কয়েকদিন হলো শীত বেশ জাকিয়ে বসেছে।লেপমুড়ি দিয়ে আরামের ঘুম ঘুমানোর সময় এখন।শীতের সময় সাধারণত এক ঘুমে আমার রাত পার হয়ে যায়।খুব বড় কোন ঝামেলা না হলে ঘুম কাতুরে স্বভাবের কারণে আমার ঘুম সহজে ভাঙে না।কিন্তু সেদিন রাতে অজানা কোন অস্বস্তির কারণে হঠাৎ ই ঘুম ভেঙে গেল।
এর মধ্যে কানে এলো কাছাকাছি কোথাও চিৎকার চেঁচামেচি হচ্ছে।সেই সাথে অদ্ভুত ধরনের কিছু আওয়াজ । আমি অবশ্য এ ধরনের আওয়াজের সাথে তেমন একটা পরিচিত নই। কি হচ্ছে কে জানে!ঘুমে ঝোঁকে এসব আওয়াজ পাত্তা দিলাম না।
আমাদের বাসার পিছনের প্লটে খান কতক দরমার দেয়াল ঘেরা টিনশেডের বাসা আছে।খুব সম্ভব আওয়াজগুলো সেখান থেকে আসছে।
অনেক সময় ওই ঘরগুলোতে দারুণ ঝগড়া ঝামেলা হয়।মারাত্মক আকারের সেই সব ঝগড়া ঝামেলা কোন কোনদিন রাত দুপুরেও গড়ায়।হয়তো সেরম কিছু হবে এই ভেবে আমি পাশ ফিরে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে।আমার পাশে ঘুমিয়ে থাকা বাচ্চারাও তখন জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে ।আমি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম। কি হচ্ছে কি! যেহেতু আলো জ্বালানো নেই ঘরটা অন্ধকার কিন্তু আজকের অন্ধকারটা মনে হচ্ছে একটু বেশি গাঢ়। কিছুক্ষণ বাদে ঘুমের রেশ কাটতেই ঘর ভর্তি ধোঁয়ার উপস্থিতি টের পেলাম !
ধোঁয়া!!!!
ধোঁয়া ক্রমশ বাড়ছে। এত ধোঁয়া কোথেকে আসছে?আমি দৌড়ে কিচেনে ছুটে গেলাম। না সব ঠিক ঠাক ই তো আছে। জানালাও খোলা কিন্তু এখানেও ধোঁয়া আর কিছু একটা পোড়ার বিকট গন্ধ। সমস্যা কি হচ্ছে বুঝতে না পারলেও মাথা যে ঠান্ডা রাখতে হবে সেটা বুঝতে পারলাম। ফ্ল্যাটের গায়ে ফ্ল্যাট।এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছুই ঠাওর করতে পারলাম না।হঠাৎ মাথায় এলো খুব দ্রুত বাসার সবাই কে ঘুম থেকে তুলতে হবে।তা না হলে সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে ।পা বাড়ানোর আগেই দেখি সবারই ঘুম ভেঙে গেছে। সবারই একই সমস্যা শ্বাসকষ্ট হচ্ছে । ততক্ষণে চারদিকে ধোঁয়া আর অন্ধকার।অনতিবিলম্বে আমরা কাশতে শুরু করলাম।দম আটকে আসবার উপক্রম হলো সকলেরই। এটুকু বুঝতে পারলাম আগুন লেগেছে কাছাকাছি কোথাও কিন্তু কোথায় তা জানি না আমাদের যত দ্রুত সম্ভব বেরোতে হবে।দুর থেকে কারা যেন আমাদের নাম ধরে ডাকাডাকি করছে। নিচে কি নামতে পারবো? না-কি উপরে উঠে যাবো? তার আগে দ্রুত বাইরে বের হতে হবে কিন্তু দরজার চাবি কই?অন্য দিন নির্দিষ্ট জায়গায় চাবিটা থাকে কিন্তু আজ নেই। নেই তো নেই। এবার কি হবে? লক খুলবো কি করে? মাথা খারাপ হবার দশা হলো সবার।
বাচ্চারা কাঁদতে শুধু করলো। বাধ্য হয়ে আমি লাথি মেরে দরজা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করলাম কিন্তু..... ঠিক তখনই রাজ বলল আঙ্কেল চাবি পাওয়া গেছে।দ্রুত লক খুলে সবাইকে নিচে নামিয়ে দিলাম।এর মধ্যে আমি কিচেনে গিয়ে গ্যাস সিলিন্ডার খুলে নিয়ে এলাম যদিও কথাটা খুব সহজে লিখলাম কিন্তু যত সহজে লিখলাম কাজটা করা তত সহজ ছিল না।জানালায় তখন আগুনের শিখা। দম নিতে পারছিলাম না আর ঘন কালো ধোঁয়ার কারণে সামনে কিছু দেখতেও পারছিলাম।যা করলাম সব ই আন্দাজে।
