ফেসবুকে একটা ফটো দেখে হঠাৎ করেই স্কুল লাইফের বৃষ্টিভেজা দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেলো । কেন জানিনা, কৈশোরের যেকোনো কথা মনে পড়লেই বুকের মধ্যে একটা ব্যাথাভাব মোচড় দিয়ে উঠে । আর কোনদিনই ওইসব দিনগুলোতে ফিরে যেতে পারবোনা বলেই হয়তো এমন হয় । যাইহোক, স্কুল জীবনের বৃষ্টির দিনগুলো ছিল আমার কাছে অন্যরকম উৎসবের উপলক্ষ । গ্রামের স্কুলে পড়তাম । বৃষ্টির দিন মানেই স্কুলে কোন ক্লাস হতোনা । কিন্তু ক্লাস না হলে কি হবে আমরা সবাই স্কুলে জেতাম ঠিকই । বরং অন্যান্য দিনের চেয়ে আরও বেশী জোশ নিয়ে যাইতাম । বৃষ্টিভেজা ঠাণ্ডা ওয়েদারে বৃদ্ধপ্রায় শিক্ষকগুলা টিচার্স রুমে বসে বসে ঝিমাইত । আমাদের হই হুল্লোড়ে বাঁধা দেবার মত কেউই থাকতোনা । কাজেই বাঁধভাঙ্গা হই হুল্লোড় হত স্কুলের পুরা সময়টা জুড়ে ।
অথবা বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলার পাইতারা শুরু হয়ে যেত । বৃষ্টিতে ভিজে স্কুলের মাঠের কাদায় লুটোপুটি খেয়ে ফুটবল খেলার সেই স্মৃতিকে লিখে প্রকাশ করার ক্ষমতা হয়তো কাররই নাই । খেলা শেষে স্কুলের পাশের ছোট্ট নদিতে ঝাপিয়ে পড়ে দাপাদাপি চলতো আরও কিছুক্ষণ । শরীর ক্লান্ত হয়ে নেতিয়ে পড়তে চাইতো । কিন্ত মন! কখনই ওই নদির ঘোলা পানি থেকে উঠে আসতে চাইতোনা ।
অথবা ক্লাসরুমের পাশের অব্যাবহিত রুমে বসে সম্পা সারকার অনু'র গান শোনা । অনু আমার স্কুল জীবনের সবচেয়ে ভালো বন্ধু এবং আমার জীবনের প্রথম প্রেম । সে এখন কোথায় আছে আমি জানিনা । খুব সহজেই এই মেয়েটিকে আমি আমার জীবন থেকে হারিয়ে যেতে দিয়েছি । যাই হোক, বৃষ্টির দিনগুলোতে সবাই যখন হই হুল্লোড় করা নিয়ে ব্যাস্ত ঠিক তখন হটাত করেই অনুকে ডেকে নিয়ে ওই ঘরে চলে যেতাম । আমার ডাক শুনেই ও বুঝত আমি ওর গান শুনতে চাচ্ছি । আমিও জানতাম আমি চাইলে ও গান শোনাবেই । তারপরেও অনু খুব সহজে গান শুরু করতোনা । আমার বিভিন্ন ব্যাপারে অভিযোগ তুলে কিল ঘুষি দিত বেস কিছুক্ষন । কিলঘুশির জবাবে আমিও যে চুপ থাকতাম এমনটা না । আমাকে একটা মারলে আমি তা সুদে আসলে শোধ দিতাম । অদ্ভুত ব্যাপার হোল এই মেয়েটি কখনই আমার উপর রাগ করে থাকতোনা । একবার আমি ওর কপালে এতো জোরে ঘুষি মারি যে কিছুক্ষনের মধ্যেই কপাল ফুলে ওঠে ভয়ঙ্করভাবে । আমিতো ভয়েই অস্থির । স্যারদের প্যাদানি খাবার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত । স্যার আসলে ও বলল যে দরজার সাথে মাথা লেগে এরকম হয়ছে । স্যার ওকে বাসায় পাঠিয়ে দিল ।
গানের প্রসঙ্গে ফিরে আসি । কিলঘুষি চলতে চলতেই গান গাইতে শুরু করতো অনু । আমি তখন গানে হারিয়ে যেতাম । মুগ্ধতার অন্য একটা জগতে প্রবেশ করতাম । ওই বয়সেই অনু "জনমও জনমও তব তঁরে কাদিব" "শাওনও গগনে ঘোর ঘনঘাটা" "অনেক বৃষ্টি ঝরে তুমি এলে" শীর্ষক গানগুলো অসম্ভব ভালো গাইতো । বৃষ্টির ঝঙ্কার আর অনুর কণ্ঠের সুরের ঝঙ্কার দুই মিলে আমার কৈশোরের দুরন্ত মনকেও উদাস করে তুলত । আহারে! সেই দীনগুলা । এখনো প্রতিবছর অন্তত দুইবার সপ্নে আমি স্কুলের সেই রুমে ফিরে যায় । অনুর সাথে কিলঘুশি বিনিময় শেষে মুগ্ধ হয়ে ওর গান শুনি ।
স্কুল ছুটি হলে এক ছাতার নীচে অনুর সাথে বাড়ির পথে হাটতাম । সবই ছিল অন্যরকম সুখের অনুভুতিতে পরিপূর্ণ ।
আমাকে যদি কৈশোরের একটা মুহূর্ত ফিরিয়ে দেওয়া হয়, আমি তাহলে অনুর কণ্ঠে গান শোনার মুহূর্তটা ফিরে পেতে চাইব । আমাকে যদি কৈশোরের একটা দিন ফিরিয়ে দেয়া হয়, আমি স্কুল জীবনের একটা বৃষ্টিভেজা দিন ফিরে পেতে চাইব ।