৯০-এর দশকের রাম-আন্দোলন
বিশ্বে নানা স্থানে অন্য যেসব ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী আছে তারা যে সমাজ তৈরি করতে চায় তাদের কাছে তার একটা স্পষ্ট রূপ আছে। কিন্তু সঙ্ঘের প্রস্তাবিত হিন্দু-রাষ্ট্র কীরকম হবে, সেটা তারা ইচ্ছে করেই অস্পষ্ট রেখে দিয়েছে। কারণ, আরএসএস হিন্দুত্বের পুনর্জাগরণের যে কাজে নেমেছে তার জন্য সমর্থক-ভিত্তি বাড়াতে হবে, আর এখানেই নানা সমস্যায় জড়িয়ে পড়ছে তারা। গরিব ও নিচু জাতের মানুষদের কাছে আরএএস-এর হিন্দুত্বের বাহ্মণ্যবাদী ধারণা বিশেষ সমর্থন পায় না। তাদের হিন্দু আধিপত্যবাদীর ধারণার মধ্যে জাত ও শ্রেণিগত, জাতিগত, ভাষাগত ও স্থানীয় আনুগত্যের বিষয়গুলিকে উপেক্ষা করা হয়। এইসব সমস্যার মুখে পড়ে আরএসএস তার উচ্চাকাঙ্খী হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধারণাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দুটি বিষয় নিয়ে এলো—(১) ভারতের [কংগ্রেস ও অন্যান্য সমাজবাদী] সরকারের প্রতি ঘৃণা, ও (২) ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা জাগিয়ে তোলা। এই দুটি লক্ষ্য পূর্ণ করতে তারা রাম জন্মভূমি কর্মসূচি হাতে নেয়, পাশাপাশি দেশ জুড়ে সঙ্ঘের জঙ্গি কর্মীদের দিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধায়। এইসব দাঙ্গায় হিন্দুর তুলনায় অনেক বেশি মুসলমান হত্যা, ধর্ষণ, সম্পত্তি ভাঙচুর ও ধ্বংসের শিকার হয়েছেন। সঙ্ঘ পরিবার এখন নিজেদের হাজির করে এক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হিসেবে, “সমাজতান্ত্রিক ও ঈশ্বরে অবিশ্বাসী” রাষ্ট্রশক্তি যাদের বিরোধিতা করছে। তাদের অভিযোগ, এই রাষ্ট্রশক্তি মুসলমান ও অন্য সংখ্যালঘুদের বেশি লাই দিয়ে চলেছে—যদিও সঙ্ঘ ভালো করেই জানে যে মুসলিম ও অন্য সংখ্যালঘুরা আসলে এ দেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে চিরাচরিতভাবে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের অবস্থানে থেকেছেন।
নব্বইয়ের দশকে তাই আরএসএস, ভিএইচপি ও বিজেপি একসাথে রাম-মন্দিরের হিন্দু পুনরুত্থানবাদী প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলে। অযোধ্যায় শ্রীরামের “ঐতিহাসিক” জন্মস্থান নিয়ে তারা আন্দোলন গড়ে তোলে। তাদের বক্তব্য, ঐ জায়গায় অবস্থিত বাবরী মসজিদ (বাবরের নামানুসারে) নামের মসজিদটি নাকি গড়ে তোলা হয়েছিল “মুসলিম” আগ্রাসনকারীদের হাতে—ওখানে অবস্থিত হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসস্তুপের ওপর। সঙ্ঘের বক্তব্য অনুসারে, সেই মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল শ্রীরামের পবিত্র জন্মস্থানকে চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে। সঙ্ঘের বক্তব্য এই যে, একাদশ শতক থেকেই ওখানে স্তম্ভসহ একটি মন্দির ছিল।
কিন্তু বেলজিয়ামের উৎসাহী বিজেপি-পন্থী লেখক কনরাড এলস্ট পর্যন্ত তার বইয়ে স্বীকার করেছেন—
“মন্দিরটি কবে ধ্বংস করা হয়েছিল সেটা আমরা ঠিকঠাক জানি না। কোথাও এই ঘটনার কোনও বর্ণনা পাওয়া যায় না। মহম্মদ ঘোরীর সেনাবাহিনী এসেছিল ১১৯৪ সালে—তারা ধ্বংস করে থাকতে পারে। তার পরে সেটা তৈরি করা হয়েছিল।, এমনটাও হয়ে থাকতে পারে। আবার পরবর্তী কালের মুসলমান সেনাপতিরাও এটিকে ধ্বংস করে থাকতে পারে। তাই এটা সম্ভব যে ১৫২৮ সালে বাবরের সেনাপতি মীর বাকি যখন এখানে আসেন, তিনি হয়ত দারুন একটা হিন্দু মন্দির নয়, একটা ধ্বংসস্তুপ বা পুরনো একটা মসজিদ দেখতে পেয়েছিলেন”। অন্য পুরাতত্ত্ববিদরা পরিষ্কার জানিয়েছেন যে ওখানে কোন ইটের বা পাথরের মন্দিরের অস্তিত্বের কোন রকম প্রমাণ পাওয়া যায়নি। (ক্রমশঃ)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ১১:৩৭