপূর্বকে তুলে নিয়ে যাবে। জীবনের মত শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দেবে।
লজ্জায় ঘৃণায় অপূর্ব কদিন স্কুলে এলো না আর। আমি ভাবলাম এই স্কুল থেকে ওর লেখাপড়ার পাঠ চুকলো বুঝি এবার।
অনেক ভালো কবিতা আবৃত্তি করতো অপূর্ব। গান গাইতো, বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলতো। নাচতো কখনও কখনও। চমৎকার সৃজনশীল মন ছিল ওর।
বহুদূর থেকে আসতো বলে ওর সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছিল না। বেশ কিছু দিন পরে ও আবার স্কুলে আসা শুরু করলো। তবে অনিয়মিত।
এত হাসিখুশি ছেলেটা হঠাৎ কেমন যেন বিষন্ন হয়ে গেল।কারও সাথে তেমন কথা বলে না। কথায় কথায় হাসে না। গান গায় না। তিড়িং বিড়িং করে ছোটাছুটি করে না।
অনেক কষ্টে জানা গেল ওর জীবনের করুন কাহিনী। ওর কারণে ওর বাবা মায়ের সংসারটা ভেঙে গেছে। ওর মেয়েলি স্বভাব কন্ঠ আচরণ হাঁটা চলা নিয়ে ওর জন্মগত ক্রটি নিয়ে ওদের সংসারে অশান্তি ছিল আগে থেকেই কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তা প্রকট আকার ধারণ করছিল এবং এর ফলশ্রুতিতে ওর বাবা ওর দাদীর প্ররোচনায় দ্বিতীয় বিয়ে করে বসে এবং ওকে আর ওর মাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়।
ওর মা ওদের এক আত্নীয়ের সাহায্যে কল্যানপুরে এক গার্মেন্টসে ছোট একটা চাকরি জোগাড় করতে সমর্থ হয়। সেই টাকা দিয়ে আপাতত তাদের মা ছেলের সংসার কোন রকমে চলছে।
আস্তে আস্তে অপূর্ব আবার নিয়মিত স্কুলে আসা শুরু করলো।আমরা দুজনে সাধারণত স্কুল কামাই করতাম না।
এর মধ্যে একদিন প্রচন্ড বৃষ্টির দিন ছিল। স্কুলে তেমন কেউ আসেনি সেদিন। আমাদের ক্লাসে আমি আর অপূর্ব সহ কয়েকটি মাত্র ছেলে এসেছিলাম।
প্রথম পিরিয়ডে ক্লাস স্পিকারে রেইনি ডে ছুটি ঘোষনা করা হলো।অনাকাঙ্ক্ষিত ছুটি তার উপর বৃষ্টির দাপট।সবাই চলে গেলেও আমরা বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ টেনের বাজে গ্রুপের সেই ছেলেগুলো আমাদের ক্লাস রুমে এলো।আমাদের বাজে বাজে কমেন্ট করে উত্ত্যাক্ত করতে লাগলো।আমরা পাত্তা না দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলে ওরা আমাকে চলে যেতে বলে অপূর্বকে ধরে রাখলো। আমি প্রতিবাদ করতে গেলে আমাকে পিঠ মোড়া দিয়ে বেধে ফেলল।তারপর যা হলো তা কল্পনাতীত।মানুষ্য জীবনের ঘৃণিত কদর্য রূপ আমার চোখের সামনে উন্মোচিত হলো মুহূর্তে ।আমার ছোট্ট পৃথিবীটা দুলে উঠলো।এখনও অপূর্বর আর্ত চিৎকারগুলো আমার কানে বাজে।ওর ক্ষতগুলো আমাকেও কষ্ট দেয়। আফসোস ওর জন্য কিছু করতে পারিনি সেদিন।
এরপর অপূর্ব আর কোনদিন স্কুলে আসেনি।
আমি অনেক ভাবে ওকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। ওর বাবা কিম্বা সৎ মা কেউ ওর খবর জানাতে আগ্রহ দেখায়নি।
কৈশোরের এই বেদনাটুকু এখনো আমাকে পীড়া দেয়। সেই কুখ্যাত গ্যংয়ের একজন যার নাম যোসেফ ছিল সে পরে বেশ পাওয়াফুল নেতা হয় ক্ষমতাসীন দলের। পরবর্তীতে ক্ষমতার পালা বদলে সে জেলেও যায় জোড়া খুনের মামলায়। এ ঘটনায় আমি খুশি হয়েছিলাম যদিও তবে মাস কয়েক পরে ছাড়া পেতে বিস্মিত হয়েছিলাম তার থেকে বেশি।
জনঅরণ্য অপূর্বকে আমি আজও খুঁজে ফিরি।কেটে গেছে দীর্ঘ ত্রিশটি বছর।কোথায় যে হারালো ছেলেটা। এতদিন বাদে দেখা হলে হয়তো কেউ কাউকে চিনবো না তবু মন চায় একবার দেখা হোক আমাদের । ও ভালো আছে এটুকু জানলে মনটা একটু শান্তি পেতো।
© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০২৩ সকাল ৭:৪৮