যাহোক আমাদের বিল্ডিং এর বাকি ফ্ল্যাটগুলো ব্যাচেলর থাকে বলে অন্যদের গ্যাস সিলিন্ডার নেই।সবাই এক কাপড়ে বেরিয়ে গেছে। বিদ্যুৎ সংযোগও আগেই বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। বাড়িওয়ালা আন্টিরাও গ্যাস সিলিন্ডার সহ প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস সরাতে পেরেছেন। আমাদের ডকুমেন্টস ও প্রয়োজনীয় দ্রবাদি তখন বাসার ভিতর।দেরী হয়ে গেছে এখন আর ফিরে গিয়ে নিয়ে আসবার কোন উপায় নেই। ফায়ার বিগ্রেডের গাড়ি চলে এসেছে ততক্ষণে । সাথে এ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশ কর্মকর্তাগণ এসে পৌছলেন।
আগুন তখন মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। টিনশেড বাড়িগুলো পুড়ে শেষ।টিনগুলো তখন আকাশে ভাসছে।আগুনের চটপট আওয়াজ। বাসার সামনের দুটো নারকোল গাছ আর একটা মেহগনি গাছ তখন জ্বলছে।আগুন বিদ্যুৎ লাইন ছুঁই ছুঁই অবস্থা।বিল্ডিং এর কাঠের জানালার পাল্লায় আগুন। আমরা আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে আছি। পাশেই সিলিন্ডার গ্যাসের বড় গুদাম ঘর।সেখানে আগুন পৌঁছালে যখন তখন পরিস্থিতি আয়ত্ত্বের বাইরে যেতে পারে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ভাইয়েরা দ্রুত লোকজন সবাইকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। এমন সময় রিফাতের মনে পড়লো বাসা থেকে আসবার সময় ওর খরগোস গুলুবুবুকে আনা হয় নি। ও কান্না করতে লাগলো। কি করবো কিছু করার নেই। অথচ একটু আগেও গুলুবুবু আমাদের সাথে ঘুমাচ্ছিল। ও মনে হয় এতক্ষণে...
এদিকে সৌভাগ্যক্রমে দমকলকর্মী ভায়েদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় মিনিট বিশেকের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলো।ভাগ্যিস আমাদের বাড়ির একপাশে বিশাল পুকুর ছিল।পানি পাওয়া গিয়েছিল সহজে। তবে দমকলকর্মী ভায়েরা আর কিছু সময় দেরি করলে পাশের গ্যাস সিলিন্ডারের গোডাউনে আগুন পৌঁছে গেলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হত। যা হোক আগুন যখন মোটামুটি আয়ত্তে তখন ফজরের আযান দিচ্ছে মসজিদে। আমরা তখন ক্লান্ত বিধস্ত ঢুলুঢুলু চোখে বেঁচে থাকার আনন্দে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ছি।
আগুন যখন লাগে তখন বোঝা যায় না ক্ষতি কতটা হলো বা কী কী হলো। পরে টের পাওয়া যায় এর ভয়াবহতা।
যাহোক এই বিশাল অগ্নিকান্ডে কেউ হতাহত না হলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ছিল কল্পনার চেয়ে অনেক বেশি। তারপরও নিরাপদ আছি এটা ভাবতে ভালো লাগলো।
আরও একটা সুখের কথা রিফাতের খরগোশ গুলুবুবুকে আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম। তবে তাকে কেমন যেন নিস্প্রভ দেখাচ্ছিল। তার চঞ্চলতা ফিরে আসতে সপ্তাহখানেক সময় লেগেছিল। সেও হয়তো আমাদের মতো ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিল।
আসলে আমরা তো সবাই প্রানী। আমরা সবাই ভীষণ ভাবে জীবনকে ভালোবাসি।
বেঁচে থাকা সত্যি দারুণ ব্যাপার।
আজ তাহলে এ পর্যন্ত। সময় পেলে আবার অন্য স্মৃতিকথা নিয়ে হাজির হবো খুব শীঘ্রই।
© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০২৩ দুপুর ১২:২৫